Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪,

৫০ শতাংশও ঋণ দেয়নি দেশের ১৮টি ব্যাংক

জাহাঙ্গীর আলম

মার্চ ২৪, ২০২১, ০৭:৫৫ পিএম


৫০ শতাংশও ঋণ দেয়নি দেশের ১৮টি ব্যাংক

করোনার ধাক্কা সামলাতে সরকার বড় ব্যবসায়ীদের মতো ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্যও গত এপ্রিলে কম সুদে ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে। অর্থনীতিবিদরাও ওই প্রণোদনায় গুরুত্ব দিয়েছেন। তারপরও অনেক ব্যাংক আশানুরূপ আগ্রহ দেখায়নি। বাধ্য হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক কয়েকবার সময় বাড়িয়ে মার্চেই পুরো ঋণ বিতরণের নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু শেষ সময়েও ১৮টি ব্যাংক ৫০ শতাংশ ঋণ দেয়নি।

লক্ষ্যমাত্রার ৬৪ শতাংশ বিতরণ করেছে চুক্তিবদ্ধ ৫৫টি ব্যাংক। মহিলা উদ্যোক্তাদের পাঁচ শতাংশ দেয়ার নির্দেশ থাকলেও দিয়েছে ৭০৯ কোটি টাকা। তবে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিতরণ করেছে অগ্রণী ব্যাংক। এরপর বিতরণ করেছে সোনালী ব্যাংক ও রাকাব প্রায় ৯৭ শতাংশ। আর বেসরকারি ব্যাংকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিতরণ করেছে ইসলামী ব্যাংক, দেড় হাজার কোটি টাকারও বেশি। এরপরই ব্র্যাক ব্যাংক প্রায় সাড়ে ১৩শ কোটি টাকা ও ইউসিবিএল ৭৫৮ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানা গেছে।

প্রণোদনার অগ্রগতির ব্যাপারে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম আমার সংবাদকে বলেন, ‘ঘণ্টায় তিন মাইল বেগে হাটলেও বাঘে তাড়া দিলে গতি অটোমেটিক বেড়ে যায়। কাজেই ব্যাংকগুলো যতই পিছিয়ে থাকুক বাংলাদেশ ব্যাংক যে নির্দেশ দিয়েছে নির্ধারত সময়ে পুরো প্যাকেজের ঋণ বিতরণ করতেই হবে। এখনো সময় বাকি আছে। কাজেই আশা করি সব ব্যাংকই তাদের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী উদ্যোক্তাদের ঋণ দেবে। লক্ষ্যমাত্রা থেকে অনেক পিছিয়ে থাকার কারণ জানতেই চাইলে জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও আব্দুছ ছালাম আজাদ আমার সংবাদকে বলেন, ‘হ্যাঁ, বিভিন্ন কারণে প্রণোদনা প্যাকেজের ঋণ বিতরণে অনেক পিছিয়ে আছি। তবে এগোনোর চেষ্টা করা হচ্ছে। এখনো সময় বাকি আছে। আশা করি টার্গেট পূরণ করতে পারবো।’  

সূত্র মতে, গত বছরের অপ্রত্যাশিত করোনার অভিঘাত মহামারিতে নেতিবাচক প্রভাব থেকে বাংলাদেশও রক্ষা পায়নি। ১৮ মার্চে করোনায় দেশে প্রথম মারা গেলে সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে জনগণকে ঘরে থাকতে বলে। এতে লাখ লাখ মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ে। ব্যবসা-বাণিজ্যও বন্ধ হয়ে যায়। গত পাঁচ বছরের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) গড় প্রবৃদ্ধি ছিলো ৭.৪ শতাংশ। করোনার আগে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা বেড়ে ৮.১৫ শতাংশ হয়েছিল। কিন্তু করোনার ধাক্কায় রেকর্ড করা জিডিপির প্রবৃদ্ধি মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে গত অর্থবছরে ৫ দশমিক ২৪ শতাংশে নেমে গেছে। এমন পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে তথা কোভিড-১৯-এর সঙ্কটময় পরিস্থিতির ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য এপ্রিল থেকে একের পর এই ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে ২৩টি প্যাকেজে এক লাখ ২১ হাজার ৩৫৩ কোটি টাকার ঋণ, নগদ অর্থ ও খাদ্য সহায়তা ঘোষণা করেছেন। এসব প্যাকেজ বাস্তবায়নে বাংলাদেশ ব্যাংক জারি করে বিভিন্ন সার্কুলার। যাতে ব্যাংকগুলো ঋণ দেয়। এতে বড় বড় ঋণ প্যকেজ সহজেই বিতরণ করে ব্যাংকগুলো।

কিন্তু করোনা সংকটে সবচেয়ে বেশি এসএমই খাত ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পুনরুজ্জীবিতকরণের লক্ষ্যে সিএমএসএমই শিল্প উদ্যোক্তাদের জন্যও ২০২০ সালের ৫ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গুরুত্ব দিয়ে ২০ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করেন। তা কার্যকর করতে বাংলাদেশ ব্যাংক সার্কুলার জারি করে। ৫৫টি ব্যাংকের সাথে চুক্তি করে লক্ষ্যমাত্রাও বেঁধে দেয়া হয়। ৯ শতাংশ সুদের মধ্যে সরকার ভর্তুকি দেবে ৫ শতাংশ এবং গ্রাহককে সুদ দিতে হবে ৪ শতাংশ। একই সাথে এই প্যাকেজের আওতায় মহিলা উদ্যোক্তাদের জন্য ৫ শতাংশ অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়েছে।

গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা করতে অর্থমন্ত্রণালয়ে কর্মশালায় অর্থনীতিবিদরাও বলেছেন, করোনায় তৃণমূলের ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় তাদের জন্য প্রণোদনা প্যাকেজ দেয়া উচিত।

বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান মো. সিরাজুল ইসলামও সম্প্রতি বলেছেন, দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের বিকল্প নেই। কারণ তারাই অর্থনীতির প্রাণ। তাই তাদের সহজে ঋণ প্রাপ্তির ব্যবস্থা করে দিতে হবে। প্রয়োজনে এ সম্পর্কিত আইনও প্রণয়ন করা যেতে পারে বলে জানান তিনি। তাদের বক্তব্যকে আমলে নিয়ে সরকার সম্প্রতি চার শতাংশ সুদে দুই হাজার ৭০০ কোটি টাকা ঋণ প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। এসএমই ফাউন্ডেশন ও বিসিককে প্রণোদনা কার্যকর করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। কারণ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের স্বার্থে কাজ করে এই দুই প্রতিষ্ঠান। কিন্তু কটেজ, মাইক্রো, স্মল অ্যান্ড মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজ (সিএমএমএমই) খাতে ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনার মধ্যে ডিসেম্বর পর্যন্ত ১১ হাজার কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে ব্যাংকগুলো। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারাই অর্থনীতিতে বেশি অবদান রাখায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক চাপ দেয়ার সাথে ঋণ নিশ্চয়তা স্কিম (ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম) গঠনসহ নানা উদ্যোগও গ্রহণ করেছে। ঋণ দেয়ার বিভিন্ন শর্তও শিথিল করে। তারপরও ২১ জানুয়ারি পর্যন্ত ১১ হাজার ৫৬৫ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ হয়েছে। যারা নির্ধারিত লক্ষ্য পূরণ করতে পারেনি, বাংলাদেশ ব্যাংক আবার তিন মাস বাড়িয়ে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। যা মার্চে শেষ হচ্ছে।

সূত্র জানায়, নির্ধারিত সময় শেষ হয়ে এলেও এ পর্যন্ত ৫৫টি ব্যাংক ১২ হাজার ৮০৩ কোটি টাকা বা লক্ষ্যমাত্রার ৬৪ শতাংশ ঋণ বিতরণ করেছে। ৮৩ হাজার ৭৬০ জন উদ্যোক্তাকে এসব ঋণ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১৮টি ব্যাংক ৫০ শতাংশও বিতরণ করেনি। জনতা ব্যাংক ৮৭১ কোটি টাকার লক্ষ্য নিয়ে ৫৮৯ জন গ্রাহকের কাছে বিতরণ করেছে ১০৩ কোটি টাকা বা মাত্র ১১ দশমিক ৮৪ শতাংশ। বিদেশি হাবিব ব্যাংক চার কোটির মধ্যে একজনকে এক কোটি টাকা বা ২৫ শতাংশ বিরতণ করেছে। উরি ব্যাংক ছয় কোটির মধ্যে দুই জনকে দুই কোটি ১০ লাখ টাকা বা ৩৫ শতাংশ ঋণ দিয়েছে। সিলন ৩৫ কোটির মধ্যে ৭২ জনকে প্রায় ১৬ কোটি টাকা ৪৫ শতাংশ ঋণ দিয়েছে।  বেসরকারি ব্যাংকের মধ্যে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক ৫০ কোটি টাকার মধ্যে ৭৮ গ্রাহককে ১৫ কোটি ২৬ লাখ টাকা, আইএফআইসি ২৩৫ কোটি টাকার মধ্যে ৩৪৮ গ্রাহককে মাত্র ৫২ কোটি টাকা বা প্রায় ২২ শতাংশ ঋণ দিয়েছে। মেঘনা ব্যাংক ৪০ কোটি টাকার মধ্যে ৩১ গ্রাহককে সাড়ে ১৪ কোটি টাকা বা ৩৬ শতাংশ, ন্যাশনাল ব্যাংক ৪০০ কোটির মধ্যে ৭৩৭ জনকে ১৫৯ কোটি বা প্রায় ৪০ শতাংশ, এনসিসি ৪৭০ কোটিতে ৫৩১ জনকে ১২৪ কোটি বা ২৬ শতাংশ, এনআরবি ১৩০ কোটিতে ৪৫ কোটি টাকা বা ৩৫ শতাংশ দিয়েছে ২০৬ জনকে। এছাড়া গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক সাড়ে ২৪ কোটির মধ্যে ৪০ জনকে মাত্র ৬ দশমিক ৫৬ কোটি টাকা বা প্রায় ২৭ শতাংশ, পূবালী ব্যাংক ৬০০ কোটির মধ্যে এক হাজার ৭০ জনকে ১৯২ কোটি টাকা বা প্রায় ৩২ শতাংশ, সাউথ বাংলা ২০০ কোটির মধ্যে ৩৪৪ জনকে ৮৮ কোটি টাকা বা ৪৪ শতাংশ ঋণ দিয়েছে। স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক ২৪০ কোটির মধ্যে ৫৯৮ জনকে ৮৪ কোটি বা ৩৫ শতাংশ, সীমান্ত ব্যাংক ৫০ লাখ টাকার মধ্যে একজনকে দুই লাখ টাকা বা ৪ শতাংশ ঋণ দিয়েছে। 

এছাড়া ইসলামী ব্যাংকের মধ্যে সিবিআইবিএল ২০ কোটির মধ্যে ছয়জনকে মাত্র ৫০ লাখ বা আড়াই শতাংশ, এফএসআইবিএল ২৫০ কোটির মধ্যে ৩০১ জনকে ৪৬ কোটি টাকা বা সাড়ে ১৮ শতাংশ এবং আল আরাফা হাজার কোটি টাকার বিপরীতে এক হাজার ৪৭০ জনকে ৩১৮ কোটি টাকা বা প্রায় ৩২ শতাংশ ঋণ দিয়েছে। আবার মহিলা উদ্যোক্তাদের মোট ঋণের অর্থাৎ ২০ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ৫ শতাংশ হিসেবে এক হাজার কোটি টাকা ঋণ দেয়ার কথা। কিন্তু ব্যাংকগুলো পাঁচ হাজার একজন উদ্যোক্তাকে ঋণ দিয়েছে ৭০৮ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। 

আমারসংবাদ/জেআই