Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪,

৫৬ জন ভুগছেন ৮৬ মিথ্যা মামলায়!

মার্চ ১৮, ২০২১, ০৯:১৫ পিএম


৫৬ জন ভুগছেন ৮৬ মিথ্যা মামলায়!
  • মিথ্যা মামলাকারীর শাস্তি নিশ্চিতে আইনের বিধান রয়েছে -ড. বশির উল্যাহ, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল
  • ভুয়া প্রমাণ হলে হাইকোর্ট চাইলে মামলাগুলো বাতিল করতে পারেন -অ্যাডভোকেট শিশির মনির
  • তদন্ত পর্যায়েও এসব মামলা থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব -ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ

নানা সামাজিক কাজ করেন প্রতিনিয়তই। শিক্ষা দিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে আলো ছড়াচ্ছেন। কখনো ওঠেনি অপরাধীর তালিকায় নাম। জীবদ্দশায় থানা পুলিশের ঝামেলায়ও জড়াননি। অতিতের পুলিশ রেকর্ডও ভালো। নেই অপরাধের সাথে কোনো সম্পৃক্ততাও। তবুও খেটেছেন জেল। আদালতে হাজিরা দিচ্ছেন প্রতি মাসেই। মামলাও শেষ হচ্ছে না। ১৩টি মিথ্যা মামলায় পড়ে জীবন যাওয়ার উপক্রম।

অপরাধ একটাই, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটিতে প্রার্থী হওয়া। ভুক্তভোগী চাঁদপুরের মাদ্রাসা শিক্ষকের নাম ইকবাল হোসেন। তার বিরুদ্ধে এসব মিথ্যা মামলার বাদি আজিজুল হক পাটোয়ারি। অর্থের বিনিময়ে ভাড়ায় মামলা করাই তার মূল পেশা। আজিজুলের মিথ্যা মামলার শিকার শুধু ইকবাল হোসেনই নন, দেশের বিভিন্ন আদালত এবং থানায় শতাধিক গায়েবি ও ভুয়া মামলা করে ৫৬ জন নিরপরাধ মানুষকে নিঃস্ব করে দিয়েছেন আজিজুল।

মামলার তথ্য গোপন রেখে আদালত ও থানা পুলিশের সহায়তায় নিরীহ মানুষকে গ্রেপ্তার ও জেল খাটানো ও পরবর্তীতে অর্থের বিনিময়ে সমঝোতা করাই আজিজুলের কাজ। আর এসব কাজে তাকে সহায়তা করেন প্রশাসনের কিছু অসাধু কর্মকর্তা। ভুক্তভোগীদের কারো বিরুদ্ধে ১০টি কারো বিরুদ্ধে সাতটি আবার কারো বিরুদ্ধে একের অধিক মামলা করেছেন আজিজুল। মামলার ফাঁদে পড়ে ও সীমাহীন হয়রানির শিকার হয়ে কেউ কেউ মৃত্যুবরণও করেছেন। অনুসন্ধান করে আজিজুলের করা এমন অন্তত ৮৫টি মামলার সন্ধান পাওয়া যায়। এসব মামলার শিকার অসহায় নিরাপরাধ ভুক্তভোগীদের কেউ জেল খেটেছেন, কেউ এখনো জেলে আছেন, কেউবা জামিন নিয়ে নিয়মিত আদালতে হাজিরা দিচ্ছেন। এদের সবার বাড়িই আবার চাঁদপুর জেলার শাহরাস্তি থানায়। আজিজুলের করা ৮৫টি মিথ্যা মামলার আসামি ও ঘটনা ভিন্ন হলেও সাক্ষী ঘুরেফিরে কয়েকজনই। কখনো তার ছেলে আবু ইউসুফ পাটোয়ারি, কখনো সহযোগী সোহান ও আরিফুল ইসলাম, ভগ্নিপতি সেলিম মিয়া, কখনো ছোট ভাই আলমগীর ও ভাতিজা জামাল। এই ছয়জনের মিথ্যা সাক্ষ্যতেই জেল খেটেছেন অনেকে। কারো আবার সাজাও হয়েছে। চারটি মিথ্যা মামলার শিকার মনোয়ারা বেগমের অভিযোগের ভিত্তিতে প্রতারক আজিজুল গ্রেপ্তার হলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে ৮৫ মিথ্যা মামলার মিথ্যা সাক্ষীরা।

আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দণ্ডবিধির ২১১ ধারা অনুযায়ী মিথ্যা মামলা করা একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কেউ যদি তার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা আদালতে মিথ্যা প্রমাণ করতে পারেন তাহলে বাদির বিরুদ্ধে ওই ধারায় মামলা করা যায়। আর ফৌজদারি কার্যবিধি ২৫০ ধারা অনুযায়ী মিথ্যা মামলায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণের আদেশ দিতে পারেন আদালত। কোনো পুলিশ কর্মকর্তা আমলযোগ্য নয় এ রকম কোনো মামলায় মিথ্যা প্রতিবেদন দিলে তার বিরুদ্ধেও এ ধারা অনুযায়ী ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণের আদেশ দিতে পারেন আদালত।

এমন অবস্থায় মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়ার ব্যাপারে আইনজীবীরা বলেছেন, ‘আসলে মিথ্যা মামলা এবং মিথ্যা সাক্ষ্য বতর্মান প্রেক্ষাপটে একটি মারাত্মক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। যার ফলাফল অনেক ভয়াবহ। মিথ্যা সাক্ষ্যদানকারীদের আইনের আওতায় এনে সঠিক শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে এই প্রবণতা অনেকটাই হ্রাস পাবে বলে মনে করেন তারা। দণ্ডবিধির ১৯৩ ধারা অনুযায়ী, যদি কোনো ব্যক্তি কোনো বিচারবিভাগীয় মোকদ্দমায় কোনো পর্যায়ে ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় তাহলে সেই ব্যক্তির যেকোনো মেয়াদের কারাদণ্ড হতে পারে, আবার সাত বছরের দণ্ড হতে পারে। কেউ যদি আবার অন্য কোনো মামলায় ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় তবে তার শাস্তি তিন বছরের কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ডও হতে পারে। ক্ষেত্রবিশেষ মৃত্যুদণ্ডও হতে পারে। অনুসন্ধানে জানা যায়, মামলাবাজ আজিজুল হক পাটোয়ারি তাঁতী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির ১ নম্বর সদস্য। শুধু এই নয়, প্রতারণার সময় মাঝে মধ্যে সাংবাদিক, কখনো প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্মকর্তা, কখনো নিজেকে পরিচয় দেন এমপি-মন্ত্রীর কাছের লোক হিসেবে। এডিট করে তৈরি করেছের প্রধানমন্ত্রীসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে সাক্ষাতের ছবিও। সারা দেশে আজিজের একটি মামলাবাজ সিন্ডিকেট রয়েছে, যারা ভুয়া ওয়ারেন্ট তৈরি, সরকারি কর্মকর্তাদের স্বাক্ষর জাল করে নামে-বেনামে বিভিন্ন থানায় মামলা করে। নারী নির্যাতন এবং মানবপাচার, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, লুটপাট ভয়-ভীতি প্রদর্শনসহ নারী পাচারকারী, ইয়াবা ব্যবসায়ী, দেহ-ব্যবসায়ীসহ নানা মিথ্য অভিযোগে মামলা করেন আজিজুল। বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের হয়ে ‘ভাড়ায়’ হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলা করাও আজিজুলের আয়ের উৎস। আর অপকর্মের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেন ‘গার্ডিয়ান বিডি নিউজ এবং দৈনিক আমার সংগ্রাম’ নামে দুটি নামসর্বস্ব পত্রিকাকে। এসব পোর্টাল ও দৈনিকে মিথ্যা, বানোয়াট ও মনগড়া সংবাদ পরিবেশন করে মানুষকে হয়রানি করে। আজিজের মিথ্যা মামলার অভিযোগ তদন্তকারী সরকারি কর্মকর্তারাও বাদ যাননি। তদন্ত মনোপুত না হলেই ছেলেকে দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দেন আজিজুল। চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক, জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা, জেলা পুলিশ সুপার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, শাহরাস্তি উপজেলার ইউএনও, উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, তৎকালীন ওসি শাহ আলমসহ অসংখ্য সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা ও বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ করে হয়রানিও করেছেন আজিজুল।

জানতে চাওয়া হলে ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট শিশির মনির আমার সংবাদকে বলেন, ‘প্রথমত কথা হলো— কেউ যদি কোনো নিরপরাধ মানুষের বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যমূলকভাবে মিথ্যা মামলা করে তাহলে ওই মামলায় নিরপরাধ ব্যক্তির যে সাজা হবে তখন যিনি মিথ্যা মামলাটি করেছেন তারও সেই একই সাজা হবে। দ্বিতীয় কথা হলো— মিথ্যা মামলার বিষয়টি যদি কাগজে-কলমে প্রমাণিত হয় তবে তার প্রতিকার চেয়ে উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন করা যেতে পারে এবং পিটিশনে সবগুলো মামলা একসাথে চ্যালেঞ্জ করা যেতে পারে, সে ক্ষেত্রে উচ্চ আদালত মামলাগুলো স্টে করে দিতে পারেন এবং মিথ্যা প্রমাণিত হলে উচ্চ আদালত সবগুলো মামলাই একসাথে কোয়াশ করে দিতে পারেন। তৃতীয়ত হলো— দেশের ইন্টিগ্রেটেড ক্রাইম ম্যানেজম্যান্ট সিস্টেম উন্নত করতে হবে। আর প্রতি থানায় একটি সফর্টওয়্যার আছে ওখানে সার্চ দিলেই বেরিয়ে আসে কোনো ব্যক্তির নামে একাধিক মামলা আছে কি-না। এখন প্রশ্ন হলো— এগুলো থাকতেও একই ব্যক্তির নামে এতগুলো মামলা কিভাবে হলো? মিথ্যা মামলার সাথে যদি প্রশাসনের কোনো ব্যক্তি জড়িত থাকে তবে তাদের বিরুদ্ধে কী পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘সত্যিকার অর্থে কোনো প্রশাসনের ব্যক্তি যদি এর সাথে জড়িত থাকে তবে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া যাবে।’

এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ড. বশির উল্যাহ আমার সংবাদকে বলেন, ‘যারা মিথ্যা মামলা করেন তাদের প্রতিহত ও শাস্তি নিশ্চিত করতে আইনের বিধান রয়েছে। যিনি মিথ্যা মামলা করেন তাকে আইনের আওতায় আনা গেলেই অন্যরাও মিথ্যা মামলা করা থেকে বিরত থাকবে এবং মিথ্যা মামলা করলে যে কঠিন সাজা ভোগ করেত হয় সে বিষয়ে একটা প্রচারণাও হয়ে যাবে।’

জানতে চাওয়া হলে বিশিষ্ট আইনজ্ঞ ও যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের সাবেক প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ আমার সংবাদকে বলেন, ‘মিথ্যা বা গায়েবি মামলার আইনগত প্রতিকারের বিধান সাধারণভাবে যেমন দণ্ডবিধিতে আছে, আবার বিশেষ কিছু আইনে আলাদাভাবে প্রটেকশন ক্লজও আছে। কিন্তু মামলা হয়ে গেলে হয়রানি থেকে মুক্তি নেই। কারণ যিনি এর শিকার তাকে আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে প্রমাণ করতে হবে যে, মামলাটি মিথ্যা অথবা তাকে মিথ্যা আসামি করা হয়েছে। এর আগে ওই মিথ্যা মামলায় তাকে হাজিরা দিতে হবে, আইনজীবী নিয়োগ করতে হবে। এমনকি আটক হয়ে কারাগারেও যেতে হতে পারে। মিথ্যা মামলা থেকে তদন্ত পর্যায়েও রেহাই পাওয়া যেতে পাবে। আর তা সম্ভব না হলে বিচারের মাধ্যমে রেহাই পেতে হবে। তবে এর বাইরে মিথ্যা মামলা বাতিলের জন্য উচ্চ আদালতেও আবেদন করা যায়। আদালত সন্তুষ্ট হলে মামলা স্থগিত বা বাতিল করতে পারেন।’

এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে বাংলাদেশ তাঁতী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি আলহাজ ইঞ্জিনিয়ার মো. শওকত আলী আমার সংবাদকে বলেন, ‘আজিজুলের বিষয়ে জানার পর আমি খুবই মর্মাহত হয়েছি। আজিজুল যে এমন বড় একজন প্রতারক তা আমাদের জানা ছিলো না। তার বিরুদ্ধে যে খবর শুনলাম তাতে আমরা নতুনভাবে জানলাম। আমরা জীবনে কোনোদিন এক টাকা ঘুষ খাইনি। এমন প্রতারকের জায়গা তাঁতী লীগে নেই। আমরা তার বিরুদ্ধে দলীয়ভাবে পদক্ষেপ নেবো এবং দ্রুত দল থেকে বহিষ্কার করা হবে। এমন ব্যক্তিকে বহিষ্কার না করলে তাঁতী লীগের দুর্নামের শেষ হবে না।’

আমারসংবাদ/জেআই