Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪,

স্বাধীনতার ৫০ বছরে ঈর্ষণীয় পর্যায়ে বাংলাদেশ পুলিশের আধুনিকায়ন

নুর মোহাম্মদ মিঠু

মার্চ ২৫, ২০২১, ০৮:১৫ পিএম


স্বাধীনতার ৫০ বছরে ঈর্ষণীয় পর্যায়ে বাংলাদেশ পুলিশের আধুনিকায়ন

মহান স্বাধীনতা দিবস। বাঙালি জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবময় দিন। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তারও আগে ৭ মার্চের ভাষণে প্রস্তুত জাতি মুহূর্তমাত্র বিলম্ব না করে ঝাঁপিয়ে পড়ে শত্রু সেনাদের প্রতিরোধে। সেই রাতে রাজারবাগ, পিলখানায় অবস্থানরত পুলিশবাহিনীর বীর সদস্যরা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অস্ত্র তুলে নেন বিভিন্ন সেনানিবাসে থাকা সৈনিকরাও। মুক্তিরমন্ত্রে উজ্জীবিত জাতি হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে ৯ মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ শেষে বিজয় ছিনিয়ে আনে। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করে। বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায় বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র।

দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও স্বাধীনতাবিরোধী ষড়যন্ত্র থেমে থাকেনি। ষড়যন্ত্রকারীরা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে। একাত্তরের ঘাতকরা ফিরে আসে রাষ্ট্রক্ষমতায়। দেশকে আবার পাকিস্তানি ভাবধারায় ফিরিয়ে নেয়ার এবং ইতিহাস বিকৃতির চেষ্টা চলতে থাকে। কিন্তু তারা সফল হতে পারেনি। বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্ব আজ একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার হচ্ছে। সব ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে দেশ ক্রমেই এগিয়ে চলেছে অর্থনৈতিক মুক্তির পথে। ২০১৫ সালে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০১৮ সালে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। দারিদ্র্যবিমোচন, শিক্ষার প্রসার, নারী উন্নয়ন, শিশুমৃত্যুর হার কমানো ইত্যাদি ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য রয়েছে দেশের। স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে উন্নয়শীল দেশের কাতারে শামিল হতে যাচ্ছে দেশ। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল তৈরিসহ নানা মেগা  প্রকল্প চলমান। করোনার থাবায় সারাবিশ্বের অর্থনীতি লণ্ডভণ্ড হয়ে গেলেও বাংলাদেশ করোনা মোকাবিলায় ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ টিকবাদানকারী দেশের তালিকায় প্রথমসারিতে নাম লিখিয়েছে। নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছে অতিমারী করোনায় মৃত্যুর হার। করোনাযুদ্ধে বাংলাদেশ পুলিশের ভূমিকা অবিস্মরণীয়। জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিলেও এর উত্থান ঠেকিয়ে রাখতে সফলতার জানান দিয়েছে পুলিশ। এর মূলে রয়েছে পুলিশ-জনতার ঐক্য। সবমিলিয়েই স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশ পুলিশের আধুনিকায়ন পৌঁছেছে ঈর্ষণীয় পর্যায়ে। একসময়ে মেট্রোপুলিশে সাইকেলে ডিউটির যে প্রচলন ছিলো, সেটিতে এখন আধুনিক গাড়ি ছাড়াও যুক্ত হচ্ছে হেলিকপ্টার। এনালগ পদ্ধতিতে আসামি ধরার প্রথা পরিবর্তন হয়ে এখন ডিজিটাইলাজড প্রদ্ধতির প্রচলন হয়েছে। অপরাধীদের সমস্ত বিবরণ বেরিয়ে আসছে আঙ্গুলের ছাপে। এককথায় পরিবর্তনের হাওয়ায় বাংলাদেশ পুলিশ এখন আধুনিক পুলিশ। বিশ্বের উন্নত দেশের ন্যায় বাংলাদেশ পুলিশও সব ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায়ও পৌঁছেছে এক অনন্য উচ্চতায়। ধারণা করা হচ্ছে, আধুনিকায়নের আরও যেসব প্রস্তাব রয়েছে সেগুলোর বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশ পুলিশ আরও উচ্চতায় পৌঁছাবে।

সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ দমন, দেশের অভ্যন্তরীণ সার্বিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ছাড়াও নানামুখী দায়িত্ব পালন করতে হয় পুলিশকে। গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ, মামলা নেয়া, তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা, বিচার প্রক্রিয়ার সহায়তা, ভিআইপি নিরাপত্তা ও প্রটোকল দিতে হয় এই বাহিনীকেই। দিন যত যাচ্ছে এই বাহিনীর কাজের পরিধিও তত বাড়ছে। দেশের মানুষের জন্য পুলিশি সেবা নিশ্চিত করতেও বাহিনীটিতে গড়ে উঠছে নতুন নতুন ইউনিট।

সংশ্লিষ্টরা জানান, একসময় পুলিশ সদর দপ্তর, স্পেশাল ব্রাঞ্চ (এসবি), পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), সারদা পুলিশ একাডেমিসহ কয়েকটি ট্রেনিং সেন্টার, বিভাগ মহানগর, জেলা ও থানা ইউনিট ছাড়া আর কোনো ইউনিট ছিলো না। বর্তমানে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব), পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই), অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিট ও ট্রাফিকসহ অনেকগুলো বড় ইউনিট রয়েছে পুলিশ বাহিনীতে। নতুন করে যোগ হচ্ছে মেডিকেল, শিক্ষা ইউনিট,  এয়ার উইংসহ আরও একাধিক ইউনিট। সবমিলিয়ে এখন পুলিশ বাহিনীতে ইউনিট রয়েছে ১৭৭টি। রয়েছে হাইওয়ে, রেলওয়ে, ইন্ডাস্ট্রিয়াল, নৌ, ট্যুরিস্ট, পুলিশ, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) ও স্পেশাল পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এসপিবিএন)।

জানা যায়, বর্তমানে এই বাহিনীর সদস্য সংখ্যা প্রায় সোয়া দুই লাখ। তথ্যপ্রযুক্তির যুগে সাইবার অপরাধ দমনে পুলিশের সারা দেশের ইউনিটগুলোতে রয়েছে সাইবার সেকশনও। আলাদাভাবে সাইবার থানা করারও পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। বিমানবন্দরকেন্দ্রিক গঠন করা হয়েছে পুলিশের আলাদা ইউনিট। সর্বত্রই সফলতা অর্জনে প্রশিক্ষণের কোনো বিকল্প নেই। যে কারণে পুলিশের কনস্টেবল থেকে শুরু করে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সবাইকে নিয়মিত প্রশিক্ষণে অংশ নিতে হচ্ছে। সারা দেশেই অনেকগুলো ট্রেনিং সেন্টার রয়েছে। দেশের বাইরে গিয়েও প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন পুলিশ সদস্যরা। একইসঙ্গে জঙ্গিবাদ দমনের সফলতা জানাতে ইউরোপসহ বিশ্বের অনেক দেশের আমন্ত্রণে বাংলাদেশ পুলিশের কর্মকর্তাদের নিয়মিত সেসব দেশে যেতেও হচ্ছে। মানুষকে তাৎক্ষণিক সেবা দিতে করা হয়েছে ‘৯৯৯’ নামের ন্যাশনাল ইমার্জেন্সি সার্ভিস। পুলিশ সদরদপ্তরসহ প্রত্যেকটি ইউনিটে ফেসবুক পেজ খুলে সাধারণ ভুক্তোভোগী মানুষের কাছ থেকে অভিযোগ গ্রহণ করে দ্রুত সেবা নিশ্চিত করছে পুলিশ। অসংখ্য ভুক্তভোগী পুলিশের এ দুটি মাধ্যমের সহযোগিতা নিয়ে আশানুরূপ সেবা নিচ্ছেন। রয়েছে ডিবি পুলিশ হেল্প লাইন নামের অ্যাপসও। জঙ্গি দমনের জন্য দ্রুত অ্যাকশনে যেতে রয়েছে সোয়াত নামে পুলিশের আলাদা ইউনিট।

আন্তর্জাতিক পুলিশি সংস্থা ইন্টারপোল-এর সদস্য বাংলাদেশ পুলিশ। পুলিশ সদরদপ্তরে ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো নামে ইন্টারপোল সংক্রান্ত কাজ করে এই ইউনিট। বিভিন্ন দেশে পালিয়ে থাকা দেশের দাগি সন্ত্রাসীদের ধরতে এই শাখা নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছে। পুলিশে এখন অত্যাধুনিক ফরেনসিক বিভাগ, মানি লন্ডারিং, মানবপাচার, কল ডায়ালিং রেকর্ড (সিডিআর) সেকশন রয়েছে। ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে একেবারেই ক্লু লেস অনেক চাঞ্চল্যকর ঘটনার রহস্য উদঘাটন করতে সক্ষম হয়েছে পুলিশ।

পুলিশ সদরদপ্তরে নবীন পুলিশ কর্মকর্তাদের এক অনুষ্ঠানে আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদ বলেছেন, উন্নয়নের অন্যতম প্রধান শর্ত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকা। পুলিশ আইনশৃঙ্খলা রক্ষার মাধ্যমে দেশে শান্তি বজায় রাখার জন্য নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। ফলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হচ্ছে। দেশে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস দমনে বাংলাদেশ পুলিশ এখন বিশ্বে রোল মডেল। জঙ্গিবাদ দমনে জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থন ও সহযোগিতা থাকায় আমরা সফল হয়েছি। তিনি আরও বলেন, জনগণের সঙ্গে অসদাচরণ করা থেকে বেরিয়ে আসতে চাই। পেশীশক্তি নয়, ব্যবহার করতে হবে আইনি সক্ষমতা। জনগণের কল্যাণে কাজ করার অপার সুযোগ রয়েছে পুলিশের। পুলিশ হতে পারে হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা ও সোস্যাল লিডার। তিনি বলেন, পুলিশের কাছে জনগণের প্রত্যাশা বেশি। সমাজের চাহিদা বেশি। জনগণ, সমাজ, মিডিয়া প্রতিনিয়ত পুলিশকে ওয়াচ করে। জনগণের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

ট্যাকটিক্যাল বেল্টে পুলিশ : ঢাকা ও চট্টগ্রামে ১০ হাজার পুলিশ এখন ‘ট্যাকটিক্যাল বেল্ট’ পরে ডিউটি করেন। গত ১৬ ডিসেম্বর থেকে উন্নত দেশের পুলিশ যেমন ট্যাকটিক্যাল বেল্ট পরে ডিউটি করেন ঠিক একই নিয়মে প্রাথমিকপর্যায়ে ঢাকা ও চট্টগ্রামে ১০ হাজার পুলিশ একইভাবে ডিউটি করছেন। ট্যাকটিকেল বেল্ট সংযোজন পুলিশের ইতিহাসে এক অনন্য ঘটনা। বছরের পর বছর ধরে পুলিশের মাঠপর্যায়ের সদস্যদের এভাবে দায়িত্ব পালন করতে দেখে সবাই অভ্যস্ত। তবে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা রাইফেল বয়ে বেড়ানোর অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে ট্যাকটিক্যাল বেল্ট সংযোজনের ফলে। পুলিশ সদর দপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ট্যাকটিক্যাল বেল্টের মূল স্লোগান হলো ‘হ্যান্ডস ফ্রি পুলিশিং’ মানে হাত খালি রাখা। এতে বড় অস্ত্র বহনের ঝক্কিঝামেলা আর থাকবে না। এতে পুলিশের কাজের গতি আসবে, মনোবলও বাড়বে। একই সঙ্গে পুলিশকে দেখতে আরও আধুনিক ও যুগোপযোগী মনে হবে।

যুক্ত হচ্ছে হেলিকপ্টার : এদিকে জননিরাপত্তা বিধানে পুলিশের দক্ষতা ও সক্ষমতা আরও বাড়াতে বাংলাদেশ পুলিশে যুক্ত হচ্ছে দুটি অত্যাধুনিক হেলিকপ্টার। হেলিকপ্টার দুটি গভর্নমেন্ট টু গভর্নমেন্ট (জি টু জি) পদ্ধতিতে রাশিয়া থেকে কেনার জন্য ১০ ফেব্রুয়ারি পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের বাংলাদেশ পুলিশ এবং হেলিকপ্টার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান জেএসসি রাশিয়ান হেলিকপ্টারর্সের মধ্যে সমঝোতা স্বাক্ষর সই হয়। পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদ এবং জেএসসি রাশিয়ান হেলিকপ্টারর্সের মহাপরিচালক আন্দ্রে আই. ভোগেনিস্কি ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সমঝোতা স্মারকে সই করেন।

যোগ হচ্ছে আরও তিনটি নতুন ইউনিট : যুগের চাহিদায় নিত্যনতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে পুলিশবাহিনী। দিনবদলের সঙ্গে বাড়ছে কাজের পরিধি। জননিরাপত্তায় ও সেবা বাড়াতে আধুনিক ও জনবান্ধব পুলিশবাহিনী গড়ে তুলছে সরকার। যুগের চাহিদায় পুলিশে যোগ হচ্ছে আরও তিনটি নতুন ইউনিট। তিন পার্বত্য জেলার জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তায় নতুন করে যোগ হচ্ছে মাউন্টেন ব্যাটালিয়ন। একইভাবে পুলিশবাহিনীতে মেডিকেল শিক্ষা ও এয়ার উইং নামের আরও দুটি ইউনিট গঠন করা হচ্ছে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এসব ব্যাটালিয়ন গঠনের নির্দেশনা পেয়ে পুলিশ সদর দপ্তর কাজ করছে বলে জানায় সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো।

পুলিশের ঊর্ধ্বতন একাধিক কর্মকর্তা জানান, দেশের মানুষের জন্য পুলিশি সেবা আরও বাড়াতে ও পুরো দেশকে নিরাপত্তার জালে আনতে বাহিনীতে যোগ হচ্ছে নতুন নতুন ইউনিট। এর সঙ্গে নতুন যোগ হবে মাউন্টেন ইউনিট, মেডিকেল শিক্ষা ইউনিট ও এয়ার ইউনিট। এজন্য ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রোফাইল (ডিপিপি) ও অর্গানোগ্রাম তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। এসব তৈরির পর পুলিশ সদর দপ্তর থেকে পাঠানো হবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। একই সূত্র জানায়, পুলিশবাহিনীতে নতুন ইউনিটগুলো গঠনে কয়েক হাজার কোটি টাকা খরচ হবে। পুলিশের দক্ষতা ও সক্ষমতা আরও বাড়ানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।

শান্তিরক্ষায় বাংলাদেশ পুলিশের অবদান : বিশ্বে শান্তিরক্ষায় বাংলাদেশ পুলিশ অনন্য ভূমিকা পালন করে আসছে। ১৯৮৯ সাল থেকে জাতিসংঘ মিশনে বাংলাদেশ পুলিশ এ অবদান রেখে চলেছে। বহির্বিশ্বে সেবা ও শান্তিরক্ষায় এ অবদান কেবল বাংলাদেশ পুলিশের ভাবমূর্তি নয়, দেশের সুনাম বৃদ্ধির অন্যতম অংশীদার হিসেবেও ভূমিকা রাখছে। বর্তমানে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত বিভিন্ন দেশের শান্তি মিশনে তারা সুনামের সাথে কাজ করছেন। এ শান্তি মিশনে অংশগ্রহণকারীরা নীল হেলমেট পরিহিত থাকেন। বর্তমানে বিশ্বের পাঁচটি দেশে বাংলাদেশ পুলিশ শান্তিরক্ষায় অবদান রাখছে। পুলিশের এক হাজার ১১০ সদস্য পাঁচটি দেশে সাতটি ফর্মড ইউনিটের (এফপিইউ) মাধ্যমে শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে নিয়োজিত। পুলিশের সদস্য ইউএন পুলিশের সুদান, হাইতি, দারফুর, সোমালিয়া, লাইবেরিয়াতে কাজ করছে। এছাড়া পুলিশ সদস্যরা সেকেন্ডম্যান হিসেবে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে ও বিভিন্ন ফিল্ড মিশনে কর্মরত। লাইবেরিয়া মিশনে বাংলাদেশ পুলিশ অংশগ্রহণ করে বাংলাদেশের সুনামকে অক্ষুণ্ন রেখেছে। বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী সদস্য ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা এ মিশনে রয়েছেন। সেখানে বাংলাদেশের পুলিশ কেবল শান্তিরক্ষা বাহিনীই নয় বরং বন্ধু-অভিভাবক হিসেবে উপনীত হয়েছে। ফলে সুশৃঙ্খল, উদ্যোগী ও সদ্ব্যবহারের জন্য লাইবেরিয়ানদের কাছে বাংলাদেশ পুলিশ অত্যন্ত প্রিয় এবং আস্থাভাজন হিসেবে স্বীকৃত। কেবল তা-ই নয়, মিশনে কর্মরত বিশ্বের সমগ্র অঞ্চলের নাগরিকদের কাছেও বাংলাদেশ পুলিশের আচরণ ও বন্ধুসুলভ ব্যবহার প্রশংসিত। লাইবেরিয়া একটি উন্মুক্ত ও খোলামেলা সমাজ হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের পুলিশ সদস্যদের সুশৃঙ্খল, সংযম ও সদাচরণের জন্য কোনো ধরনের প্রলোভন তাদের আকৃষ্ট করতে পারেনি। ফলে তারা নিজেদের ও পুলিশ বাহিনীর তথা বাংলাদেশের সুনাম অক্ষুণ্ন রাখতে সক্ষম হয়েছেন।

স্বাধীনতার ৫০ বছরে সেরা অর্জন শান্তিরক্ষায় শীর্ষে বাংলাদেশ

একসময় যেসব দেশের সাধারণ মানুষ ‘বাংলাদেশ’ শব্দটির সঙ্গেই পরিচিত ছিলো না, সেসব দেশে আজ বাংলাদেশ হয়ে উঠেছে অতি প্রিয় একটি দেশ। হাইতি থেকে পূর্ব তিমুর, লেবানন থেকে ডিআর কঙ্গো পর্যন্ত বিশ্বের সব সংঘাতপূর্ণ এলাকায় জনমনে শ্রদ্ধার স্থান করে নিয়েছেন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীর মজ্জা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশের অন্যতম সেরা অর্জন জাতিসংঘ মিশনে শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ হিসেবে শীর্ষ অবস্থান ধরে রাখা। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশের গর্বিত অংশীদারিত্বের মধ্য দিয়েই পরিচিতি বেড়েছে বাঙালি ও বাংলা ভাষার। ধর্ম-বর্ণ-গোত্র, রাজনৈতিক মতাদর্শ ও আঞ্চলিক বৈষম্য পেছনে ফেলে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা নিজেদের উৎসর্গ করেছেন বিশ্বমানবতার সেবায়। পেশাগত দক্ষতা, নিরপেক্ষতা, সততা ও মানবিক আচরণের কারণে আজ ওইসব দেশের মানুষের কাছে অনুকরণীয় দৃষ্টান্তও হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা।

শান্তিরক্ষা মিশনে অবদান রাখা দেশগুলোর অবস্থান সম্পর্কে জাতিসংঘের ‘ডিপার্টমেন্ট অব পিসকিপিং অপারেশন্স’ প্রতিবেদন অনুসারে, গত ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত সর্বোচ্চ সেনা প্রেরণকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান ছিলো সবার শীর্ষে। অন্য দেশগুলোর মধ্যে রুয়ান্ডা দ্বিতীয়, ইথিওপিয়া তৃতীয়, নেপাল চতুর্থ, ভারত পঞ্চম এবং পাকিস্তান ষষ্ঠ স্থানে অবস্থান করছিল। ২০২০ সালের আগস্ট মাস থেকে বাংলাদেশ এক্ষেত্রে তার শীর্ষ অবস্থান ধরে রেখেছে। এর আগের মাসগুলো এবং অন্যান্য বছরেও বাংলাদেশ কখনো প্রথম আবার কখনো দ্বিতীয় স্থান ধরে রাখতে সক্ষম হয়। ২০১১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৩ সালের এপ্রিল মাসের শেষ দিন পর্যন্ত ২৮ মাসের মধ্যে ২০ মাসই শীর্ষে ছিলো বাংলাদেশ। মিশনে বাংলাদেশি সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে ছয়জন ফোর্স কমান্ডার ও সাতজন ডেপুটি ফোর্স কমান্ডার সাফল্যের সঙ্গে দায়িত্ব পালনেরও গৌরব অর্জন করেন। নভেম্বর মাসের শেষ দিন পর্যন্ত বিশ্বের আটটি সংকটাপন্ন দেশে এবং জাতিসংঘ সদর দপ্তরে মোট ছয় হাজার ৭৩০ জন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। এদের মধ্যে পুলিশ সদস্য ৬৫০ জন। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এই সংখ্যা বর্তমানেও প্রায় অপরিবর্তিত। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে আইএসপিআর জানায়, সেনাবাহিনীর পাঁচ হাজার ২৮১ জন সদস্য শান্তিরক্ষা মিশনে দায়িত্ব পালন করছেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এক্ষেত্রে রোল মডেল স্বীকৃত। আড়াই যুগের বেশি সময় ধরে বিশ্বের ৪০টি দেশের ৫৪টি মিশনে শান্তিরক্ষায় অনন্য ভূমিকা রেখে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা দেশের গৌরব বাড়িয়েছেন। একই সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও ব্যাপক অবদান রেখেছেন তারা। ঝুঁকিপূর্ণ এই কাজে গত বছরের মে মাস পর্যন্ত জীবন দিতে হয়েছে ১৫৩ জনকে। আহত হয়েছেন ২২৯ জন। এর মধ্যে সেনাবাহিনীর সদস্য ২১৯ জন। নিহতদের তালিকায় রয়েছেন সেনাবাহিনীর ১২২ জন, নৌবাহিনীর চারজন, বিমানবাহিনীর পাঁচজন এবং পুলিশের ২২ জন। আইএসপিআরের তথ্য অনুসারে, ১৯৮৯ সালে ইরাক-ইরানে সামরিক পর্যবেক্ষক হিসেবে ১৫ জন বাংলাদেশির দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ শুরু হয়। এরপর গত আড়াই যুগে প্রায় এক লাখ ৭১ হাজার বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী বিভিন্ন দেশে এই দায়িত্ব পালন করেছেন। এ সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে।

বাংলাদেশ নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী এই মিশনে দায়িত্ব পালন করে আসছে ১৯৯৩ সাল থেকে। বাংলাদেশের পুলিশ সদস্যরা এই মিশনে অংশ নিচ্ছেন ১৯৮৯ সাল থেকে। দেশের প্রায় দুই হাজার নারী শান্তিরক্ষী এরই মধ্যে বিভিন্ন সংঘাতপূর্ণ দেশে সাফল্যের সঙ্গে তাদের দায়িত্ব পালন সম্পন্ন করেছেন। বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশি নারী শান্তিরক্ষীদের অংশগ্রহণও ক্রমেই বাড়ছে। বর্তমানে বাংলাদেশের ২৭০ জন নারী জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে দায়িত্ব পালন করছেন। এদের মধ্যে রয়েছেন সেনাবাহিনীর ৫১ জন নারী কর্মকর্তা এবং অন্যান্য পদবির সৈনিক ৬৭ জন, নৌবাহিনীর ছয়জন নারী কর্মকর্তা এবং বিমানবাহিনীর ১১ জন নারী কর্মকর্তা। মুসলিমপ্রধান দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশই সর্বপ্রথম ২০১০ সালে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে পুলিশের নারী দল পাঠায়।

বাংলাদেশি সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে যে ছয়জন জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে দায়িত্ব পালন করেছেন তার মধ্যে একজন অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল ফজলে এলাহী আকবর। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে আমাদের অংশ নেয়ার কারণে বাংলাদেশ, বাঙালি ও বাংলা ভাষা অনেক দেশে পরিচিত হয়েছে এবং মর্যাদা পেয়েছে। বাংলাদেশ যদি স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত না হতো তাহলে এই কৃতিত্ব অর্জন সম্ভব হতো না। পাকিস্তান নামের একটি রাষ্ট্রে এটি বাঙালিদের নিজস্ব পরিচয়ের বাইরে সীমিত অংশগ্রহণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যেতো।’ তিনি আরো বলেন, ‘শান্তিরক্ষা মিশনে সাফল্যের মূলে রয়েছে আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর শৃঙ্খলা, দক্ষতা, দায়িত্ববোধ, মানবিক আচরণ ও যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতার নীতি। পার্বত্য চট্টগ্রামে দীর্ঘদিন ধৈর্যের সঙ্গে দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতাও এক্ষেত্রে সহায়ক হয়েছে’ বলে বলছেন তিনি।

আমারসংবাদ/জেআই