Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪,

ভেঙেছে অতীতের সব রেকর্ড

মাহমুদুল হাসান

মার্চ ৩০, ২০২১, ০৮:২৫ পিএম


ভেঙেছে অতীতের সব রেকর্ড
  • করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের তাণ্ডব দেশজুড়ে
  • ভাইরাসের গতিবিধি বোঝা যাচ্ছে না
  • ধারণার বাইরে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে
  • প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ বেশি প্রয়োজন

ফের করোনায় কাবু দেশ। গ্রীষ্মের উষ্ণতা বৃদ্ধির পর থেকেই সূচক ঊর্ধ্বমুখী। দ্বিতীয় ঢেউয়ের তাণ্ডবে ভেঙেছে অতীত রেকর্ড। দীর্ঘ সময় ধরে সংক্রমণে একদিনে সর্বোচ্চ চার হাজার রোগী শনাক্ত হয়েছে। কিন্তু গেলো দুদিনে সে রেকর্ড ভেঙে পাঁচ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। ২ শতাংশের নিচে নেমে আসা শনাক্তের হার এখন ১৯ শতাংশে ঠেকেছে, আরও বাড়তে পারে। ভাইরাসের গতিবিধি বোঝা যাচ্ছে না। গেলো সপ্তাহের ব্যবধানে শনাক্ত রোগী বেড়েছে প্রায় দেড় হাজার। মৃত্যুও দ্বিগুণ হয়েছে।

উপসর্গবিহীন রোগী বেশি শনাক্ত হচ্ছে। তরুণসহ এখন সব বয়সি রোগীর অবস্থা বেশ সংকটাপন্ন হচ্ছে। নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে (আইসিইউ) বেড সংকট দেখা দিচ্ছে। রাজধানীর ১০টি সরকারি কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালে গতকাল বিকেল পর্যন্ত সর্বশেষ চারটি আইসিইউ বেড ফাঁকা ছিল। শুধু রাজধানী নয়, এ চিত্র সারা দেশের। গ্রীষ্মের উষ্ণতা বৃদ্ধির সাথে সাথে সংক্রমণ বেড়ে চলায় বিশেষজ্ঞরাও বিচলিত। ধারণার বাইরে অপ্রতিরোধ্য গতিতে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে। সাধারণ করোনার চেয়ে নতুন ধারার ভাইরাসটি বেশ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ধারণা করা হচ্ছে, সম্প্রতি দেশে নতুন ধরনের করোনা (যুক্তরাজ্য ও আফ্রিকায় শনাক্ত হওয়া নতুন করোনা) ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। ফলে উপসর্গ না থাকলেও অস্বাভাবিকভাবে রোগী বাড়ছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল কর্তারা জানিয়েছেন, করোনা মোকাবিলায় গত এক বছরের অভিজ্ঞতার আলোকে সব ধরনের প্রস্তুতি নেয়া আছে। আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসাসেবা প্রদানে কোনো ঘাটতি নেই। তবে করোনা মোকাবিলায় প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ বেশি প্রয়োজন। করোনা সব বয়সি মানুষকে আক্রান্ত করতে পারে। তাই সবাইকে সতর্কতার সঙ্গে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারকে কঠোর হতেও তারা পরামর্শ দিয়েছেন। শুধু স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললেই অর্ধেক করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব বলে জানিয়েছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গত এক সপ্তাহের প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গতকাল মঙ্গলবার পাঁচ হাজার ৪২ জনের নমুনায় করোনার উপস্থিতি মিলেছে। এ সময় ৪৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। তার আগের দিন আরও পাঁচ হাজার ১৮১ জনের নমুনায় করোনা ধরা পড়ে। সেদিনও গতকালের মতো ৪৫ জনের মৃত্যু হয়। গত ২৮ মার্চ তিন হাজার ৯০৮ জনের নমুনায় করোনা শনাক্ত হয়। সেদিন মৃত্যু হয় অন্তত ৩৫ জনের। ২৭ মার্চ তিন হাজার ৬৭৪ জনের নমুনায় করোনা শনাক্ত ও ৩৯ জনের প্রাণ কেড়ে নেয়। ২৬ মার্চ তিন হাজার ৭৩৭ জনের করোনা শনাক্ত হয়। মৃত্যু হয় আরও ৩৩ জনের। এর আগের দিন তিন হাজার ৫৮৭ জনের করোনা ধরা পড়ে। প্রাণ যায় আরও ৩৪ জনের এবং গত ২৪ মার্চ তিন হাজার ৫৬৭ জনের শরীরে করোনা শনাক্ত হয়, মারা যায় ২৫ জন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন্স অ্যান্ড কন্ট্রোল রুমের সর্বশেষ তথ্যমতে, দেশের তিন আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর, দুই সমুদ্র বন্দর ও বিভিন্ন সীমন্তবর্তী স্থলবন্দর হয়ে গতকাল মঙ্গলবার ছয় হাজার ৪০২ জন মানুষ দেশে প্রবেশ করেছে। তার মধ্যে পাঁচ হাজার ৬১৫ জন বিমানবন্দর হয়ে, ৫৫৬ জন বিভিন্ন স্থলবন্দর ও ২৩১ জন দুই সমুদ্রবন্দর হয়ে প্রবেশ করেছেন। তাদের সবাইকে স্ক্রিনিং করা হয়েছে। এ পর্যন্ত ১৯ লাখ ৯৩ হাজার ৯৯২ জনকে স্ক্রিনিং করা হয়েছে। গতকাল আরও এক হাজার ৫২০ জনকে কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হয়েছে। একই সময়ে ছাড়পত্র মিলেছে ৭৯০ জনের। এ পর্যন্ত কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হয়েছে ছয় লাখ ৪৮ হাজার ৮০৯ জনকে। একই সময়ে ছাড়পত্র মিলেছে আরও ছয় লাখ ১২ হাজার ২৪৪ জনের। বর্তমানে রয়েছে আরও অন্তত ৩৬ হাজার ৫৬৫ জন। এছাড়াও গতকাল ৩৫৭ জনকে আইসোলেশনে পাঠানো হয়েছে।

প্রতিষ্ঠানটি আরও জানায়, রাজধানীসহ সারা দেশে সরকারি-বেসরকারি কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালে ৯ হাজার ৮৫৫টি সাধারণ বেড রয়েছে। তারমধ্যে তিন হাজার ৭৬২টি বেডে রোগী ভর্তি রয়েছে। খালি আছে আরও ছয় হাজার ৯৩টি। তবে আইসিইউ বেডে রয়েছে সংকট। সারা দেশে ৫৭৮টি আইসিইউ বেড রয়েছে। তারমধ্যে ৩৫৮টি বেডে রোগী ভর্তি রয়েছে। ফাঁকা আছে ২২০টি। ঢাকার ১০ সরকারি হাসপাতালে ১০৮টি আইসিইউ বেড রয়েছে। তারমধ্যে মাত্র দুই হাসপাতালে চারটি আইসিইউ ফাঁকা রয়েছে। এ নিয়ে রাজধানীর সরকারি-বেসরকারি কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালে ২৯৬টি আইসিইউ বেড রয়েছে। তার মধ্যে ২৪৮টি বেডে রোগী ভর্তি রয়েছে। মাত্র ৪৮টি আইসিইউ বেড ফাঁকা রয়েছে।

সক্ষমতার কথা জানাতে গিয়ে প্রতিষ্ঠানটি জানায়, সারা দেশে ১৩ হাজার ৪৬২টি অক্সিজেন সিলিন্ডার রয়েছে। হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা আছে ৯৮০টি এবং অক্সিজেন কনসেনট্রেটর আছে আরও ৮২৮টি। গতকাল পর্যন্ত দেশের ৬৭ লাখ ৫৭ হাজার ৮৬৯ জন ব্যক্তি করোনা সংক্রমণ প্রতিষেধক অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার কোভিশিল্ড টিকার জন্য নিবন্ধন করেছেন। গতকাল দুপুর পর্যন্ত ৫৩ লাখ ১৯ হাজার ৬৭৯ জন টিকা গ্রহণ করেছেন।

সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের (সিএমএসডি) পরিচালক আবু হেনা মোরশেদ জামান অভয় দিয়ে বলেন, করোনা ভাইরাসের প্রকোপ সারা দেশেই বেড়েছে। কেন্দ্রীয় ঔষধাগারে পর্যাপ্ত পরিমাণ আইসিইউ বেড, হাইফ্লো-ন্যাজাল ক্যানোলা, ভেন্টিলেটর, পিপিই, সার্জিক্যাল গ্লাভস, স্যানিটাইজারসহ সব ধরনের উপকরণ মজুদ রয়েছে। যখনই হাসপাতালগুলো চাচ্ছে, তখনই আমরা সেগুলো সরবরাহ করছি। আগামী এক বছরও যদি করোনার প্রকোপ অব্যাহত থাকে, আমরা তা মোকাবিলা করতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত। কেন্দ্রীয় ঔষধাগার এ কাজ থেকে পিছপা হবে না।

করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শ কমিটির অন্যতম সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘করোনার বর্তমান সংক্রমণটা দেখে আমরা ভাবছিলাম এটা অত বাড়বে না। কারণ আমাদের দেশে একটা অংশ টিকা নিয়েছে। অ্যান্টিবডি ডেভেলপ করেছে। কিন্তু এখন আমরা চিন্তা করছি যে, ভাইরাস নিয়ম কানুন না মেনে শুধু বেড়েই চলেছে। এটার কারণটা কি? হয়তো যে অ্যান্টিবডি ডেভেলপ করেছে সে অ্যান্টিবডিগুলা নিউটালজিং নয়। এটা একটা হতে পারে। আরেকটা হয় তো আমাদের দেশে যে মানুষজনের চলাচল, আচার-ব্যবহার সবগুলোই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে সহায়তা করেছে। সে জন্য আজ এই অবস্থা। তিনি বলেন, সচেতনতার বিকল্প নেই। এখন সচেতনতাই পারে মুক্তি দিতে। সরকার অলরেডি এ বিষয়ে বার্তা দিয়েছে। এখন আমরা বলবো যে, খালি বার্তা দিলেই হবে না, এটা কঠোরভাবে কার্যকর করতে হবে।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, ‘করোনার সংক্রমণ সারা পৃথিবীতে ঊর্ধ্বগতি দেখা দিচ্ছে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশেও করোনা সংক্রমণ বাড়ছে। আমরা শুরু থেকেই বলেছি এই ভাইরাস ছোট-বড়, নারী-পুরুষ সবার মধ্যে সংক্রমণ করতে পারে। যে যত বেশি সংক্রমণের সংস্পর্শে আসবে তার তত বেশি সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এক্ষেত্রে বয়স কোনো বিষয় নয়। চারদিকে তাকালে দেখবেন সব বয়সের মানুষ বাইরে বেরিয়ে আসছে, সংক্রমিত হচ্ছে। ইউকে ভ্যারিয়েন্ট কিছু কিছু পাওয়া যাচ্ছে। সংক্রমণ বাড়ার পেছনে ডেফিনেটলি ইউকে ভ্যারিয়েন্ট কিছুটা প্রভাব রাখছে। ইউকে ভ্যারিয়েন্ট যতটা নির্ভর করে তার চেয়ে বেশি নির্ভর করে আমরা আমাদের জীবনাচরণ কিভাবে পরিচালনা করছি।’ তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্যবিধি মানানোর বিষয়ে কঠোরভাবে জোর দিচ্ছি। মনে রাখতে হবে, করোনা নিয়ন্ত্রণের জন্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিকল্প নেই। মাস্ক পরতে হবে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হবে। ঘনঘন হাত ধোয়ার যে অভ্যাস করেছিলাম আমরা, সেই অভ্যাসকে আবার পুনরায় চর্চা করে করোনাকে প্রতিরোধ করতে হবে এবং করোনাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।’

আমারসংবাদ/জেআই