Amar Sangbad
ঢাকা বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪,

কাজ নেই পরিবেশ আদালতের

এপ্রিল ৩, ২০২১, ০৮:০৫ পিএম


কাজ নেই পরিবেশ আদালতের
  • ২০ বছরে পরিবেশ আইনে মামলা হয়েছে মাত্র ৩৮৮টি
  • মামলা না থাকায় পরিবেশ আদালতে চলছে চেক জালিয়াতি মামলার বিচার
  • আদালত নয় অধিদপ্তরের আগ্রহ  বেশি মোবাইল কোর্টে

কৃষিজমি দখল করে ইটভাটা নির্মাণ। নদী দখল, কলকারখানার বিষাক্ত বর্জ্যে পানি দূষণ, গাছপালা কেটে নগরায়ন, পলিথিন, বালুভরাট, শব্দদূষণে প্রতিনিয়তই ক্ষতিগ্রস্ত পরিবেশ। ঘটছে পরিবেশের বিপর্যয়। দূষণ প্রতিরোধে নিয়মিত মামলা হয়। এসব মামলার বিচার করতে আছে পরিবেশ আদালত। তবে পরিবেশ আদালতে মামলা যায় না।

যেটা যায় তাও নামমাত্র। ৯০ শতাংশ অভিযোগ ও মামলা পাঠানো হয় ভ্রাম্যমাণ আদালতে। ফলে অনেকটা কাজহীন পড়ে আছে ২০০০ সালে গঠিত তিনটি পরিবেশ আদালত। মামলা না থাকায় পরিবেশ-বিষয়ক অপরাধের পরিবর্তে করছে চেক জালিয়াতি মামলার বিচার। এদিকে নির্দিষ্ট আদালত থাকতে ভ্রাম্যমাণ আদালতে বিচার করায় পরিবেশ আদালত সৃষ্টি করার যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পরিবেশ আদালতের অল্প সংখ্যক মামলা নিয়েও বিচারে ধীরগতি। নিষ্পত্তিতে কেটে যাচ্ছে বছরের পর বছর। আবার অধিকাংশ বিচারাধীন মামলার আসামিই জামিনে বেরিয়ে পলাতক আছেন। হাজির হচ্ছে না আদালতে। অনেক মামলার সাক্ষীই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মূলত কর্মকর্তাদের গাফলতি, তদন্তে বিলম্ব, আদালতে সাক্ষী হাজির করতে না পারায় অর্ধেকের বেশি মামলাই অনিষ্পন্ন অবস্থায় পড়ে আছে।

এদিকে পরিবেশ সংরক্ষণে গুরুত্ব দিয়ে এ আদালত প্রতিষ্ঠা করা হলেও অধিদপ্তরের আগ্রহ বেশি ভ্রাম্যমাণ আদালতে। পরিবেশ আদালতেকে পাশ কাটিয়ে প্রতিনিয়তই ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান চলছে, হচ্ছে শাস্তি ও জরিমানা। ২০১৫ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের আগস্ট পর্যন্ত পরিবেশ অধিদপ্তর ভ্রাম্যমাণ আদালতে মামলা করেছে আট হাজার ৭৫৬টি। এ সময় জরিমানা করা হয়েছে প্রায় ৫৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে আদায় হয়েছে প্রায় ৪৬ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। অথচ নির্দিষ্ট আদালত মামলার অভাবে এখন অনেকাংশেই নিষ্ক্রিয়।

এমন অবস্থায় আইনজ্ঞরা জানান, পরিবেশ আদালতে মামলার ক্ষেত্রে নানা আইনি জটিলতা রয়েছে। একজন ভুক্তভোগী এ আদালতে সরাসরি মামলা করতে পারেন না। তারা বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে মামলা না করার কারণেই এ পরিস্থিতির সৃষ্টি। মামলা না থাকায় পরিবেশ আদালতেরই যেনো পরিবেশ নেই। এ আদালতে জনগণের সরাসরি মামলা করার সুযোগ দিয়ে আইন সংশোধন করা প্রয়োজন বলেও মনে করেন তারা।

বিশ্লেষকরা বলছেন, পরিবেশের ক্ষতি হয় এমন অপরাধের বিচার করতে নির্দিষ্ট আদালত থাকলেও ভ্রাম্যমাণ আদালতে বিচার করা অযৌক্তিক। পরিবেশ অধিদপ্তর মামলা করে দূষণ ও দখলকারীদের কঠোর সাজা নিশ্চিতে আগ্রহী নয়। তারা ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে যে জরিমানা করে, তার বড় অংশই আবার আপিল করে ছাড় পান দূষণকারীরা। সব মিলিয়ে দূষণ-দখল পরিস্থিতির উন্নতি হয় না। পরিবেশ আদালতে অপরাধীদের সাজা হয়। কিন্তু ভ্রাম্যমাণ আদালত আসামিদের তাৎক্ষণিক কারাদণ্ড কিংবা অর্থদণ্ড করায় দিন দিন মামলার সংখ্যা কমে যাচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের মামলায় কারাদণ্ড কম। বেশির ভাগ মামলায় আদালত আসামিদের আর্থিক দণ্ড দেয়া হয়। কেউ মামলা করতে চাইলে প্রথমে অধিদপ্তরের কাছে অভিযোগ জানাতে হয়। প্রতিকার না পেলে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি আদালতে মামলা করতে পারেন। পরিবেশ আদালতে মামলা কম হওয়ার অন্যতম একটি কারণ সরাসরি মামলার সুযোগ না থাকা। প্রতিটি মামলাতেই বিচার হয় পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে। কিন্তু তারিখের পর তারিখ পার হলেও অধিদপ্তর প্রতিবেদন না দেয়ায় মামলার নিষ্পত্তি আর হয় না।

সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, ঢাকা চট্টগ্রামসহ তিনটি পরিবেশ আদালতে মামলা আছে সাত হাজার দুটি। এর মধ্যে মাত্র ৩৮৮টি বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-১৯৯৫ এর অধীনে করা। যা মোট সংখ্যার মাত্র সাড়ে ৫ শতাংশ।  চলতি বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ঢাকার পরিবেশ আদালতে পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে পাঁচটি মামলা বিচারের জন্য পাঠানো হয়েছে। গত বছর পাঠানো হয় ২৯টি। এর আগে ২০১৬ সালে চারটি, ২০১৭ সালে ছয়টি, ২০১৮ সালে ১৯টি এবং ২০১৯ সালে তিনটি মামলা পাঠানো হয়েছিল। ঢাকার পরিবেশ আদালতের কার্যক্রম শুরু হয় ২০০৩ সালে। ঢাকা অঞ্চলের জন্য দুটি পরিবেশ আদালত রয়েছে। তার মধ্যে একটি মূল আদালত, অন্যটি আপিল আদালত।

আদালত সূত্র জানায়, মূল পরিবেশ আদালতে বর্তমানে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা দুই হাজার ৭৯৬টি। এর মধ্যে পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে করা মামলার সংখ্যা মাত্র ১১৭টি, যা মোট মামলার মাত্র ৪ দশমিক ১৮ শতাংশ। এর বাইরে ফৌজদারিসহ অন্যান্য নিয়মিত মামলার বিচার হয় এই আদালতে।

ঢাকার পরিবেশ আদালতে কর্মরত সরকার নিযুক্ত কৌঁসুলি (পিপি) ফিরোজুর রহমান বলেন, ‘এখানে বরাবরই মামলা কম আসে। পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে এই আদালতে একেবারেই কম মামলা দেয়া হয়। পরিবেশ অধিদপ্তর নিজেরা ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে থাকে। যে কারণে আদালতে তাদের মামলার সংখ্যা কম।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের সভাপতি অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘পর্যাপ্ত সংখ্যক পরিবেশ আদালত না থাকায় পরিবেশ দূষণ রোধে ভ্রাম্যমাণ আদালত বা মোবাইল কোর্ট অনেক ক্ষেত্রে ভরসা হিসেবে কাজ করেছে। কিন্তু সেটিও পর্যাপ্ত নয়। কারণ মাঝে মধ্যে মোবাইল কোর্ট যে জরিমানা করে, সেটি আপিলে গিয়ে টেকে না। এ জন্য পরিবেশ আদালতে মামলা করার বিকল্প নেই। সে ক্ষেত্রে দোষীরা পর্যাপ্ত সাজা পাবে।’

পরিবেশ আইনে জটিলতার বিষয়ে তিনি বলেন, পরিবেশ আদালতে জনসাধারণ সরাসরি মামলা করতে পারে না। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করতে হলে অনুমোদনের জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে অভিযোগকারীকে আবেদন করতে হয়। আইনের এসব শর্ত পূরণ করে কোনো বিচারপ্রার্থী এখানে আসতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না।’ তাই জনগণের সরাসরি মামলা করার সুযোগ দিয়ে আইন সংশোধন করা প্রয়োজন বলেও মনে করেন তিনি।

প্রসঙ্গত, রাজধানীর আদালতপাড়ায় পুরনো জজকোর্ট বিল্ডিংয়ের দ্বিতীয় তলার ৩১ নম্বর কক্ষে অবস্থিত ঢাকা বিভাগীয় পরিবেশ আদালত।

আমারসংবাদ/জেআই