Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪,

অপ্রতিরোধ্য গতিতে সংক্রমণ

মাহমুদুল হাসান

মার্চ ২৩, ২০২১, ০৮:২৫ পিএম


অপ্রতিরোধ্য গতিতে সংক্রমণ
  • করোনা সংক্রমণ বাড়লেও মানুষ সতর্ক হচ্ছে না; কেউই স্বাস্থ্যবিধি মানছে না -জাহিদ মালেক, মন্ত্রী, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়
  • করোনা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণের জন্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিকল্প নেই -অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা, অতিরিক্ত মহাপরিচালক, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর
  • করোনা নিয়ন্ত্রণে মাস্কসহ স্বাস্থ্যবিধি মানাতে প্রয়োজনে কঠোর হতে হবে -ডা. মো. মুশতাক হোসেন, সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, আইইডিসিআর

করোনা সংক্রমণ শনাক্তের বছর পেরিয়েছে। ইতোমধ্যেই দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে। শনাক্ত-মৃতের সূচক ঊর্ধ্বমুখী। গত এক সপ্তাহে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। এক সপ্তাহ পূর্বে যেখানে এক হাজার ৮৬৫ জন রোগী শনাক্ত হয়েছিল, সেখানে এক সপ্তাহের ব্যবধানে গতকাল তিন হাজার ৫৫৪ জনের নমুনায় করোনা শনাক্ত হয়েছে। গত আট মাসের মধ্যে গতকাল সর্বোচ্চ রোগী শনাক্ত হলো।

এর আগে গত বছরের ১৬ জুলাই তিন হাজার ৭৩৩ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছিল। গেলো মাসের শেষ সপ্তাহেও দেশে করোনা শনাক্তের হার ৩ শতাংশের নিচে নেমেছিল। তিন সপ্তাহের ব্যবধানে সংক্রমণ ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে সংক্রমণ বৃদ্ধির সূচক। একদিনে শনাক্তের হার বেড়ে ১৩ দশমিক ৬৯ শতাংশ হয়েছে।

চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তিন কারণে করোনা সংক্রমণ ফের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। সেগুলো হলো, দেশের অধিকাংশ মানুষ স্বাস্থ্যবিধি অমান্য করে চলছে। যুক্তরাজ্যে নতুন ধরনের দ্রুত ছড়িয়ে পড়া করোনা এদেশেও ছড়িয়ে পড়ছে। স্বাভাবিক সময়ের মতো দেশজুড়ে বিয়ে-শাদি, আচার অনুষ্ঠান ও পর্যটনকেন্দ্রে ঘুরে বেড়ানোর প্রবণতা বেড়েছে। এসব ছাড়াও টিকায় আগ্রহ না থাকাকেও অনেকে দায়ী করেছেন।

সম্প্রতি করোনা সংক্রমণ বেড়েছে বলে স্বীকার করে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বিশ্বজুড়ে করোনা সংক্রমণ ফের বেড়েছে। বাংলাদেশ তার বাইরে নয়। ফলে এখানেও সংক্রমণ কিছুটা বেড়েছে। তবে স্বাস্থ্যবিধি অমান্য করে চলাফেরার কারণে নিয়ন্ত্রণে থাকা করোনা মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে করোনা সংক্রমণ বাড়লেও এখনো দেশে ফের লকডাউন জারি করার কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এখন পর্যন্ত স্বাস্থ্যবিধিতে জোর দেয়া হচ্ছে। মাস্ক পরিধান করানো, টিকা গ্রহণে উৎসাহিত করা এবং লোকসমাগম এড়িয়ে চলতে নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে। এসব নির্দেশনা কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হলে অল্প সময়ে করোনা নিয়ন্ত্রণে এসে পড়বে। নয়তো সংক্রমণ ভয়াবহতার দিকে যেতে পারে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন্স অ্যান্ড কন্ট্রোল রুমের সর্বশেষ তথ্যমতে, গতকাল রাজধানীসহ সারা দেশের ২১৯টি ল্যাবে ২৫ হাজার ৯৫৪টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এতে নতুন করে আরও তিন হাজার ৫৫৪ ব্যক্তির নমুনায় করোনার উপস্থিতি মিলেছে। এ সময় সুস্থ হয়ে উঠেছে আরও এক হাজার ৮৩৫ জন। এ সময় অন্তত ১৮ জনের মৃত্যুও হয়েছে করোনায়। এ পর্যন্ত দেশে ৪৪ লাখ ৬০ হাজার ১৮৪টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এতে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে পাঁচ লাখ ৭৭ হাজার ২৪১ জনে ঠেকেছে। তার মধ্যে সুস্থ হয়ে উঠেছে পাঁচ লাখ ২৫ হাজার ৯৯৪ জন। আর মৃতের সংখ্যা বেড়ে হলো আট হাজার ৭৩৮ জন। গতকাল শনাক্তের হার ১৩ দশমিক ৬৯ শতাংশ। এ পর্যন্ত মোট শনাক্তের হার ১২ দশমিক ৯৪ শতাংশ। সুস্থতার হার ৯১ দশমিক ১২ শতাংশ এবং মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৫১ শতাংশ।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অপর এক বার্তায় টিকা বিষয়ে জানানো হয়, দেশে ৯০ লাখ ডোজ করোনার টিকা রয়েছে। এ পর্যন্ত ৬৩ লাখ ৭৮ হাজার ৬২৭ জন মানুষ করোনা ভাইরাসের প্রতিষেধক অক্সফোর্ড অ্যাষ্ট্রাজেনেকার কোভিশিল্ড টিকার জন্য আবেদন করেছেন। তার মধ্যে ৪৯ লাখ ৯০ হাজার ২৩২ জনকে টিকা প্রদান করা হয়েছে। এক্ষেত্রে মাত্র ৯২০ জনের শরীরে মৃদু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেছে। টিকায় আগের চেয়ে আগ্রহ কমে আসছে। গতকাল মাত্র ৭৮ হাজার ৩৩০ জন মানুষ করোনার টিকা গ্রহণ করেছে।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মো. মুশতাক হোসেন বলেন, করোনা সংক্রমণ কিন্তু আজ থেকে নয় বেশ কিছুদিন ধরেই বাড়ছে। কিন্তু এর আগে বিষয়টি কেউ গুরুত্ব দেয়নি। টেস্টও করায়নি। গত নভেম্বরে যখন করোনা সংক্রমণ স্থিতিশীলতা থেকে বাড়তে শুরু করে সেটি প্রথমে তরুণ-যুবক থেকে পরিবারের ঝুঁকিপূর্ণ বয়সের মানুষ সংক্রমিত হয়েছে। তরুণরা যখন বাইরে থেকে সংক্রমিত হয়ে ভাইরাসটি বাড়িতে নিয়ে গিয়েছে তখন কিন্তু তারা শনাক্তকরণ টেস্ট করায়নি। যখনই বয়স্করা সংক্রমিত হয়েছে, তখন নমুনা পরীক্ষার পর এখন শনাক্ত-মৃতের হার বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেকে আবার করোনার টিকা নিয়ে স্বাস্থ্যবিধি ভুলে গেছে। এজন্য করোনা সংক্রমণ বাড়তে শুরু করেছে। পরিত্রাণ পেতে হলে আগেও বলেছি মাস্ক পরিধানসহ স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মানতে হবে। প্রয়োজনে সরকারকে কঠোর হতে হবে। সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সহায়তা চালু করতে হবে। শনাক্ত পরিবারটির পাশে সমাজকে দাঁড়াতে হবে। অভয় দিতে হবে যাতে তিনি চাকরি হারানোর ভয়ে সংক্রমিত হয়েও তথ্য না লুকায়। সেই সাথে টিকাদানে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। এছাড়া করোনা সংক্রমণ এখন নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, করোনা সংক্রমণ সারা পৃথিবীতে ঊর্ধ্বগতি দেখা দিচ্ছে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশেও করোনা সংক্রমণ বাড়ছে। এই রকম সংক্রমণ নভেম্বর-ডিসেম্বরেও ছিলো। তখনো আমাদের সবকিছু চলেছিল। করোনা কখনোই কিন্তু কোনো বয়সের জন্য সীমাবদ্ধ ছিলো না। আমরা শুরু থেকেই বলেছি এই ভাইরাস ছোট-বড়, নারী-পুরুষ সবার মধ্যে সংক্রমণ করতে পারে। যে যতবেশি সংক্রমণের সংস্পর্শে আসবে তার ততবেশি সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এক্ষেত্রে বয়স কোনো বিষয় নয়। চারদিকে তাকালে দেখবেন সব বয়সের মানুষ বাইরে বেরিয়ে আসছে, সংক্রমিত হচ্ছে। ইউকে ভ্যারিয়েন্ট কিছু কিছু পাওয়া যাচ্ছে। সংক্রমণ বাড়ার পেছনে ডেফিনেটলি ইউকে ভ্যারিয়েন্ট কিছুটা প্রভাব রাখছে। ইউকে ভ্যারিয়েন্ট যতটা নির্ভর করে তারচেয়ে বেশি নির্ভর করে আমরা আমাদের জীবন আচরণ কিভাবে পরিচালনা করছি। তিনি বলেন, করোনা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে গত এক বছরের বেশি সময় ধরে আমরা প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি নির্দেশনায় কাজ করছি। শুরু থেকেই সরকারের প্রতিটি দপ্তরের সমন্বয়ে করোনা নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়েছে। এক্ষেত্রে আমরা সবার সাথে আমাদের কাজের পরিকল্পনা শেয়ার করেছি। এ বিষয়টাও আমাদের মাথায় রাখতে হয়, আপনারা জানেন, জীবন ও জীবিকার মধ্যে সমন্বয় রেখেই করোনা নিয়ন্ত্রণে রাখতে কাজ করতে হয়। তারই পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্যবিধি মানানোর বিষয়ে কঠোরভাবে জোর দিচ্ছি। মনে রাখতে হবে, করোনা নিয়ন্ত্রণের জন্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিকল্প নেই। মাস্ক পরতে হবে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হবে। ঘনঘন হাত ধোয়ার যে অভ্যাস করেছিলাম আমরা সেই অভ্যাসকে আবার পুনরায় চর্চা করে করোনাকে প্রতিরোধ করতে হবে এবং করোনাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। তিনি আরও বলেন, আমাদের জন্য ভালো দিক আমাদের হাতে পর্যাপ্ত টিকা মজুদ রয়েছে। এই টিকাদান কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, গত কয়েকদিন ধরে দেশে করোনার সংক্রমণ বেড়ে গেছে। সংক্রমণ ২ থেকে ১০ শতাংশের ওপর উঠেছে। দেশে করোনা সংক্রমণ বাড়লেও মানুষ সতর্ক হচ্ছে না। কেউই স্বাস্থ্যবিধি মানছে না। বিয়ের অনুষ্ঠানে যাচ্ছে, কক্সবাজার, বান্দরবান বেড়াতে যাচ্ছে। আমরা খোঁজ নিয়ে জেনেছি, গত ১৫ দিনে কক্সবাজারে প্রায় ২৫ লাখ মানুষ ভ্রমণ করেছেন। এদের কেউই স্বাস্থ্যবিধি মানেনি, মাস্ক ব্যবহার করেনি। ফলে বেশির ভাগ সংক্রমণ বাড়ছে যারা বেড়াতে, ঘুরতে গিয়েছিল তাদের। যারা সমুদ্র সৈকতে মাস্ক ছাড়া ঘুরেছিল, তারাই করোনা আক্রান্ত হচ্ছে। আপনারা নিজের জন্য, পরিবারের জন্য, দেশের জন্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে কাজ করবেন। সুস্থ থাকবেন, ভালো থাকবেন।

আমারসংবাদ/জেআই