Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪,

২৩৭৮ কোটি টাকা নিয়ে টানাটানি

জাহাঙ্গীর আলম

এপ্রিল ১০, ২০২১, ০৭:৫০ পিএম


২৩৭৮ কোটি টাকা নিয়ে টানাটানি
  • ঝুলে আছে মাতারবাড়ী কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প সংশোধন
  • এক লাফে ব্যয় বাড়ছে সাড়ে ১৬ হাজার কোটি টাকা
  • সাত বছরে কাজের অগ্রগতি মাত্র ৪৫ শতাংশ
  • বিভিন্ন কারণে অগ্রগতি কম -প্রকল্প পরিচালক

বড় জাহাজে করে ভারীপণ্য খালাসে বাংলাদেশে নির্মাণ করা হচ্ছে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর। অপরদিকে বেশি করে উৎপাদন বাড়াতে মাতারবাড়ী কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রও নির্মাণ করা হচ্ছে। এ প্রকল্পের কয়লা বহনে মাতারবাড়ী বন্দর থেকে মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র পর্যন্ত ২৫০ মিটার চওড়া চ্যানেল নির্মাণ করা হচ্ছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রায় সাত বছর চলে গেলেও কাজের অগ্রগতি খুবই কম, অর্ধেকও হয়নি। এ জন্য সংশোধনের জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে। তাতে বিভিন্ন অঙ্গে ব্যয় বাড়িয়ে একলাফে সাড়ে ১৬ হাজার কোটি টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে মাতারবাড়ী বন্দর প্রকল্পের জন্য আরও ১০০ মিটার চওড়া করতে দুই হাজার ৩৭৮ কোটি টাকা ব্যয় প্রস্তাব করেছে। কিন্তু এর কাজ ও মালিকানা নিয়ে টানাটানি শুরু হলে সমাধানে শেষ পর্যন্ত আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটিও গঠন করা হয়েছে। এটি বাস্তবায়ন করছে কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিপিজিসিবিএল)।

নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের দাবি— বন্দরের জন্য চ্যানেল লাগবে। ঋণের শর্ত হিসেবে ড্রেজিংয়ের কাজ করছে জাপানের কোম্পানি। ২৯ ডিসেম্বর মাতারবাড়ীর গভীর সমুদ্রবন্দরে ইন্দোনেশিয়া থেকে পানামার পতাকাবাহী জাহাজ ‘ভেনাস ট্রায়াম্প’ ভিড়ে গেছে। মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরের কাজ হলে পাল্টে যাবে চেহারা। সিঙ্গাপুরের আদলে এটি করা হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।

সার্বিক ব্যাপারে জানতে চাইলে মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প পরিচালক আবুল কালাম আজাদ আমার সংবাদকে বলেন, বিভিন্ন কারণে দীর্ঘ সময় চলে গেছে। এ পর্যন্ত প্রকল্পের অগ্রগতি ৪৫ শতাংশ হয়েছে। ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। তাই তিন বছর অর্থাৎ ২০২৬ সাল পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। আপনার প্রকল্পে খাল খনন ডিপিপিতে ছিলো না তারপরও করা হচ্ছে। এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের অংশ ২৫০ মিটার ছিলো। ঠিকাদারকে দিয়ে করা হচ্ছে। একই খাল ও খালের পাড় (সেডিমেন্ট মিটিগেশন ডাইক) আরও ১০০ মিটার চওড়া করা হবে মাতারবাড়ি বন্দর কর্তৃপক্ষের প্রয়োজনে। সেটা আমাদের ঠিকাদার দিয়েই করা হবে। তারা টাকা সরকারকে দেবে। সেই টাকা আমরা ঋণ হিসেবে জাইকাকে দিয়ে দেবো। কাজেই কোনো সমস্যা হবে না। বিভিন্ন কারণে ব্যয় বাড়ছে বলে জানান তিনি।

নৌ-পরিবহন, বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় ও পরিকল্পা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, সাগর থেকে বড় জাহাজে করে ভারীপণ্য খালাসে বাংলাদেশে নির্মাণ করা হচ্ছে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর। জাপানের উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা জাইকা, বাংলাদেশ সরকার ও চট্টগ্রাম বন্দরের অর্থায়নে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। জাপানের কাশিমা বন্দরের আদলে তৈরি করা হচ্ছে এই মাতারবাড়ি বন্দর। যাতে বিশ্বের বড় বড় ব্যবসাকেন্দ্র মাতারবাড়ী বন্দর ঘিরে গড়ে উঠতে পারে। মাতারবাড়ী বন্দর নির্মাণের প্রাথমিক পরিকল্পনায় প্রথম ধাপে রয়েছে দুটি টার্মিনাল। সাধারণ পণ্যবাহী ও কনটেইনার টার্মিনালে বড় জাহাজ (মাদার ভ্যাসেল) ভিড়তে পারবে, যেটি এখন বাংলাদেশের কোনো বন্দর জেটিতে ভিড়তে পারে না। প্রথম ধাপে বন্দর ও পণ্য পরিবহনের জন্য সড়ক নির্মাণসহ ব্যয় ধরা হয়েছে ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা। এই প্রকল্পে ১২ হাজার ৮৯২ কোটি ৭৬ লাখ টাকা ঋণ দিচ্ছে জাপান। বাকি অর্থ সরকার দিচ্ছে। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে প্রকল্পটি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগ যৌথভাবে বাস্তবায়ন করছে। চ্যানেল নির্মাণের জন্য প্রকল্প উন্নয়ন প্রস্তাবে (ডিপিপি) উল্লেখও করা হয়েছে। তাতে ব্যয়ও ধরা হয়েছে। এর সব নকশা জাপানি বিশেষজ্ঞদের তত্ত্বাবধানে হচ্ছে। মাতারবাড়ী বন্দর নির্মাণের জন্য প্রকল্পটি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হলে সব প্রক্রিয়া শেষ করে অনুমোদন দিয়েছে সরকার। কাজও শুরু হয়েছে। ২০২৬ সালে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্পের কাজ হবে। সিঙ্গাপুরের আদলে করা হচ্ছে এটি। ব্যাপকভাবে সাড়া ফেলবে দেশ-বিদেশে বলে সংশ্লিষ্ট শীর্ষ এক কর্মকর্তা এ প্রতিবেদককে জানান। 

অপরদিকে দেশের বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পেরও ২০১৪ সালে অনুমোদন দিয়েছে সরকার। কিন্তু ডিপিপিতে চ্যানেল ড্রেজিং কাজ আওতাভুক্ত করা হয়নি। তারপরও ভারী জাহাজে করে কয়লা আনার জন্য প্রকল্পটির বাস্তবায়নকারী সংস্থা কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেডের মাধ্যমে জাপানি ঠিকাদার কোম্পানি ১৪ দশমিক ৩ কিলোমিটার লম্বা, ২৫০ মিটার চওড়া চ্যানেল তৈরির কাজ বাস্তবায়ন করছে। তা শেষ পর্যায়ে। চ্যানেলের গভীরতা সাড়ে ১৮ মিটার করা হবে। বিদ্যুৎ প্রকল্পের যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম খালাসের জন্য আগেভাগে চ্যানেল তৈরির কাজ শেষ করা হচ্ছে। মাতারবাড়ী বন্দর নির্মাণ হলে চীন থেকে সরাসরি বড় কনটেইনার জাহাজ ভেড়ানো সম্ভব হবে। মাতারবাড়ীতে চট্টগ্রাম বন্দরে চলাচলকারী চারটি জাহাজের সমান কনটেইনার আনা-নেয়া করা যাবে এক জাহাজে। এতে কমবে চট্টগ্রাম বন্দরে চাপ।

স্ট্রিম জেনারেটরের যন্ত্রাংশ নিয়ে ২৯ ডিসেম্বর প্রথমবারের মতো কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়ীর গভীর সমুদ্রবন্দরে ভিড়ে পানামার পতাকাবাহী জাহাজ ‘ভেনাস ট্রায়াম্প’। এ প্রকল্পটির কাজ শেষ হওয়ার কথা ২০২৬ সালে। গভীরতা পর্যাপ্ত থাকায় পানামার পতাকাবাহী জাহাজ ‘ভেনাস ট্রায়াম্প’ বন্দরে ভিড়েছে। তাহলে আবার ড্রেজিং কেন বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা প্রশ্ন তুলেছেন। কারণ যেকোনো প্রকল্প সংশোধনের আগে আইএমইডির সুপারিশ লাগে।

সূত্র জানায়, বিদ্যুতের উৎপাদান বাড়াতে কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ী-ধলঘাটা ইউনিয়নে ২০১৪ সালের ১২ আগস্ট কয়লাভিত্তিক ‘মাতারবাড়ি এক হাজার ২০০ মেগাওয়াট আলট্রাসুপার ক্রিটিক্যাল ফায়ার্ড পাওয়ার প্রজেক্ট’ নামে একটি মেগা প্রকল্পের অনুমোদন দেয় সরকার। এটি একটি ফার্স্ট ট্র্যাক প্রকল্প। ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৫ হাজার ৯৮৪ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে জাইকার ঋণ প্রায় ২৯ হাজার কোটি টাকা। বাকি অর্থ সরকার ব্যয় করবে। যা ২০১৪ সালের জুলাই থেকে ২০২৩ সালের জুনে শেষ করার কথা। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণ প্রদান, ভূমি উন্নয়ন, চ্যানেল ও আনুষাঙ্গিক অবকাঠামো নির্মাণ, জেটি নির্মাণ, ১২০০ মে.ওয়াট ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণসহ আনুষাঙ্গিক কার্যক্রম চলমান। প্রকল্পটি সুষুমভাবে বাস্তবায়ন করতে বছরে চার প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) সভা করার কথা। কিন্তু গেল বছরে মাত্র একবার করা হয়েছে। যথাযথভাবে মনিটরিং করা হচ্ছে না।

অপরদিকে মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রের ডিপিপিতে ড্রেজিংয়ের কাজ না থাকলেও তা করা হচ্ছে। অগ্রগতি কম হওয়ায় কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিপিজিসিবিএল) সমপ্রতি মেয়াদ ও ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাব বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। তাতে প্রকল্পে নতুন করে প্রায় সাড়ে ১৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয় বাড়িয়ে ৫২ হাজার ৩৮৯ কোটি টাকার প্রস্তাব করেছে। এর মধ্যে জাইকার ঋণ সাড়ে ৪৪ হাজার কোটি টাকা ধরা হয়েছে। বাকি অর্থ সরকারের তহবিল থেকে ব্যয় ধরা হয়েছে। তাতে ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে ১৬ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ সময় বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে আড়াই বছর অর্থাৎ ২০২৬ সালের জুনে। কিন্তু চ্যানেল কাটা অর্থাৎ ড্রেজিংয়ের অর্থ ও মালিকানা নিয়ে জটিলতা বাঁধে।

করণীয় ঠিক করতে ১০ ডিসেম্বর মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ প্রকল্পের ওপর বিদ্যুৎ বিভাগে প্রকল্প যাচাই কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সংশোধিত ডিপিপিতে মাতারবাড়ী বন্দর প্রকল্পের অতিরিক্ত কাজের ব্যয় সংস্থানের বিষয়ে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা করে আলোচনা করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সমাধানের পথ বের করতে এরই মধ্যে বিদ্যুৎ বিভাগের যুগ্ম সচিব (পরিকল্পনা-১) ড. শাহ মো. হেলাল উদ্দীনকে প্রধান করে কমিটি গঠন করে দুই দফা আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা হয়েছে।

সভায় জানানো হয়েছে, প্রকল্পের চলমান চ্যানেলকে আরও ১০০মিটার চওড়া ও অতিরিক্ত প্রায় ৪০০ মিটার  সেডিমেন্ট মিটিগেশন ডাইক নির্মাণ করা হবে। এ অতিরিক্ত কাজটি নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের বাস্তবায়নাধীন ‘মাতারবাড়ী পোর্ট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট’-এর জন্য করা হবে। এ কাজে ব্যয় ধরা হয়েছে দুই হাজার ৩৭৮ কোটি টাকা। এ কাজ সিপিজিসিবিএলের ইপিসি ঠিকাদার ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান সম্পাদন করবে। বাড়তি চ্যানেলের কাজটি বিদ্যুৎ প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে। একই সঙ্গে এ কাজের ব্যয় সিপিজিসিবিএল নির্বাহ করবে। কিন্তু অর্থ মাতারবাড়ী বন্দর কর্তৃপক্ষকে পরিশোধ করতে হবে। তবে ডাবল রি-পেমেন্ট যাতে না হয়, সে জন্য চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ সরকারকে ওই অর্থ পরিশোধ করবে। আর চ্যানেলের মালিকানা নৌ-মন্ত্রণালয়ের আওতায় থাকার জন্য আলাদা এমওইউ চুক্তি করা হবে। তাতে আয়-ব্যয়ের মালিকানার আলোকে মাতারবাড়ী বন্দর পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় নীতিমালা প্রণয়ন করা যেতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু এখনো কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। এ জন্য প্রকল্পটি অনুমোদনের জন্য এগুতে পারছে না বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান।

আমারসংবাদ/জেআই