Amar Sangbad
ঢাকা বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪,

শেষ সময়েও নেই গতি

জাহাঙ্গীর আলম

মার্চ ১৩, ২০২১, ০৭:২০ পিএম


শেষ সময়েও নেই গতি
  • সরকারি ব্যাংকের মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক
  • দ্বিতীয় পর্যায়ে রয়েছে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক
  • বেসরকারির মধ্যে সর্বোচ্চ ঋণ বিতরণ করেছে ইসলামী ব্যাংক
  • দ্বিতীয় পর্যায়ে রয়েছে এক্সিম ব্যাংক
  • এ মাসেই ব্যাংকগুলো পুরোটাই বিতরণ করবে বলে আমরা আশাবাদী -মো. সিরাজুল ইসলাম বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র

করোনা মহামারির ধকল সামলাতে সরকার বড় ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের মতো কৃষকদের জন্যও গত এপ্রিলে পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে। বাংলাদেশ ব্যাংক কৃষিখাতে ৪ শতাংশ সুদে এই প্রণোদনা ঋণ দেয়ার ব্যবস্থা করেছে। ৪৩টি ব্যাংক এই ঋণ দিতে চুক্তিবদ্ধ হলেও অনেক ব্যাংকের আগ্রহ কম থাকায় কয়েকবার সময় বাড়িয়ে মার্চে পুরো ঋণ বিতরণ করতে বলা হয়েছে। তারপরও শেষ সময়ে অগ্রগতি নেই। ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ঋণ বিতরণ হয়েছে ৭১ শতাংশ। তবে এর মধ্যে বেশি বরাদ্দ নিয়েও সরকারি ব্যাংকের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক সবচেয়ে বেশি প্রায় এক হাজার ৬১৬ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে। এরপর রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক, ৪০১ কোটি টাকা, সোনালী ব্যাংক, ১৩১ কোটি টাকা। আর বেসরকারি ব্যাংকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঋণ দিয়েছে ইসলামী ব্যাংক, ২৯০ কোটি টাকা। এরপরে এক্সিম ব্যাংক, ১৩৩ কোটি টাকা ও ব্র্যাক ব্যাংক, ৮২ কোটি টাকা। তবে অনেক ব্যাংক কম বরাদ্দ নিয়েও লক্ষ্যের কাছে নেই। আইএফআইসি ৬৩ কোটি টাকার বিপরীতে মাত্র পাঁচ কোটি টাকা বিতরণ করেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোনো কোনো ব্যাংকের আগ্রহ কম থাকায় কৃষকের জন্য কম সুদের এই ঋণ বিতরণে গতি আসেনি।

সার্বিক ব্যাপারে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম আমার সংবাদকে জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করোনা মোকাবিলা করতেই তথা আর্থিক সংকট মোকাবিলায় কৃষি খাতের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকা তহবিলের মাধ্যমে এই ঋণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কৃষকরা যাতে এই ঋণ ভালোভাবে পায় সে জন্য গত বছরের ১৩ এপ্রিল বাংলাদেশ ব্যাংক সার্কুলার জারি করে। ছয় মাসের গ্রেস পিরিয়ডসহ দেড় বছরে এই ঋণ বিতরণের জন্য ৪৩টি ব্যাংকের সাথে চুক্তি করে তাদের বরাদ্দ দেয়া হয়। তাদের এই ঋণ দেয়ার জন্য বারবার তাগিদ দেয়া হয়েছে। কয়েকবার সময়ও বাড়িয়ে মার্চে পুরো টাকা বিতরণ করতে বলা হয়েছে। তারপরও কেন গতি নেই। ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৭১ শতাংশ অগ্রগতি— এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমি আশাবাদী এ মাসেই ব্যাংকগুলো বরাদ্দের পুরোটাই বিতরণ করবে। কারণ, বর্তমানে পোল্ট্রিফিড, ফুলের ও ফলের চায়ের জন্য কৃষকের ঋণের চাহিদা রয়েছে। তাই ব্যাংকগুলোও গুরুত্ব দেবে, যাতে পুরোটাই কৃষকরা পায়।     

বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে খাদ্য উৎপাদন ও খাদ্য সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার লক্ষ্যে কৃষি খাতে শস্য ও ফসল চাষে কৃষকদের জন্য ১৩ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী একটি পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে। কৃষকের জন্য দেয়া পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজের সুদহার হবে ৪ শতাংশ। বাকি পাঁচ শতাংশ সরকার ব্যাংকগুলোকে দেবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, কৃষি ঋণের সাধারণ সুদহার ৯ শতাংশ, এর পাঁচ শতাংশ ভর্তুকি দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে কৃষকের সুদ কমে হবে ৪ শতাংশ। ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত এ সুবিধা পাবেন কৃষকরা। এর ফলে কৃষি খাতে সব ধরনের ঋণের সুদহার কমে ৪ শতাংশ করা হয়েছে।

এই তহবিল থেকে চলতি মূলধন পাবে মওসুম ভিত্তিক ফুল ও ফল চাষ, মাছ চাষ, পোল্ট্রি ও ডেইরি এবং প্রাণিসম্পদসহ কৃষি খাতে। তবে শস্য ও ফসল খাত এর বাইরে ছিলো। এ ছাড়া আগে থেকে আমদানি বিকল্প ফসল, ডাল, তেলবীজ, মসলা জাতীয় ফসল ও ভুট্টা চাষের জন্য ৪ শতাংশ সুদে কৃষকরা ঋণ পাচ্ছেন। করোনা ভাইরাসের কারণে এখন থেকে আমদানি বিকল্প এসব ফসলের পাশাপাশি ধান, গমসহ সব দানা শস্য, অর্থকরী ফসল, শাকসবজি ও কন্দ ফসল চাষের জন্যও ৪ শতাংশ রেয়াতি সুদহারে ঋণ পাবেন কৃষকরা। এখন কৃষির প্রায় সব খাতই ৪ শতাংশ ঋণের আওতায় আনা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালায় বলা হয়েছে, করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে আগামী দিনে খাদ্যের উৎপাদন ও খাদ্য সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার লক্ষ্যে কৃষি খাতে শস্য ও ফসল চাষের জন্য কৃষক পর্যায়ে স্বল্প সুদে কৃষি ঋণ সরবরাহ করা অত্যাবশ্যক। এ জন্যই শস্য ও ফসল খাতে ৪ শতাংশ সুদে ঋণ বিতরণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

কিন্তু বিভিন্ন অজুহাতে গতি পায়নি কৃষকের এই প্যাকেজে। গত অক্টোবর পর্যন্ত চুক্তিবদ্ধ ৪৩টি ব্যাংকের মাধ্যমে প্রায় ৯০ হাজার কৃষককে ঋণ দেয়া হয় মাত্র দুই হাজার ২৬৯ কোটি টাকা। যা মোট প্যাকেজের মাত্র ৪৫ শতাংশ। এই ধীর গতি নিয়ে অর্থমন্ত্রণালয়ের কর্মশালায় অনেক সমালোচনার ঝড় উঠে। অর্থনীতিবিদরা বলেন, কৃষকরাই অর্থনীতির প্রাণ। তাই তাদের স্বার্থে এই ঋণ বিতরণে দেরি কেন? বাধ্য হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক সময় বাড়িয়ে ব্যাংকগুলোকে তাগিদ দিয়ে মার্চ পর্যন্ত সময় বাড়িয়ে পুরো ঋণ দিতে বলেছে। কিন্তু শেষ সময়ে অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিতরণ করা হয়েছে তিন হাজার ৫৫৭ কোটি টাকা বা ৭১ শতাংশ। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ৮১ হাজার ৪৭৯ জন কৃষককে এক হাজার ৬১৬ কোটি টাকা বা বরাদ্দের ৯৫ শতাংশ ঋণ দিয়েছে। এরপরই রাকার আট হাজার ৮৩০ জনকে ঋণ দিয়েছে ৪০১ কোটি টাকা। তৃতীয় পর্যায়ে সর্বোচ্চ ১৬ হাজার ৯৮৫ জনকে ঋণ দিয়েছে সোনালী ব্যাংক ১৩১ কোটি টাকা বা বরাদ্দের প্রায় ৬৩ শতাংশ। চতুর্থ পর্যায়ে অগ্রণী ব্যাংক ১০ হাজার ৬২৪ জনকে ৯৯ কোটি ৩২ লাখ টাকা ঋণ দিয়েছে। আর জনতা ব্যাংক চার হাজার ৯৬০ জনকে ঋণ দিয়েছে ৭৪ কোটি টাকা।

অপরদিকে বেসরকারি ব্যাংকের মধ্যে সর্বোচ্চ ১০ হাজার ৯৭৭ জনকে ২৯০ কোটি টাকা বা বরাদ্দের ৭২ দশমিক ৫৩ শতাংশ কৃষি প্রণোদনা ঋণ দিয়েছে ইসলামী ব্যাংক। এরপর এক্সিম ব্যাংক ২৯৬ কৃষককে ১৩২ কোটি ৫৯ লাখ টাকা বা বরাদ্দের ৯০ শতাংশ ঋণ দিয়েছে। ব্র্যাক ব্যাংক এক হাজার ৮২১ জনকে ৮১ কোটি ৬৭ লাখ টাকা বা বরাদ্দের ৮৬ দশমিক ৮৮ শতাংশ ঋণ বিতরণ করেছে। শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক ১৯৫ জনকে ৫৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা এবং মার্কেন্টাইল ব্যাংক ৩৪৭ কৃষককে ঋণ দিয়েছে প্রায় ৫২ লাখ টাকা বা বরাদ্দের ৭৪ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র বলছে, কোনো কোনো ব্যাংক বরাদ্দ কম নিয়ে বিতরণ প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। আবার অনেকে কম করে বরাদ্দ নিয়েও আন্তরিকতার অভাবে বিতরণ কম হয়েছে। এনআরবি ব্যাংক দেড় কোটি টাকা বরাদ্দ নিয়ে মাত্র ছয়জনকে এক কোটি ২৯ লাখ টাকা ঋণ দিয়েছে। অন্যান্য কিছু ব্যাংকও কম ঋণ দিয়েছে সময় ঘনিয়ে এলেও।

এ ছাড়া করোনাকালে চলতি অর্থবছরে বাজেটে সরকার খাদ্য নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে কৃষি ভর্তুকি আগের চেয়ে বাড়িয়ে সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে। যা সার, পল্লী বিদ্যুতে রিবেটসহ বিভিন্ন খাতে এই প্রণোদনা ব্যয় করার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। কিন্তু অগ্রগতি কম। এ ছাড়া অন্যান্য বছরের চেয়ে চলতি অর্থবছরেও কৃষি খাতে ২৪ হাজার কোটি টাকা ঋণ বিতরণের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তা সঠিকভাবে বিতরণের জন্য বিভিন্ন ব্যাংককে লক্ষ্যমাত্রাও নির্ধারণ করে দিয়েছে। সুদের হার বেশি হলেও প্রণোদনা প্যাকেজের সুদের সাথে সামঞ্জস্য রেখে কৃষকের সব ঋণে সুদ ৪ শতাংশ কার্যকর করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্দেশ দিয়েছে।  ধান, গম, আলু, ভুট্টাসহ সব ধরনের শস্য ও ফসল উৎপাদনে ঋণের সুদহার ৪ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। নতুন ঋণের পাশাপাশি আগের ঋণেও এই রেয়াতি সুদহার কার্যকর হবে। বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ নিয়ে বলেন, ‘কৃষি ঋণের বড় অংশই শস্য ও ফসল উৎপাদন খাতে যাবে। এর ফলে কৃষকেরা উপকৃত হবেন।’

আমারসংবাদ/জেআই