Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪,

পেট ভরছে না পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের!

এপ্রিল ৩, ২০২১, ০৮:০৫ পিএম


পেট ভরছে না পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের!
  • ৬০ শতাংশ ভাড়া বৃদ্ধি বাতিল করে আগের মতো যত সিট তত যাত্রী পদ্ধতিতে ফিরে আসার আহ্বান যাত্রীকল্যাণ সমিতির
  • সাধারণ মানুষের আয় বাড়েনি, বরং কমেছে। তাই বাড়তি ভাড়া জনগণের ওপর না চাপিয়ে সরকারকেই ভর্তুকি দেয়ার পরামর্শ অর্থনীতিবিদদের

রাজধানীর পল্টন এলাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে আট হাজার টাকা বেতনে চাকরি করেন হারিস। থাকেন তেজগাঁও এলাকার একটি মেসে। মাস শেষে নিজের থাকা-খাওয়া ও যাতায়াত ভাড়া বাদে যে টাকা অবশিষ্ট থাকে তা দিয়েই টেনেখিঁচে চলে গ্রামে থাকা সংসার। আরেকজন পেশায় শিক্ষকতা করেন। নাম রাসেল। থাকেন যাত্রাবাড়ীর কাজলা এলাকায়। যিনি গত লকডাউনে করা ঋণের বোঝা টেনে যাচ্ছেন এখনও। এরই মধ্যে করোনা পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে এলেও ফের দ্বিতীয় দফায় সংক্রমণ বৃদ্ধির কারণে ৬০ শতাংশ ভাড়া বৃদ্ধির নামে গণপরিবহন শ্রমিকদের দ্বিগুণ-তিনগুণ ভাড়া আদায়েই নিঃস্বপ্রায় হারিস ও রাসেলদের মতো হাজারো মানুষ। ভাড়া বহনেই যারা নিঃস্ব বাজারের আগুন আর করোনায় আয় কমে যাওয়ায় জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহও কঠিন হয়ে পড়ছে তাদের। তবে নীতিনির্ধারকরা নীতির ঘোষণা দিয়েই বসে থাকছেন ঘাপটি মেরে— অভিযোগ জনসাধারণের।

এই যখন করোনাকালীন নিদারুণ বাস্তবতা ঠিক তখনই নীতিনির্ধারকমহল থেকে ফের ঘোষণা আসে লকডাউনের। যে ঘোষণায় ইতোমধ্যেই হতাশ হয়ে পড়েছে দেশের বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ। গণমাধ্যমের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ঘটাচ্ছেন ক্ষোভ ও হতাশার বহির্প্রকাশ। কেউ কেউ বলছেন, লকডাউন মানেই গরিবের হক মেরে খাওয়ার সুযোগ। যদিও গরিব-অসহায়ের জন্য সরকার বিভিন্নভাবে সাহায্য ও অনুদান দিলেও তা লুটপাট করে নিতে দেখা গেছে গত বছরের লকডাউনে। এবারো তার পুনরাবৃত্তি ঘটার আশঙ্কা করছেন হতাশাগ্রস্ত সাধারণ মানুষ। লকডাউনের বাস্তবতা যেমন- তেমনি হালে গণপরিবহনের ৬০ শতাংশ বর্ধিত ভাড়াতেও যেন পেট ভরছে না পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের। সীমিত আয়ের মানুষদের পথেই নিঃস্ব করে ছাড়ছে মহলটি। কিন্তু মালিক সমিতির নেতারা জোর গলায় বললেও এখন পর্যন্ত সরকার কিংবা মালিক সমিতির নেতাদের এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নিতেই দেখা যায়নি, বরং বর্ধিত ভাড়ারও দ্বিগুণ ভাড়া আদায়েই আগ্রহী তারা।  রাজধানীতে প্রায় পাঁচ হাজার গণপরিবহন চলাচল করে। প্রতিদিন এসব গণপরিবহন ব্যবহার করে প্রায় দুই লাখ যাত্রী। কিন্তু সরকারের এমন সিদ্ধান্তে ভাড়া নৈরাজ্যের শিকার হচ্ছেন যাত্রীরা। যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী আমার সংবাদকে বলেন, সরকারের এমন সিদ্ধান্তে ভাড়া নৈরাজ্যের শিকার হচ্ছেন গণপরিবহন ব্যবহারকারীরা। ৬০ শতাংশ ভাড়া বৃদ্ধি বাতিল করে আগের মতো যত সিট তত যাত্রী পদ্ধতিতে ফিরে আসার আহ্বানও জানান তিনি। এছাড়া বিআইডিএসের গবেষক ড. নাজনীন আহমেদ বলছেন, করোনাকালে সাধারণ মানুষের আয় বাড়েনি, বরং কমেছে। তাই বাড়তি ভাড়া জনগণের ওপর না চাপিয়ে সরকারকেই ভর্তুকি দেয়ার পরামর্শ তার। এদিকে শিল্প-কারখানা চালু রেখেই আজ সোমবার থেকে এক সপ্তাহের জন্য সারা দেশে লকডাউনের ঘোষণা দিয়েছে সরকার। যে ঘোষণার পর থেকেই বেসরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে বিরাজ করছে বেতন কর্তন ও ছাঁটাই আতঙ্ক। এছাড়া স্বল্প আয়ের মানুষরাও রয়েছেন হতাশায়। তার ওপর মরার ওপর খাঁড়ার ঘা— পরিবহনের বর্ধিত ভাড়া। বর্ধিত ভাড়ার নির্দেশনা কার্যকরের পর যতই দিন গড়াচ্ছে, ভাড়া নৈরাজ্যে সাধারণ যাত্রীদের ভোগান্তি ও ক্ষোভ ততই বাড়ছে। এছাড়া নির্দেশনা কার্যকর হওয়ার পর থেকে রাজধানীর কয়েকটি রাস্তায় বিক্ষোভও করেছেন যাত্রীরা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সড়কে দাঁড়িয়েও গণপরিবহনে উঠতে পারছেন না যাত্রীরা। এছাড়া রাইড শেয়ারিং বন্ধ ঘোষণা হওয়ায় সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালকরাও হাঁকাচ্ছেন আকাশচুম্বী ভাড়া। ফলে সড়কে রাজধানীবাসীর ভোগান্তি যেন দিন দিন বেড়েই চলছে। গতকাল শনিবার ছুটির দিন সকালেও রাজধানীর বাড্ডা, কুড়িল বিশ্বরোড, শেওড়া, নিকুঞ্জ ও কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সামনে যাত্রীদের ভোগান্তি পোহাতে দেখা গেছে।  সরেজমিন দেখা যায়, বাড্ডা থেকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল পর্যন্ত মোড়ে মোড়ে যাত্রীরা দীর্ঘ সময় ধরে বাসের জন্য অপেক্ষা করছেন। এসব এলাকায় ২০ থেকে ৩০ মিনিট পর পর একটি-দুটি করে বাস আসছে। তবে এসব বাসের অধিকাংশেরই দরজা বন্ধ। ফলে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করেও কাঙ্ক্ষিত বাস আসার পরও আসন না থাকায় উঠতে পারছেন না যাত্রীরা। তবে সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় যাত্রীর চাপ কিছুটা কম ছিলো। অনেকে দীর্ঘ সময় ধরে অপেক্ষা করে গণপরিবহন না পেয়ে অফিসে দ্রুত যাওয়ার জন্য সিএনজিচালিত অটোরিকশা খুঁজছেন। পেলেও চালকরা চাচ্ছেন কয়েকগুণ বেশি ভাড়া।

কুড়িল বিশ্বরোডে আব্দুল্লাহপুরগামী বাসের জন্য অপেক্ষমাণ যাত্রী সুমন বলেন, সকাল ৯টা থেকে বাসের জন্য দাঁড়িয়ে আছি। এখন ১০টা বাজতে চললো, কিন্তু বাসে আসন পাচ্ছি না। অধিকাংশ বাস গেট লক অবস্থায় আসছে। আমি তো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করি। ভেবেছিলাম আজ ছুটির দিনে ভোগান্তি কিছুটা কম হবে। কিন্তু ভোগান্তির তো কোনো শেষ নেই। কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের বিপরীত পাশের বাসস্ট্যান্ডে অপেক্ষমাণ যাত্রী রিফাত বলেন, ফার্মগেট যাওয়ার জন্য একঘণ্টা ধরে রাস্তায় বাসের জন্য দাঁড়িয়ে আছি। এর মধ্যে তিনটি বাস এলো। কিন্তু একটাতেও সিট খালি নেই। এ অবস্থায় সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালকের কাছে গেলাম। তিনিও কয়েকগুণ বেশি ভাড়া চাচ্ছিলেন। এভাবে ভোগান্তি চলতে থাকলে আমরা অফিস কীভাবে করব? করোনার চেয়ে তো এই সমস্যা এখন বড় হয়ে যাচ্ছে। যাত্রীদের গণপরিবহনের জন্য এমন দুর্ভোগ রাজধানীর সর্বত্র দেখা যাচ্ছে। অন্যদিকে ৫০ শতাংশ যাত্রী অনেক বাসে চলাচল করলেও বাসচালক ও যাত্রীরা স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না। যারা বাসের জন্য অপেক্ষা করছেন, তারাও স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না।  এদিকে লকডাউন কার্যকর হওয়ার পর থেকে সব ধরনের যাত্রীবাহী ট্রেন বন্ধ করে দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন। গতকাল শনিবার এ সিদ্ধান্তের কথা জানান তিনি। রেলমন্ত্রী বলেন, সরকারের লকডাউন ঘোষণায় যেহেতু গণপরিহন বন্ধের কথা বলা আছে তাই যাত্রীবাহী রেলসেবাও বন্ধ থাকবে। তবে সরকার চাইলে পণ্যবাহী রেলসেবা চালু থাকবে। সরকার যদি লকডাউন আরও বাড়িয়ে দেয় তাহলে এভাবেই চলতে থাকবে।

লকডাউন ঘোষণার পর রাজধানীর বাস টার্মিনালগুলোতে ঘরমুখো মানুষের ভিড় বাড়তে দেখা গেছে গতকাল। যাত্রীরা জানান, কাল সোমবার থেকে লকডাউনের প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার। তাই এখন বাড়ি না গেলে রাজধানীতে আটকে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই আগেভাগে বাড়ি চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে বাস, সিএনজি, রিকশায় মহাখালী বাস টার্মিনালে যাচ্ছেন ময়মনসিংহ, জামালপুর, শেরপুরসহ উত্তরাঞ্চলের যাত্রীরা। নির্ধারিত ভাড়া দিয়ে টিকিট কেটে নিজ গন্তব্যে বাসে উঠছেন তারা। এর মধ্যে এনা পরিবহনের কাউন্টারের সামনে বেশি ভিড় দেখা যায়।

লঞ্চেও ভিড় বেড়েছে যাত্রীদের। কোনো ধরনের স্বাস্থ্যবিধি মানার বালাই নেই। অর্ধেক যাত্রী ওঠানোর যে নির্দেশনা রয়েছে তা মানা হচ্ছে না। গতকাল সরেজমিন ঢাকার সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে যাত্রীদের প্রচণ্ড ভিড় দেখা গেছে। লঞ্চের ডেকে যাত্রীদের শুয়ে-বসে, ঘেঁষাঘেঁষি করে অবস্থান করতে দেখা গেছে। মুখে মাস্ক পরা থাকলেও যাত্রীরা লঞ্চের মধ্যে জট বেঁধে কেউ কার্ড খেলছেন, কেউ ছক্কা, কেউ আবার জড়ো হয়ে আড্ডা দিচ্ছেন। চাঁদপুরগামী ঈগল-৭ লঞ্চে দেখা গেছে, লঞ্চের ভেতর মানুষের ছড়াছড়ি ও হইচই। লঞ্চ কর্তৃপক্ষ যাত্রীদের স্বাস্থ্যবিধি মানার জন্য ডেকে দাগ টেনে বসার স্থান নির্ধারণসহ বিভিন্ন নির্দেশনা দিয়ে রেখেছে তা মানছে না যাত্রীরা। তিনতলা এ লঞ্চের পুরোটার চিত্র একই। চাঁদপুরগামী যাত্রী সাগর হোসেন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, লঞ্চে অর্ধেকের বেশি যাত্রী নেয়া হচ্ছে। কিন্তু ভাড়া ৬০ শতাংশ বেশিই নিচ্ছে। আগে ডেকে ভাড়া ছিলো ১২০, এখন ১৮০ টাকা। কিন্তু যাত্রী আগের মতোই বোঝাই করে নিচ্ছে।

দেশব্যাপী নতুন লকডাউন কার্যকর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে ও লকডাউনের নির্দেশনা পালনে পুলিশ আরও কঠোর হবে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, গত বছর কোনো অভিজ্ঞতা ছাড়াই পুলিশ মাঠে থেকে কাজ করেছে। গতবারের অভিজ্ঞতা সঙ্গে নিয়ে এবার পুলিশ কাউকেই লকডাউন ও স্বাস্থ্যবিধি লঙ্ঘনে ছাড় দেবে না। গত বছর লকডাউন চলাকালে অনেকেই বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে ঢাকা ছেড়েছিল। এবার তা হতে দেয়া হবে না। কোভিড-১৯-এর নিয়ন্ত্রণ করতে পুলিশ মাঠে থেকে কাজ করবে। তিনি আরও বলেন, গত বছরের লকডাউন পর্যালোচনা করে অভিজ্ঞতা বাস্তবায়নের বিষয়ে পরিকল্পনা করার জন্য আজ রোববার পুলিশ এ বিষয়ে সভা করবে।

আমারসংবাদ/জেআই