Amar Sangbad
ঢাকা বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪,

এখনো কাটেনি আতঙ্ক

মার্চ ১৮, ২০২১, ০৯:১৫ পিএম


এখনো কাটেনি আতঙ্ক
  • বিরাজ করছে থমথমে অবস্থা, গ্রামে বসানো হয়েছে পুলিশ ও র‌্যাবের অস্থায়ী ক্যাম্প
  • বাংলাদেশ অসামপ্রদায়িক দেশ, এখানে সবার সমান অধিকার রয়েছে, কেউ যদি সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন করে, তা সহ্য করা হবে না : র‌্যাব ডিজি
  • সমপ্রীতি বিনষ্টকারীদের কোনো রক্ষা নেই : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
  • সুনামগঞ্জের হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামে হামলাকারীদের কোনো ছাড় দেয়া হবে না : সড়ক ও সেতুমন্ত্রী

সুনামগঞ্জের শাল্লায় হিন্দু গ্রামে হামলার আশঙ্কা জেনেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কোনো পদক্ষেপ নেয়নি— এমন অভিযোগ ওঠার পর এখন অভয় দিচ্ছেন পুলিশ ও র‌্যাবের কর্মকর্তারা। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে শাল্লার হবিবপুর নোয়াগাঁও গ্রাম পরিদর্শন করেন র‌্যাবের মহাপরিচালক (ডিজি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ্ আল মামুন। তার গ্রামের বাড়ি ওই উপজেলাতেই।

র‌্যাব ডিজি বলেন, এ ঘটনায় জড়িত কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। যারা দেশে সামপ্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি করছে, তাদের অতিদ্রুত আইনের আওতায় এনে বিচার নিশ্চিত করা হবে।

তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। এটি এক পক্ষ সহ্য করতে পারছে না। তাই সামপ্রদায়িক অশান্তি সৃষ্টি করে ভাবমূর্তি নষ্ট করতে চাইছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেভাবে জঙ্গিবাদ দমনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখে বিশ্ব দরবারে দেশের সুনাম অর্জন করেছে, সেভাবে অচিরেই সামপ্রদায়িক সন্ত্রাসীদের কালো হাত ভেঙে দেয়া হবে।

র‌্যাব মহাপরিচালক বলেন, অসামপ্রদায়িক এই দেশে সবার সমান অধিকার রয়েছে। কেউ যদি সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন করে তা সহ্য করা হবে না।

এদিকে গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ভুক্তভোগীদের কেউ মামলা না করায় পুলিশ মামলা করেছে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। তবে এ ঘটনায় এখনো আটকও হয়নি কেউ।

রাজধানীর তেজগাঁওয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে বিশেষ প্রার্থনা এবং এতিমদের মাঝে বস্ত্র ও খাবার বিতরণ অনুষ্ঠানে শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, দেশে সমপ্রীতি বিনষ্টকারীদের কোনো রক্ষা নেই। যারা সমপ্রীতি বিনষ্ট করবে, তাদের যেকোনো মূল্যে প্রতিহত করা হবে। সুনামগঞ্জের ঘটনায় পুলিশ বাদি হয়ে মামলা করেছে আর ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা করা হবে।

তিনি বলেন, সুনামগঞ্জের শাল্লায় হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলার পর ভুক্তভোগী পরিবার মামলা করবে কি-না, সে অপেক্ষায় ছিলো স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন। তারা মামলা না করায় পুলিশ বাদি হয়ে মামলা দায়ের করেছে। মামলা নিজস্বগতিতে চলবে। যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, সরকারের পক্ষ থেকে তাদের সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে। মনে রাখবেন, বাংলাদেশ অসামপ্রদায়িক চেতনার দেশ। এখানে সামপ্রদায়িক হতে দেয়া হবে না। ঘটনায় উসকানিদাতাদের আইনের আওতায় আনা হবে। বিশৃঙ্খলা রুখতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যবস্থা নেবে। 

তিনি আরও বলেন, এদেশে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের সমান অধিকার আছে। যা যুগের পর যুগ ধরে চলে আসছে। এই শান্তি যেনো কেউ নষ্ট না করতে পারে, সেজন্য সরকার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ন্ত্রণে গুরুত্ব দিচ্ছে। তারই অংশ হিসেবে নতুন নতুন আইন প্রণয়ন এবং মনিটরিংয়ের জন্য বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তারপরও কেউ কেউ ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে ধর্ম বা চেতনায় আঘাত করার চেষ্টা করছে। এ কারণে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোনো মন্তব্য করার আগে অবশ্যই সঠিকভাবে চিন্তা করতে হবে।

শাল্লা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নাজমুল হক বলেন, পুলিশ জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করার চেষ্টা করছে। বুধবার হামলার ঘটনার পর গ্রামে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। পুলিশের টহল দেখে বুধবার সন্ধ্যার পর থেকে গ্রামে ফিরতে থাকেন আতঙ্কিতরা।

পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান বলেন, পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত ওই গ্রামে পুলিশের টহল থাকবে। এই গ্রামের এক তরুণ মঙ্গলবার হেফাজতে ইসলামের নেতা মামুনুল হকের সমালোচনা করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন। তাতে মামুনুলের বিরুদ্ধে সামপ্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়ানো ও বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের বিরোধিতার অভিযোগ আনা হয়। ১৫ মার্চ শাল্লার পাশের দিরাইয়ে সমাবেশ করে হেফাজত। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করা মামুনুল ওই সমাবেশে বক্তব্য রাখেন। পরদিনই নোয়াগাঁও গ্রামের ওই তরুণের স্ট্যাটাসের স্ক্রিনশট ছড়িয়ে পড়ে। মঙ্গলবার রাত থেকেই ওই স্ট্যাটাস নিয়ে এলাকায় উত্তেজনা দেখা দেয়। এ ঘটনার প্রতিবাদে বুধবার সকালে এলাকায় বিক্ষোভের ঘোষণা দেয় হেফাজত। উত্তেজনা আঁচ করতে পেরে নোয়াগাঁও গ্রামবাসীর মধ্যে আতঙ্ক দেখা দেয়। তারা ফেসবুকে পোস্ট দেয়া তরুণকে মঙ্গলবার রাতেই পুলিশের হাতে তুলে দেন। বুধবার সকালে কয়েক হাজার মানুষ দা-লাঠিসহ নোয়াগাঁও গ্রামে মিছিল নিয়ে এসে ভাঙচুর করে ৮৭টি হিন্দু বাড়ি। এসব ঘর থেকে টাকাপয়সা-স্বর্ণালংকার নিয়ে যায় তারা। গ্রামবাসীর অভিযোগ, এমন উত্তেজনাকর পরিস্থিতি আর আতঙ্ক সত্ত্বেও ওই গ্রামের নিরাপত্তায় প্রশাসনের কোনো উদ্যোগ ছিলো না, ছিলো না পুলিশের বাড়তি নজরদারি। স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলেন, হেফাজত নেতাদের আশ্বাসে বিশ্বাস রেখে এলাকায় বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। তবে পুলিশ সব সময় সতর্ক ছিলো।

শাল্লা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আল-মুক্তাদির হোসেন বলেন, ফেসবুক স্ট্যাটাস ঘিরে মঙ্গলবার রাত থেকেই উত্তেজনা ছিলো। উত্তেজনার খবর পেয়ে রাতেই আমরা হেফাজতে ইসলামের নেতাদের সঙ্গে বসি। তখন তারা মিছিল না করার আশ্বাস দিয়েছিলেন। এমন আশ্বাসে পরিস্থিতি শান্ত হয়ে আসে। কিন্তু সকালে হঠাৎই মিছিল বের করে হামলা চালানো হয়। এ ঘটনায় কারা জড়িত, তা তদন্ত করে বের করা হবে।

একই দাবি করে শাল্লা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নাজমুল হক বলেন, আমরা রাতে হেফাজত নেতাদের সঙ্গে বসেছি। তারা মিছিল করবেন না কথা দিয়েছিলেন। সকালে আমরা বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে যখন পুষ্পস্তবক অর্পণ করছিলাম, তখনই মিছিলের খবর পাই। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে মিছিলকারীদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করে। কিন্তু কিছু লোক নদী সাঁতরে পার হয়ে বাড়িঘরে হামলা চালায়। তখন পুলিশের করার কিছু ছিলো না।

হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের স্থানীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী বলেন, রাতেই উত্তেজনা দেখা দিয়েছিল। সকালে কোনো দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, এমন আশঙ্কাও তৈরি হয়েছিল। তারপরও ওই গ্রামবাসীর নিরাপত্তায় পুলিশের আগাম ব্যবস্থা না নেয়া রহস্যজনক। পুলিশ তৎপর থাকলে এমন ঘটনা এড়ানো সম্ভব হতো।

এদিকে পুলিশ জানিয়েছে, গ্রামটিতে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের নিরাপত্তার জন্য পুলিশ এবং র‌্যাবের দুটি অস্থায়ী ক্যাম্প বসানো হয়েছে।

তবে সেখানকার জনপ্রতিনিধিরা বলেছেন, গ্রামের বাসিন্দাদের আতঙ্ক এখনো কাটেনি। সেখানে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে।

এ ঘটনায় সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, সুনামগঞ্জের হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামে হামলাকারীদের কোনো ছাড় দেয়া হবে না।

আমারসংবাদ/জেআই