Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪,

করোনা মোকাবিলায় কৃষিতে অগ্রাধিকার

এপ্রিল ৭, ২০২১, ০৭:৫০ পিএম


করোনা মোকাবিলায় কৃষিতে অগ্রাধিকার

বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও গত বছর মার্চে করোনা ভাইরাস মারাত্মকভাবে আঘাতহানে। সবকিছু স্থবির হয়ে গেলেও বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়ে কৃষি খাত চাঙ্গা রাখা হয়। কৃষকদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বছরের এপ্রিলে কম সুদে পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেন। বাংলাদেশ ব্যাংক চার শতাংশ সুদে এই প্রণোদনা কার্যকর করতে ৪৩টি ব্যাংককে চুক্তিবদ্ধ করেছে। তারা এ ঋণ দিচ্ছে, শেষ পর্যায়ে। এছাড়া চলতি অর্থবছরে কম সুদে কৃষি খাতে ২৪ হাজার কোটি টাকা ঋণ বিতরণের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। একই সাথে কৃষি উৎপাদন অব্যাহত ও উৎপাদন বাড়াতে সার ও কৃষি যন্ত্রপাতি সহজলভ্য করা, মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদন, সংগ্রহ, সংরক্ষণ এবং শাকসবজির বিপণন, সরবরাহ ঠিক রাখা ও কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নানা উদ্যোগ নিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়।

এক টুকরা জায়গা খালি রাখা যাবে না— প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণাকে অগ্রাধিকার দিয়ে খুবই তৎপর হয়ে ওঠেন কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক। তার নেতৃত্বে কর্মকর্তারাও নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ফলে গত বছরের তুলনায় ৮৩ হাজার হেক্টর বেশি জমিতে বোরোর আবাদ হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান।

কৃষি অধিদপ্তর সূত্র জানায়, করোনা মোকাবিলা ও বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এবং উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এরই অংশবিশেষ চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে এ পর্যন্ত প্রায় ৫৭ লাখ কৃষকের মাঝে ৩৭২ কোটি টাকার প্রণোদনা বিতরণ করেছে কৃষি মন্ত্রণালয়। প্রণোদনা কর্মসূচির আওতায় মোট জমির পরিমাণ ২৩ লাখ ৬৪ হাজার বিঘা। কৃষি মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত বাজেট কৃষি পুনর্বাসন সহায়তা খাতের বরাদ্দ হতে এ প্রণোদনা বিতরণ করা হয়। ৩৭২ কোটি টাকার মধ্যে করোনা ও বন্যায় ক্ষতি পোষাতে দেয়া হয়েছে ১১২ কোটি টাকার প্রণোদনা। রবি মৌসুমে মাসকলাই, মুগ, সূর্যমুখী, সরিষা, ভুট্টা প্রভৃতি উৎপাদন বৃদ্ধিতে দেয়া হয়েছে ৯০ কোটি টাকার প্রণোদনা।

এছাড়া, বোরো ধানের আবাদ ও উৎপাদন বৃদ্ধিতে বিনামূল্যে বীজ সহায়তা বাবদ ১৩৬ কোটি টাকা, পেঁয়াজের উৎপাদন বৃদ্ধিতে ২৫ কোটি টাকা ও ৬১ জেলায় সমলয়ে হাইব্রিড বোরো ধানচাষের জন্য ৯ কোটি টাকার প্রণোদনা বিতরণ করা হয়েছে। কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাকের কঠোর নির্দেশনা ও দক্ষ নেতৃত্বের কারণে প্রণোদনার সুবিধা সরাসরি কৃষকের কাছে পৌঁছানো হয়েছে। যে কারণে করোনা সংকটেও কৃষি খাত ঘুরে দাঁড়িয়েছে।

এছাড়া অন্যান্য বছরের চেয়ে চলতি অর্থবছরেও কৃষি খাতে ২৪ হাজার কোটি টাকা ঋণ বিতরণের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। তা সঠিকভাবে বিতরণের জন্য বিভিন্ন ব্যাংককে লক্ষ্যমাত্রাও নির্ধারণ করে দিয়েছে। প্রণোদনা প্যাকেজের সুদের সাথে সামঞ্জস্য রেখে কৃষকের সব ঋণে সুদ ৪ শতাংশ কার্যকর করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্দেশ দিয়েছে। ধান, গম, আলু, ভুট্টাসহ সব ধরনের শস্য ও ফসল উৎপাদনে ঋণের সুদহার ৪ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। নতুন ঋণের পাশাপাশি আগের ঋণেও এই রেয়াতি সুদহার কার্যকর হবে। আমনের পর বোরো ধান উৎপাদনেও বেশি করে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। যাতে বেশি বেশি করে ধান উৎপাদন হয়।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে এবার আগেই বোরো ধান উঠে গেছে। উৎপাদনশীলতা বেশি হওয়ায় এবছর হাইব্রিড জাতের ধানের চাষ বৃদ্ধিতে জোর দেয়া হয়েছে। গত বছরের তুলনায় প্রায় ৩ লাখ হেক্টর জমিতে হাইব্রিডের আবাদ বেড়েছে। গড়ে হেক্টর প্রতি ১ টন করে বেশি ফলন হলেও কমপক্ষে ৩ লাখ টন উৎপাদন বাড়বে। গত ১ এপ্রিল বোরো মৌসুমের ধানকাটা উদ্বোধন করেন কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক।

এসময় তিনি বলেন, মহামারি করোনাকালে খাদ্য নিয়ে মানুষকে যাতে আতঙ্কে থাকেত না হয়, খাদ্যের যাতে কোনো অভাব না হয়, আমরা সেটি নিশ্চিত করতে দৃঢ়ভাবে কাজ করছি। বোরো মৌসুমে দেশে সবচেয়ে বেশি ধান-চাল উৎপাদন হয়। হাওরসহ সারা দেশের বোরো ধান সফলভাবে ঘরে তুলতে পারলে দেশে খাদ্য নিয়ে তেমন ঝুঁকি থাকবে না। আমরা স্বস্তিতে থাকতে পারবো। 

কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্র আরও জানায়, করোনা সংকটের ক্ষতি কাটিয়ে নিতে কৃষি খাতে ১৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা প্রণোদনার ঘোষণা করেছে সরকার। মাত্র চার শতাংশ সুদে কৃষকদের মাঝে এ ঋণ বিতরণ করা হচ্ছে। বিশেষ প্রণোদনা ছাড়াও সারসহ সেচকাজে বিদ্যুৎ বিলের রিবেট বাবদ কৃষি খাতে নয় হাজার ৫০০ কোটি টাকার ভর্তুকি কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। আউশ ও আমন ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হয়েছে। আউশ ধানের আবাদ বাড়ানোর জন্য চার লাখ ৬৫ হাজার ৮৩৪ জন কৃষককে কৃষি উপকরণ দেয়া হয়েছে। প্রায় ৫৯ লাখ হেক্টর জমিতে আমন ধান আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা এক কোটি ৫৬ লাখ টন। এজন্য উচ্চফলনশীল হাইব্রিড জাতের ধানচাষ বাড়ানো, পর্যাপ্ত বীজ, সার ও সেচের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। আমনের উৎপাদন বাড়াতে সরকার এবারই প্রথম বীজে ভর্তুকি দিচ্ছে। বিএডিসির ১৯ হাজার ৫০০ টন আমন ধান বীজ চাষিপর্যায়ে বিক্রির জন্য ২০ কোটি টাকা ভর্তুকি দেয়া হয়েছে।

মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে প্রতি ইউনিয়নে ৩২টি করে পারিবারিক সবজি পুষ্টিবাগান তৈরির কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। এজন্য ৩৭ কোটি ৩৬ লাখ ২২ হাজার টাকা ব্যয়ে ৬৪ জেলায় এক লাখ ৪১ হাজার ৭৯২ জন কৃষকের মধ্যে বিনামূল্যে বীজ, চারা ও সার দেয়া হয়েছে। 

কৃষি যান্ত্রিকীকরণের জন্য ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে এক হাজার ২৪০টি কম্বাইন হারভেস্টার ও ৫০০টি রিপার বিতরণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে ৫০ শতাংশ ভর্তুকি মূল্যে এবং উপকূল ও হাওর এলাকায় ৭০ শতাংশ ভর্তুকি মূল্যে কৃষকের মধ্যে এসব কৃষিযন্ত্র দেয়া হয়েছে। প্রায় তিন হাজার ২০ কোটি টাকার ‘কৃষি যান্ত্রিকীকরণ’ প্রকল্প অনুমোদন পেয়েছে। এর মাধ্যমে প্রায় ৫২ হাজার কম্বাইন হারভেস্টার, রিপার ও রাইস ট্রান্সপ্লান্টার নামের কৃষিযন্ত্র কৃষকপর্যায়ে সরবরাহ করা হবে।বিএডিসি ও অন্যান্য বেসরকারি কোম্পানির উৎপাদিত আউশ, সবজি ও পাটবীজ মাঠপর্যায়ে সরবরাহ করা হয়েছে। রবি মৌসুমে উৎপাদিত আলুবীজ সংগ্রহ করে হিমাগারে রাখা হয়েছে। এর মধ্যে বিএডিসির আলুবীজ সংগ্রহের পরিমাণ ৩৪ হাজার ৫০০ টন এবং বেসরকারি কোম্পানির প্রায় ৮৫ হাজার টন, যা গত বছরের তুলনায় পাঁচ হাজার টন বেশি। কৃষি চাষাবাদে গতি ফেরাতে চলমান ২০২০-২১ অর্থবছরে রাসায়নিক সারের চাহিদা পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে অতিরিক্ত ১ লাখ টন ইউরিয়া ও ১ লাখ টন ডিএপি সার সরবরাহের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ সার ফসল উৎপাদন ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।

দেশে গম ও ভুট্টার প্রচুর চাহিদা রয়েছে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের খাদ্য হিসাবে ভুট্টা ব্যাপকভাবে ব্যবহার হচ্ছে। সেজন্য, গম ও ভুট্টার উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কৃষি খাতকে যুগোপযোগী করতে বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। কৃষির উৎপাদন ও কৃষকদের আধুনিকায়নে এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। শিল্পায়নের বিকাশেও বাংলাদেশে এখনও বেশির ভাগ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। স্বল্প জমিতে ও বাড়ির আঙিনায় গরু, মুরগি পালন, ফলমূলচাষ ও শাকসবজির বাগান স্থাপনসহ বিভিন্ন আধুনিক কৃষিকাজ সম্প্রসারণের নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে।

আমারসংবাদ/জেআই