Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪,

প্রসঙ্গ : করোনায় গ্রামীণ নারী

খোন্দকার মাহফুজুল হক

মার্চ ১৫, ২০২১, ০৯:৪০ পিএম


প্রসঙ্গ : করোনায় গ্রামীণ নারী
  • চলমান করোনা পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গ্রামীণ নারীবান্ধব বিশেষ উদ্যোগ আমার বাড়ি আমার খামার ও পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক গ্রামীণ নারীদের বিপদকালীন রক্ষাকবজরূপে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। অনলাইন ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে গ্রামীণ নারীদেরকে আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তির সেবার আওতায় আনার ফলে আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত ও ডিজিটালাইজেশনের আওতায়ও তাদের আনা সম্ভব হচ্ছে। দরিদ্র মানুষের জন্য তহবিল গঠনের এমন উদ্যোগ বিশ্বে এটাই প্রথম। অনেক দেশ ও আন্তর্জাতিক এনজিও বাংলাদেশ সরকারের দারিদ্র্য নির্মূলের, বিশেষ করে গ্রামীণ নারীদের উদ্যোক্তা, উন্নয়ন, ক্ষমতায়ন ও দারিদ্র্য দূরীকরণের এ মডেল গ্রহণে আগ্রহ দেখাচ্ছে। দারিদ্র্যকে ২০২১ সালের মধ্যে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার পরিকল্পনায় করোনার মধ্যেও বাধা-বিঘ্ন মাড়িয়ে এগিয়ে চলছে আমাদের অর্থনীতি।

নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার কালাপাহাড়িয়ার আমেলা বেগম। বড়ির বাইরে নিজের তেমন কিছু নেই। স্বামী আম্বর আলি দিনমজুর। করোনা পরিস্থিতিতে লকডাউনের ফলে কাজকর্মও নেই বললেই চলে। প্রায় দিনই স্বামী ঘুরে ফিরে খালি হাতে বাড়ি ফেরেন। তিন সন্তান নিয়ে আমেলা বেগম কী করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। এ সময়ই তার বাড়ির উঠোনে স্বাস্থ্যবিধি মেনে উপস্থিত হয় আমার বাড়ি আমার খামারের মাঠকর্মী ফাতেমা আক্তার। আমেলা বেগমের অবস্থা শুনে প্রধানমন্ত্রীর দেয়া করোনাকালীন প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় কর্মসৃজন ঋণ প্রদান করেন। ঋণের টাকায় আমেলা বেগম সেলাই মেশিন ক্রয় করেন। কাপড়ের মাস্ক তৈরি করে স্বামীকে দেন। দিন শেষে স্বামী আম্বর আলি মাস্ক বিক্রির টাকার লভ্যাংশ দিয়ে বাজার হাতে করে ঘরে ফেরেন। ঋণ পরিশোধের কিস্তির টাকা আমেলা বেগমের হাতে তুলে দেন। মওসুমি ফড়িয়াদের আনাগোনায় অতিষ্ঠ পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার মাড়েয়ার হাওয়া বিবি। অনেক কষ্টে এ বছর কিছু ধান তার উদ্বৃত্ত রয়েছে। কিন্তু ধানের মওসুমে দাম খুবই কম। দু-তিনমাস ধানগুলো গোলাজাত করে রাখতে পারলে ভালো একটা দাম পাওয়া যেতো। এ জন্য দরকার একটা ধানের গোলা ক্রয় করা। কিন্তু ধানের গোলা ক্রয়ের টাকা এ মুহূর্তে তার হাতে নেই। এ সময়ই তার থেকে কিস্তি নিতে আসে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের মাঠকর্মী আফরোজা আক্তার। তাকে বিষয়টি বললে তিনি ব্যাংকের নবসৃষ্ট ‘শস্যগোলা ঋণ’ কর্মসূচি থেকে হাওয়া বিবিকে ঋণ পাইয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করে দেন। সে টাকায় হাওয়া বিবি ধান গোলাজাত করে আশার স্বপ্ন দেখেন অধিক দাম পাওয়ার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অন্যতম বিশেষ উদ্যোগ ‘আমার বাড়ি আমার খামার’ ও ‘পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক’। দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ ও মানবসম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার করে কৃষিভিত্তিক আয়বর্ধক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খামার গড়ে তুলে কৃষি উৎপাদন ও পারিবারিক আয় বৃদ্ধিসহ নারীর ক্ষমতায়ন এবং দারিদ্র্যমোচন নিশ্চিত করাই এর লক্ষ্য। ২০২১ সালের মধ্যে দারিদ্র্যকে শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে এটি, যা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার প্রধান লক্ষ্য।

প্রকল্প ও ব্যাংকের অধীনে গঠিত সমিতির ৬৭ ভাগ সদস্যই নারী। নারীর ক্ষমতায়নে প্রকল্পভুক্তদের ইতিবাচক পরিবর্তন সকল সূচকে ইতোমধ্যে লক্ষ করা যাচ্ছে। প্রান্তিক মানুষের, বিশেষ করে নারীদের পাশে দাঁড়াতেই সরকারের এ উদ্যোগ। দেশের সাত বিভাগ, ৬৪ জেলা, ৪৮৫ উপজেলা, চার হাজার ৫০৩ ইউনিয়ন ও ৪০ হাজার ৫২৭ গ্রাম এবং তৃতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে ‘পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক’ গঠনের মাধ্যমে আরও ৬০ হাজার গ্রামকে অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে এ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। সাধারণ ঋণ, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ঋণ, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ঋণসহ অন্যান্য সহায়তামূলক কর্মসূচি নিয়ে গ্রামে গ্রামে ছুটছেন এর কর্মকর্তা ও মাঠকর্মীরা। পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের আওতায় সাধারণ সঞ্চয়, বিশেষ সঞ্চয়, সামাজিক সুরক্ষা সঞ্চয়, ছাত্র সঞ্চয়, মেয়াদি আমানত এবং গ্রামীণ পেনশন স্কিম এতে রয়েছে। যার মাধ্যমে গ্রামীণ মানুষ, বিশেষ করে নারীদের মধ্যে সঞ্চয় মানসিকতা তৈরি হচ্ছে। বিপরীতে ব্যাংক গরু মোটাতাজাকরণ, কৃষিভিত্তিক ক্ষুদ্র শিল্প, গাভী পালন, কুটিরশিল্প, মৎস্যচাষ, নার্সারি, কৃষিভিত্তিক শিল্পের জন্য নানা পণ্য উৎপাদন, শাক-সবজি এবং মশলা উৎপাদনে ঋণ সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। গ্রাম উন্নয়ন সমিতির সদস্যদেরকে ব্যাংক আর্থিক সহায়তার পাশাপাশি বিভিন্ন আয়বর্ধক কার্যক্রমে দক্ষতা বৃদ্ধির প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। করোনাকালীন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসা, খামার, কৃষিসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে পর্যায়ক্রমে ৫০০ কোটি টাকার কর্মসৃজন ঋণ প্রদান করছে ব্যাংক। করোনায় বিদেশ ফেরতদের জন্যও ঋণ প্রদান করছে ব্যাংক। সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে আয়বর্ধক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হতে সহায়তা এবং সঞ্চয় গড়ে তুলতে উদ্বুদ্ধ করে অন্যান্য প্রচলিত ব্যাংক থেকে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক স্বতন্ত্র একটি পরিচয় বহন করছে। ফলে গ্রামীণ নারীরা খুব সহজেই ব্যাংককে তাদের পাশে পাচ্ছেন।

গ্রামীণ সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠী বিশেষত নারী উদ্যোক্তাদের প্রাতিষ্ঠানিক আর্থিক সেবার আওতায় নিয়ে আসাই পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের মূল লক্ষ্য। এ জন্য ব্যাংক আয়বর্ধক কর্মকাণ্ড এবং সঞ্চয় গড়ে তুলতে গ্রামীণ নারীদেরকে উদ্বুদ্ধ ও সহায়তা করে। করোনাকালীন চালু হওয়া ‘শস্য গোলা ঋণ’ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য হ্রাস এবং প্রান্তিক কৃষকদের ফসলের ন্যায্যমূল্য পেতে এই ঋণ কর্মসূচি সহায়তা করবে।’ নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার মুকুন্দরামের শিউলি রানী দাস ‘কর্মসৃজন ঋণ’ নিয়ে করোনাকালীন তার ক্ষুদ্র ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করতে পেরেছেন। একইভাবে পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার কলোনিপাড়া গ্রামের রিমা আক্তারও এ ঋণ নিয়ে করোনাকালীন কৃষিকর্মে সহায়তা পেয়েছেন। সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলার গোলজাহান বেগম ‘শস্যগোলা ঋণ’ সহায়তা পেয়েছেন। ‘পল্লী সঞ্চয় ব্যাংককে’ তারা করোনার এ দুর্যোগে পাশে পেয়েছেন বলেই প্রধানমন্ত্রীসহ সবার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রকল্প পরিচালক আকবর হোসেন জানান, বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাসের কারণে অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি হয়েছে এবং সরবরাহ কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। এ অবস্থায় পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে ঋণ প্রদান কার্যক্রম চালু রেখেছে। এর ইতিবাচক প্রভাব প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে ব্যাপকভাবে দেখা যাচ্ছে। নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার প্রকল্প ও ব্যাংকের সমন্বয়ক খোন্দকার মো. হাসান তারেক জানান, ‘করোনাকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ উদ্যোগ আমার বাড়ি আমার খামার ও পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের প্রতিটি কর্মসূচি স্বাস্থ্যবিধি মেনে মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়নে আমরা তৎপর রয়েছি। নির্দেশিত প্রতিটি খাতে ঋণ সহায়তা দেয়া হচ্ছে। যেহেতু আমাদের ৬৭ ভাগ সদস্য নারী। তাই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আমরা তাদের পাশেই ঋণ সহায়তা নিয়ে দাঁড়াচ্ছি।’

চলমান করোনা পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গ্রামীণ নারীবান্ধব বিশেষ উদ্যোগ আমার বাড়ি আমার খামার ও পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক গ্রামীণ নারীদের বিপদকালীন রক্ষাকবজরূপে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। অনলাইন ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে গ্রামীণ নারীদেরকে আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তির সেবার আওতায় আনার ফলে আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত ও ডিজিটালাইজেশনের আওতায়ও তাদের আনা সম্ভব হচ্ছে। দরিদ্র মানুষের জন্য তহবিল গঠনের এমন উদ্যোগ বিশ্বে এটাই প্রথম। অনেক দেশ ও আন্তর্জাতিক এনজিও বাংলাদেশ সরকারের দারিদ্র্য নির্মূলের, বিশেষ করে গ্রামীণ নারীদের উদ্যোক্তা, উন্নয়ন, ক্ষমতায়ন ও দারিদ্র্য দূরীকরণের এ মডেল গ্রহণে আগ্রহ দেখাচ্ছে। দারিদ্র্যকে ২০২১ সালের মধ্যে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার পরিকল্পনায় করোনার মধ্যেও বাধা-বিঘ্ন মাড়িয়ে এগিয়ে চলছে আমাদের অর্থনীতি। এ এগিয়ে চলার ক্ষেত্রে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির চিত্র বদলে দিতে সহায়তা করছে আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্প ও পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক। আর এ সাথে ছায়া দিয়ে রেখেছে আমাদের গ্রামীণ নারীদের, ক্ষমতায়িত করে দেশের সার্বিক উন্নয়নে অবদান রাখছে বিশেষভাবে।

(পিআইডি-শিশু ও নারী উন্নয়নে সচেতনতামূলক যোগাযোগ কার্যক্রম ফিচার)

আমারসংবাদ/জেআই