Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪,

ফের ভাড়া নৈরাজ্যের শঙ্কা

নুর মোহাম্মদ মিঠু

মার্চ ৩০, ২০২১, ০৮:২৫ পিএম


ফের ভাড়া নৈরাজ্যের শঙ্কা
  • খালি থাকবে বাসের অর্ধেক আসন, ভাড়া বাড়লো ৬০ শতাংশ
  • গতবার অভিযোগের সংখ্যা খুব বেশি ছিলো না, তবুও যারা অনিয়ম করবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে -খন্দকার এনায়েত উল্লাহ, মহাসচিব, ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি
  • ৬০ শতাংশ ভাড়া বাড়ানোর ফলে সড়কে নৈরাজ্যকে আরও বাড়িয়ে দেয়া হলো -মোজাম্মেল হক চৌধুরী, মহাসচিব, যাত্রী কল্যাণ সমিতি 
  • ৫০ শতাংশ যাত্রী পরিবহনের নির্দেশনা পুরোপুরি বাস্তবায়নে কয়েকদিন সময় লেগে যেতে পারে -সরদার শাহাদাত আলী , অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিচালন), বাংলাদেশ রেলওয়ে 

করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে গণপরিবহনে ৬০ শতাংশ ভাড়া বৃদ্ধিতে সড়কে ফের নৈরাজ্যের শঙ্কা দেখা দিয়েছে। গত বছর সারা দেশে সাধারণ ছুটি কিংবা লকডাউনকালীন সময়েও গণপরিবহনে ৬০ শতাংশ ভাড়া বৃদ্ধি করায় সড়কে যে নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়েছিল, এবারো সরকারের একই সিদ্ধান্তে সড়কে নৈরাজ্যকে আরও বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

সংক্রমণ রোধে গত বছর পরিবহন মালিকদের দাবির প্রাধান্য দিয়েই ভাড়া বৃদ্ধি করা হলেও কার্যত লকডাউনকালীন সময়েও যাত্রী উঠানো নিয়ে চালক-হেলপাররা মেতেছিল এক ধরনের প্রতিযোগিতায়। স্বাস্থ্যবিধির কোনো বালাই ছিলো না বললেই চলে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এবারের প্রেক্ষাপট আরও ভয়াবহ। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, অফিস-আদালত চালু অবস্থায় কিংবা স্বাভাবিক জনজীবনে ভাড়া বৃদ্ধির এমন সিদ্ধান্তে সড়কে চালক-হেলপারের সঙ্গে যাত্রীদের মধ্যে যেমন হাতাহাতি-মারামারির ঘটনা ঘটবে, তেমনি যাত্রীদেরও জোরপূর্বক গাড়িতে উঠার প্রবণতাসহ চালক-হেলপারদের মধ্যেও যাত্রী উঠানো নিয়ে শুরু হবে চরম প্রতিযোগিতা। তবে মালিকপক্ষ বলছে, যারাই অনিয়ম করবে, যাদের বিরুদ্ধেই অভিযোগ উঠবে, বিআরটিএর ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাসহ তাদের বিরুদ্ধে সকল ব্যবস্থাই গ্রহণ করবে মালিকপক্ষ।

দেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সরকার ১৮ দফা নির্দেশনা জারি করার পর আজ বুধবার থেকে অর্ধেক আসন খালি রেখে গণপরিবহন চালানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। বাংলাদেশ রেলওয়েও গতকাল মঙ্গলবার থেকেই ট্রেনের ধারণক্ষমতার অর্ধেক টিকিট বিক্রি শুরু করেছে। তাতে ট্রেনের ভাড়া না বাড়লেও নগর পরিবহনের বাসের ভাড়া এখনকার তুলনায় ৬০ শতাংশ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। দেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ আবারো উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়ায় গত সোমবার সব ধরনের জনসমাগম সীমিত করাসহ ১৮ দফা নির্দেশনা জারি করে সরকার। সেখানে বলা হয়, গণপরিবহনে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে এবং ধারণক্ষমতার ৫০ শতাংশের বেশি যাত্রী পরিবহন করা যাবে না। ওই নির্দেশনা পাওয়ার পর একই দিন (সোমবার) সন্ধ্যায় রাজধানীর বনানীতে বিআরটিএর ভাড়া পুনর্নির্ধারণ সংক্রান্ত বৈঠকে আসন খালি রাখা ও ভাড়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয় বলে জানিয়েছেন বিআরটিএর চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার। তিনি বলেন, ‘এর আগে গত বছরের ১ জুন থেকে যেভাবে গণপরিবহনে যাত্রী বহন করা হয়েছিল, আগামীকাল থেকে সেভাবেই চলবে। বাসের অর্ধেক আসন খালি থাকবে, ভাড়া বাড়বে ৬০ শতাংশ।’

তবে যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী আমার সংবাদকে বলেন, ‘এটা কোনোভাবেই মানানো যাবে না। অফিস-আদালত সবকিছু খোলা রেখেই বলা হচ্ছে গণপরিবহনে অর্ধেক যাত্রী বহন করা হবে। কিন্তু আজ পর্যন্ত যে সিদ্ধান্ত ছিলো সেটা হলো- যত সিট তত যাত্রী। এটাই মানানো যায়নি। যদি এটাও মানানো যেতো তাহলে স্বাস্থ্যবিধির অনুকূলে কিছুটা হলেও বালাই থাকতো।’ তিনি বলেন, ‘এমনিতেই আমাদের গণপরিবহনে একটা ভয়াবহ সংকট রয়েছে। তারপর আবার অফিস-আদালত খোলা রেখেই অর্ধেক যাত্রী বহন করা! আমাদের যে চালক-হেলপার রয়েছে তাদের কাছে দিনের জন্য গাড়ি ইজারা দিয়ে থাকি। ফলে তারা বেশি যাত্রী বহন করার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত থাকে। এ কারণেই সড়কে নৈরাজ্য-বিশৃঙ্খলা-দুর্ঘটনা। এখান থেকে বেরিয়ে আসার জন্য আমরা নানা উপায়ও খুঁজছি। আমরা একটা বিষয় নিশ্চিত হলাম যে, কাউন্টারভিত্তিক অর্থাৎ রুট র্যাশনালাইজেশনের যে কথাটি বলা হচ্ছে, সেটি যদি করা না হয় তাহলে সড়কে যেমন বিশৃঙ্খলা বা অরাজকতা থেকে বেরিয়ে আসা যাবে না, তেমনি করে এখন যে ৬০ শতাংশ ভাড়া বাড়ানো হলো তার ফলে নৈরাজ্যকে আরও বাড়িয়েই দেয়া হলো।’

মোজাম্মেল হক বলেন, ‘আগামীকাল থেকে বাস চলাচলের ক্ষেত্রে ভয়ঙ্কর প্রতিযোগিতা থাকবে এবং মুড়ির টিনের মতো যাত্রী বহন করা হবে। ভাড়া বৃদ্ধির মাধ্যমে বাসের চালক-হেলপারের সঙ্গে যাত্রীদের মারামারির একটা সুযোগও করে দেয়া হয়েছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, পাশাপাশি ঝগড়া হবে, বচসা হবে এবং হাতাহাতি-মারামারির ঘটনা ঘটবেই। অন্যদিকে চালক-হেলপাররা যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করবে এবং অতিরিক্ত যাত্রীও পরিবহন করবে।’ 

এদিকে আপাতত দুই সপ্তাহের জন্য এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে জানিয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গতকাল সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় আগামীকাল থেকে দেশের সকল গণপরিবহনে অর্ধেক যাত্রী নেয়া সাপেক্ষে ৬০ শতাংশ ভাড়া বৃদ্ধি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ভাড়া পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসবে।’ তিনি বলেন, ‘অর্ধেক আসন খালি রাখার পাশাপাশি গণপরিবহনে সবার মাস্ক পরা এবং স্যানিটাইজার ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। গণপরিবহনের মালিক-শ্রমিকদের এ বিষয়ে কঠোর হতে হবে।’ কিন্তু মালিক-শ্রমিকদের এসব বিষয়ের চেয়ে সাধারণ যাত্রীদের কাছ থেকে বাড়তি ভাড়া আদায়ের ক্ষেত্রেই সবচেয়ে বেশি কঠোর হতে দেখা যায়। এরই মধ্যে অফিস-আদালত চালু অবস্থাতেই ফের ভাড়া বৃদ্ধিকে সড়কে নৈরাজ্য সৃষ্টির কারণ বলছেন অনেকেই— এমনটা জানিয়ে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ আমার সংবাদকে বলেন, ‘এটা তো সরকারের গতবারের যে সিদ্ধান্ত এবারো সেই একই সিদ্ধান্ত। নতুন করে তো কিছুই হয়নি।’ কিন্তু গতবার তো ৬০ শতাংশ ভাড়াও আদায় করা হয়েছে আবার যাত্রীও বেশি বহন করেছে— এমন অভিযোগও ছিলো বললে তিনি বলেন, ‘যারা যাত্রী বেশি উঠাবে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এটা দূরপাল্লার বাসে হয় না। সিটিতে অফিস টাইমে কখনো কখনো যাত্রীরা উঠে যায় বা কখনো কখনো স্টাফরা যাত্রী উঠায়, মানে কখনো যাত্রী উঠে যায়, কখনো এরা উঠায় এরকম অনিয়ম হয়। তবে এবার যারা এটা করবে তাদের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা হবে বিআরটিএর পক্ষ থেকে। আমরাও তদারকি করবো, তাদের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা হবে। গতবার অভিযোগের সংখ্যা খুব বেশি ছিলো না, তবুও যারা অনিয়ম করবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে’ বলেও জানিয়েছেন তিনি।

এছাড়া একই কারণে ট্রেনেও ৫০ শতাংশ আসন ফাঁকা রেখে যাত্রার নির্দেশনা দিয়েছিল বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। যদিও প্রথম দিন গতকাল মঙ্গলবার এ নির্দেশনা পরিপালিত হয়নি রাজধানীর কমলাপুর রেলস্টেশনে। এদিন অধিকাংশ যাত্রীকেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে ভ্রমণ করতে দেখা যায়নি। সরেজমিন কমলাপুর রেলস্টেশনে গিয়ে দেখা যায়, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ছেড়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বেলা দেড়টায় প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছে বনলতা এক্সপ্রেস। ট্রেনের ভেতরে পাশাপাশি বসে আছেন যাত্রীরা। তাদের অনেকের মুখেই ছিলো না মাস্ক। রেলস্টেশনে ঢোকার সময় তাদের প্রায় সবাই মাস্ক পরেই ঢুকেছেন। কিন্তু আসনে বসার পর মাস্ক খুলে ফেলেন তারা। যাত্রীরা বলেন, ‘গরমে মুখে মাস্ক রাখা যায় না।’ করোনাকালে পাশাপাশি বসার কারণ জানতে চাইলে যাত্রীরা বলেন, ‘আগাম টিকিট কেটেছি। ফেরত দিলে কিভাবে যাবো?’ এক আসন ফাঁকা রেখে যে ট্রেনে চড়তে হবে নতুন এই নির্দেশনার বিষয়েও তারা কিছুই জানেন না।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, করোনা ভাইরাসের সংক্রমণরোধে ট্রেনে ৫০ শতাংশ যাত্রী পরিবহনের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু বিক্রীত আগাম টিকিটের ৫০ শতাংশ ফেরত আসেনি রেলওয়ের কাছে। যে কারণে প্রতিটি ট্রেনে বিক্রীত টিকিটের বিপরীতে ৫০ শতাংশ যাত্রী পরিবহনের নির্দেশনা শুরুতেই বাস্তবায়ন করা রেলওয়ের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। গতকাল সকাল থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত বিভিন্ন রুটে কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে ছেড়ে গেছে ২৮টি ট্রেন। ছেড়ে যাওয়া অধিকাংশ ট্রেনেই পাশাপাশি বসিয়ে যাত্রী পরিবহন করতে দেখা গেছে।

বাংলাদেশ রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিচালন) সরদার শাহাদাত আলী গণমাধ্যমকে বলেন, ‘৪ এপ্রিল পর্যন্ত আগাম টিকিট বিক্রি করা হয়েছে। আমরা নতুন নির্দেশনা বাস্তবায়নের জন্য ৫০ শতাংশ টিকিট বিক্রি করছি। এছাড়া স্বাস্থ্যবিধি মানাতে সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘আগে বিক্রীত টিকিট ফেরত না এলে ৫০ শতাংশ যাত্রী পরিবহনের নির্দেশনা পুরো বাস্তবায়ন করা যাবে না। ৫০ শতাংশ যাত্রী পরিবহনের নির্দেশনা পুরোপুরি বাস্তবায়নে কয়েকদিন সময় লেগে যেতে পারে।’

কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের মাস্টার রফিকুল ইসলামও গণমাধ্যমকে বলেন, ‘রেলওয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনেই ট্রেন পরিচালনা করে আসছে। সোমবার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ করোনাকালীন নির্দেশনা বাস্তবায়নের কথা বলেছেন। নতুন নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা অর্ধেক টিকিট বিক্রি করছি। একটি আসন পর পর যাত্রীরা বসে ট্রেনে ভ্রমণ করবেন।’ তিনি বলেন, ‘আমরা মাস্ক ব্যবহার করে ট্রেনে যাত্রীদের ভ্রমণ করতে বারবার অনুরোধ করছি। পাশাপাশি তাদের শরীরের তাপমাত্রা পরীক্ষা করা হচ্ছে। স্যানিটাইজারের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, পুরো রেলস্টেশনে জীবাণুনাশক ছিটানো হয়েছে।’ উল্লেখ্য, করোনা সংক্রমণরোধে ৫০ শতাংশ যাত্রী পরিবহনের জন্য সোমবার বাংলাদেশ রেলওয়ের পূর্ব ও পশ্চিম অঞ্চলের সব রেলস্টেশনের ব্যবস্থাপকসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে নির্দেশনা পাঠানো হয়।

আমারসংবাদ/জেআই