মার্চ ২০, ২০২১, ০৭:১০ পিএম
যুক্তিসঙ্গত কোনো কারণ ছাড়াই হু হু করে বেড়েই চলেছে নিত্যপণ্যের দাম। যেসব পণ্যের দাম বাড়ার কথা নয়, সেসব পণ্যের দামও বাড়ছে সকাল-বিকাল ব্যবধানে। বাজারে গিয়ে পছন্দের পণ্য চাহিদামতো কিনতে পারছেন না অনেকেই। আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সঙ্গতি রাখতে গিয়ে জরুরি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র না কিনেই ঘরে ফিরছেন কেউ কেউ। এক্ষেত্রে সরকারেরও যেনো কিছু করার নেই। শুধু ক্রেতা সাধারণই নয়, সরকারও যেনো হয়ে পড়েছে অসহায়। তাহলে নিত্যপণ্যের বাজার কার নিয়ন্ত্রণে— এমন প্রশ্ন প্রায় সব ক্রেতারই। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মহলে কথা বলে জানা যায়, সব কিছুর চাবিকাঠিই বাজার সিন্ডিকেটের হাতে। বাজার ব্যবস্থাপনায় যেনো সরকারকেও নিয়ন্ত্রণ করছে ওই সিন্ডিকেট— এমন অভিযোগও করছেন কেউ কেউ।
বাণিজ্যমন্ত্রী গত ফেব্রুয়ারিতে বলেছেন, ‘এক মাসের মধ্যে চালের বাজার স্বাভাবিক হয়ে যাবে।’ কিন্তু তার সেই বক্তব্যের মাস অতিক্রম করতে চললো, চালের দাম স্বাভাবিক তো দূরের কথা, আগের চেয়ে আরো বেড়েছে। মূলত সরকারকে বেকায়দায় ফেলে নিজেদের আখের গুছিয়ে নেয়ার জন্যই পরিকল্পিতভাবে দেশে চালের সংকট সৃষ্টি করছে একটি সিন্ডিকেট, যে সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে সময়মতো প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়— এমনটাই বলছেন অনেকে। এ সংক্রান্তে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুন্সীর মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
এদিকে প্রতি বছরই রোজার সময় যত কাছাকাছি হয়, নিত্যপণ্যের মূল্য তত বাড়তে থাকে। ক্রেতারা বলছেন, রোজা আসার প্রায় তিন মাস আগ থেকেই অসাধু ব্যবসায়ীরা কারসাজির পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। অবৈধভাবে বাড়ায় মজুত। সৃষ্টি করে কৃত্রিম সঙ্কট।
বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রতি বছর রমজান এলেই জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়। এমনকি কিছু পণ্যের দাম ক্রেতার নাগালের বাইরে চলে যায়। অসাধু ব্যবসায়ীরা যেনো ওঁৎপেতে থাকে এ মাসটির জন্য। এসব অসাধু ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে একাধিক বৈঠকও করে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো। কঠোর হুঁশিয়ারিও দেয়া হয়, নেয়া হয় নানা উদ্যোগও। কিন্তু অসাধু ব্যবসায়ীরা খুবই ধুরন্ধর, তারা সবসময়ই থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। সরকারের পক্ষ থেকে রোজায় বাজার নিয়ন্ত্রণের হাঁকডাক দেয়া হলেও বাজার অনিয়ন্ত্রিতই থাকে প্রতি বছর। বাজার নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ-প্রতিশ্রুতিগুলো কাগজে-কলমেই থেকে যায়।
বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, সর্বশেষ গত বছর রমজানে সরকারের পক্ষ থেকে ‘দাম বাড়বে না’— এমন প্রতিশ্রুতির পরও প্রতি কেজি ছোলা পাঁচ থেকে আট টাকা, মসুর ডাল ২০ থেকে ২৫ টাকা, পেঁয়াজ ১০ থেকে ১৫ টাকা, চিনি, পাঁচ থেকে ছয় টাকা, গরুর গোশত ৫০ থেকে ১০০ টাকা ও ব্রয়লার মুরগি কেজিতে ১০ টাকা বাড়তি দরে বিক্রি হয়েছে। এ ছাড়া ফল এবং সবজিও বেশি দামে বিক্রি হয়েছে। এবার আগামী ১৪ এপ্রিল পবিত্র রমজান শুরুর সম্ভাবনা রয়েছে। এরই মধ্যে নিত্যপণ্যের বাজার বেসামাল হতে শুরু করেছে। প্রতি বছরই রোজার আগে দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে বৈঠক করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এবার প্রতিমন্ত্রী আগে থেকেই বলেছেন, ‘পর্যাপ্ত মজুত আছে, রোজায় পণ্যের কোনো সঙ্কট দেখা দেবে না’। কিন্তু মন্ত্রীর এমন বক্তব্যের সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল খুঁজে পাচ্ছেন না ক্রেতা সাধারণ। পণ্যের মজুত পর্যাপ্ত থাকলে রোজার আগেই কেন বাজার এত অস্থিতিশীল? আর এ কারণেই রোজাকে কেন্দ্র করে সাধারণ মানুষের আশঙ্কা বাড়ছে।
এদিকে গত এক সপ্তাহে রাজধানীর বাজারগুলোতে তেল, চিনি, ডাল, আটা, ময়দাসহ ১০টি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়েছে বলে জানিয়েছে সরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)। যদিও বিপরীতে চাল, পেঁয়াজ, রসুন, আদাসহ সাতটি পণ্যের দাম কিছুটা কমেছে বলে দাবি সংস্থাটির। রাজধানীর শাহজাহানপুর, মালিবাগ, কারওয়ান বাজার, বাদামতলী, সূত্রাপুর, শ্যামবাজার, কচুক্ষেত বাজার, মৌলভীবাজার, মহাখালী বাজার, উত্তরা আজমপুর বাজার, রহমতগঞ্জ বাজার, রামপুরা এবং মিরপুর-১ নম্বর বাজারের পণ্যের দামের তথ্য নিয়ে শনিবার এরকম একটি প্রতিবেদন তৈরি করে টিসিবি। প্রতিষ্ঠানটির তথ্য অনুযায়ী, সপ্তাহের ব্যবধানে খোলা সয়াবিন তেলের দাম ৩ দশমিক ৩৮ শতাংশ বেড়ে প্রতি লিটার ১২০ থেকে ১২৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বোতলের এক লিটার সয়াবিন তেলের দাম ১ দশমিক ৮৯ শতাংশ বেড়ে ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা এবং বোতলের পাঁচ লিটার সয়াবিন তেলের দাম দশমিক ৮১ শতাংশ বেড়ে ৬১০ থেকে ৬৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। খোলা পাম অয়েলের দাম ৬ দশমিক ৮৩ শতাংশ বেড়ে ১০৭ থেকে ১১২ টাকা লিটারে বিক্রি হচ্ছে, যা এক সপ্তাহ আগে ছিলো ১০০ থেকে ১০৫ টাকা। আর ১০৫ থেকে ১১০ টাকা লিটার বিক্রি হওয়া সুপার পাম অয়েলের দাম বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১১২ থেকে ১১৫ টাকায়। এতে সপ্তাহের ব্যবধানে পণ্যটির দাম বেড়েছে ৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ। যদিও তেলের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বাজারের দোহাই দিয়েই দায় এড়ানোর চেষ্টা করছে সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার আগেই যে অভ্যন্তরীণ বাজারে অস্বাভাবিক হারে সয়াবিন তেলের দাম বেড়ে গেছে এবং তা কেন— সে প্রশ্নের কোনো উত্তর জানা নেই কারো।
দাম বাড়ার তালিকায় থাকা প্যাকেট আটার দাম গত এক সপ্তাহে ২ দশমিক ৯৯ শতাংশ বেড়ে প্রতি কেজি ৩৩ থেকে ৩৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। খোলা ময়দার দাম বেড়েছে ৪ দশমিক ২৯ শতাংশ। এতে এই পণ্যটির কেজি এখন বিক্রি হচ্ছে ৩৫ থেকে ৩৮ টাকায়। টিসিবি আরও জানিয়েছে, গত এক সপ্তাহে মাঝারি দানার মশুর ডালের দাম বেড়েছে ৬ দশমিক ২৫ শতাংশ। এতে এখন মাঝারি দানার মশুর ডালের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ৯০ টাকা। আমদানি করা আদার দাম এক সপ্তাহে ৫ দশমকি ৫৬ শতাংশ বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ১২০ টাকা কেজিতে। দাম বাড়ার তালিকায় আরও রয়েছে দেশি শুকনা মরিচ, লবঙ্গ, ব্রয়লার ও দেশি মুরগি, চিনি, গুঁড়া দুধ। দেশি শুকনা মরিচের দাম সপ্তাহের ব্যবধানে ৬ দশমিক ৮২ শতাংশ বেড়ে কেজি ১৯০ থেকে ২৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ৬ দশমিক ০৬ শতাংশ বেড়ে লবঙ্গের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৮০০ থেকে ৯৫০ টাকা। ব্রয়লার মুরগির দাম গত এক সপ্তাহে বেড়েছে ৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ। এতে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি এখন বিক্রি হচ্ছে ১৫০ থেকে ১৬৫ টাকায়। আর দেশি মুরগির দাম ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ বেড়ে প্রতি কেজি ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
দীর্ঘদিন ধরে ভোগানো চিনির দাম গত এক সপ্তাহে আরও বেড়েছে বলে জানিয়েছে টিসিবি। প্রতিষ্ঠানটির তথ্য অনুযায়ী, এক সপ্তাহে ২ দশমিক ২২ শতাংশ বেড়ে চিনির কেজি বিক্রি হচ্ছে ৬৮ থেকে ৭০ টাকা। এর সঙ্গে ডানো গুঁড়া দুধের দাম দশমিক ৮১ শতাংশ বেড়ে ৬১০ থেকে ৬৩০ টাকা এবং মার্কস গুঁড়া দুধ দশমিক ৮৯ শতাংশ বেড়ে কেজি ৫৬০ থেকে ৫৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এদিকে ৫২ থেকে ৫৮ টাকা কেজি বিক্রি হওয়া মাঝারি মানের পাজাম ও লতা চালের দাম গত এক সপ্তাহে ৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ কমে ৫০ থেকে ৫৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে বলে জানিয়েছে টিসিবি। মাঝারি মানের চালের সঙ্গে কমেছে মোটা চালের দামও। মোটা চালের দাম ৪ দশমিক ১৭ শতাংশ কমে ৪৪ থেকে ৪৮ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে, যা এক সপ্তাহ আগে ছিলো ৪৬ থেকে ৫০ টাকা। চালের পাশাপাশি গত এক সপ্তাহে কমেছে দেশি পেঁয়াজ, দেশি ও আমদানি করা রসুন, দেশি আদা, ধনে ও তেজপাতার দাম। এর মধ্যে সব থেকে বেশি কমেছে পেঁয়াজের দাম। মানভেদে দেশি পেঁয়াজের কেজি ৩৫ থেকে ৪০ টাকা বিক্রি হচ্ছে বলে জানিয়েছে টিসিবি। টিসিবির তথ্য অনুযায়ী, গত এক সপ্তাহে দেশি রসুনের দাম কমেছে ১৫ দশমিক ৩৮ শতাংশ। এতে প্রতি কেজি দেশি রসুন বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ টাকা, যা আগে ছিলো ৬০ থেকে ৭০ টাকা। আর আমদানি করা রসুনের দাম ১২ শতাংশ কমে কেজি বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১২০ টাকা, যা আগে ছিলো ১১০ থেকে ১৪০ টাকা।
এছাড়া দেশি আদার দাম ১১ দশমকি ১১ শতাংশ কমে কেজি ৬০ থেকে ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা আগে ছিলো ৮০ থেকে ১০০ টাকা। আমদানি করা শুকনা মরিচের দাম কমেছে ৫ দশমিক ৭৭ শতাংশ। এতে প্রতি কেজি আমদানি করা শুকনা মরিচ বিক্রি হচ্ছে ২৩০ থেকে ২৬০ টাকার মধ্যে, যা আগে ছিলো ২৪০ থেকে ২৮০ টাকা। ধনের দাম ৭ দশমিক ৬৯ শতাংশ কমে প্রতি কেজি ১০০ থেকে ১৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর তেজপাতার ১৮ দশমিক ১৮ শতাংশ দাম কমে কেজি বিক্রি হচ্ছে ১২০ থেকে ১৫০ টাকায়।
নিত্যপণসহ জীবন যাপনের নানা দিকের ব্যয় অব্যাহতভাবে বাড়লেও সেই হারে আয় মোটেই বাড়েনি বরং বলা চলে, করোনায় গত এক বছরে অধিকাংশ মানুষেরই আয় কমেছে ব্যাপকভাবে। পণ্যের বাজারে শক্তিশালী সিন্ডিকেটের কারণেই দাম বাড়ছে বলে জানা থাকলেও সবারই প্রশ্ন, এই সিন্ডিকেট কেন ভাঙছে না সরকার? নাকি ভাঙতে পারছে না, কার শক্তি বেশি? সিন্ডিকেটের নাকি সরকারের— এমন প্রশ্নই এখন ভোক্তাদের মুখে মুখে।
এদিকে আসন্ন রমজানকে কেন্দ্র করে ইতোমধ্যেই মজুত বাড়াচ্ছে অসাধু চক্র। বিশেষ করে রমজান সংশ্লিষ্ট পণ্যগুলোর বেশি মজুত করছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। রোজায় বেশি দামে বিক্রি করাই এ চক্রের টার্গেট। অথচ সরকার যতই বৈঠক করছে, বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখার কথা বলছে বাস্তবে তা দেখা যাচ্ছে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজার সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার দায়িত্ব যাদের তারাই যখন ব্যবসায়ী হয় তখন ক্রেতাদের কপালে কি থাকে তা নতুন করে বলার কিছু থাকে না। সময়ে সময়ে সরকারি দপ্তর পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দিলেও বাস্তবে তা কার্যকর হতে দেখা যায় না খুব একটা। বরং ক্ষেত্রেবিশেষে দাম নির্ধারণের বিষয়টি ব্যবসায়ীদের পক্ষেই যায় বলে মনে করছেন কেউ কেউ।
গত এক যুগে পণ্যের বাজারে যা কিছু হয়েছে সেগুলো ভোক্তারা অনেক কষ্টে কোনো না কোনোভাবে সামাল দিতে সক্ষম হলেও বর্তমানে কিছুতেই পেরে উঠছেন না। প্রত্যেক অপরিহার্য পণ্যের দামই হু হু করে বাড়ছে। অন্যদিকে গত এক বছরে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা অনেক কমে গেছে। অনেকে হঠাৎ বেকার হয়ে পড়েছেন, আবার অনেকের আয়, এমনকি নির্ধারিত বেতন-ভাতাও কমে যাওয়ার নজির সৃষ্টি হয়েছে ব্যাপকভাবে। যা অতীতে কখনো কল্পনাই করা যেত না। তেমন একটা পরিস্থিতিতে ক্রেতাদের ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দেখা দিয়েছে পণ্যমূল্যের এই অস্বাভাবিক বৃদ্ধি। বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষ পড়েছেন চরম বিপাকে। চাকরি চলে যাওয়া বা আয় কমে যাওয়া মধ্যবিত্তের এখন অনেকটা মরণদশা বলা যায়।
আমারসংবাদ/জেআই