Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪,

হাসপাতালে এখন হাহাকার

মাহমুদুল হাসান

এপ্রিল ১১, ২০২১, ০৭:৪৫ পিএম


হাসপাতালে এখন হাহাকার
  • সরকারি হিসাবে মৃত্যু ছাড়িয়েছে পৌনে ১০ হাজার
  • আইসিইউ ফাঁকা নেই রাজধানীর ৭৮ শতাংশ হাসপাতালে
  • সংক্রমণ ঠেকাতে প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বরাদ্দ

করোনার দ্বিতীয় ঢেউ চলছে। সংক্রমণের তীব্রতায় বিপর্যস্ত জনজীবন। হাসপাতালগুলো রোগীতে পূর্ণ। যেনো তিল ধারণের ঠাঁই নেই। আশায় বুক বেঁধে অনেকেই স্বজনদের ঘাড়ে ভর করে হাসপাতালে পা রাখেন। কিন্তু আস্থার শেষ আশ্রয়স্থল হাসপাতালে এখন হাহাকার। রোগীর ভিড়ে কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালে ভর্তি কিংবা নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) বেড মিলছে না। চিকিৎসক চেনা সুরে যখন স্যরি... বলে বিদায় জানাচ্ছে তখন রোগী ও স্বজনদের মুখটা শুকিয়ে যাচ্ছে। হতাশায় নিমজ্জিত পুরো পরিবার। অনেকে সাধারণ বেডে ভর্তির সুযোগ পেলেও অবস্থার অবনতি হলে শেষযাত্রায় মেলে না আইসিইউ।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, শুধু রাজধানীর ২২টি কোভিড ডেডিকেটেড সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের ১৭টিতে ফাঁকা নেই আইসিইউ। রোগীতে পূর্ণ আইসিইউ ইউনিটের সামনে দাঁড়িয়ে একটি শ্রেণি অপেক্ষা করে কখন স্বজন সুস্থ হবে। অপেক্ষমাণ আরেকটি গ্রুপ মনে জঁপে— ফাঁকা হোক আইসিইউ। যেনো আমার স্বজন আইসিউতে জায়গা পায়। ফলে মুমূর্ষু কোভিড রোগীদের চিকিৎসা দিতে অনেকটা বেগ পেতে হচ্ছে। কয়েকটি প্রতিষ্ঠান সংক্রমণ বৃদ্ধির সাথে সাথে সক্ষমতার বাইরে অনেক রোগীকে চিকিৎসা দিচ্ছে। এ নিয়ে আসলেও প্রয়োজনীয় সেবা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। প্রমাণ মিলেছে গতকাল রাজধানীর বেশ কয়েকটি কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতাল ঘুরে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (ইউনিট-২) সামনে কথা হয় ইমরুলের সঙ্গে। লকডাউনের মধ্যে মুমূর্ষু কোভিড রোগী সত্তরোর্ধ বাবা আরজ আলীকে নিয়ে এসেছেন মুন্সিগঞ্জ থেকে। রোগীর অবস্থা সঙ্কটাপন্ন। কিন্তু আস্থার ঢামেক হাসপাতালে নেই আইসিইউ ফাঁকা। ফলে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। এদিকে রাজধানীর হলি ফ্যামিলি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কোভিড রোগীরা অগ্রিম টাকা পরিশোধ করেও আইসিইউ ফাঁকা পাননি বলে অভিযোগ উঠেছে। জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, করোনা সংক্রমণ আরও ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারে। যুক্তরাজ্য ও ব্রাজিলে শনাক্ত হওয়া নতুন ভ্যারিয়েন্টের সঙ্গে আফ্রিকার নতুন একটি ধাচের করোনা শনাক্ত হচ্ছে। ফলে অতীতের চেয়ে আগ্রাসী ভূমিকায় করোনা ছড়িয়ে পড়ছে। এক্ষেতে কঠোর লকডাউন ও স্বাস্থ্যবিধি না মানলে বড় ধরনের ক্ষতি হতে পারে। তাই করোনা সংক্রমণ এড়াতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।’ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এক সপ্তাহের ব্যবধানে শনাক্ত রোগী ও মৃত্যু বেড়েছে। এক সপ্তাকে করোনায় মৃতের হার ৩০ শতাংশের ওপরে বেড়েছে। গত ২৮ মার্চ থেকে তিন এপ্রিল পর্যন্ত ১৩তম সপ্তায় দেশে এক লাখ ৮৫ হাজার ৯৬৭টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এতে ৩৮ হাজার ৪৭১ জনের নমুনায় করোনা শনাক্ত হয়। এ সময় ১৫ হাজার ৮৫৩ জন রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলেও মৃত্যু হয়েছে ৩৪৪ জনের। গত চার এপ্রিল থেকে গতকাল পর্যন্ত ১৪তম সপ্তাহে ১৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ নমুনা পরীক্ষা বৃদ্ধি পেয়েছে। এ সময় দুই লাখ ২০ হাজার ৮২৮ জনের নমুনা পরীক্ষায় ২৬ দশমিক ৪৮ শতাংশ রোগী শনাক্ত বৃদ্ধি পায়। এতে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে ৪৮ হাজার ৬৬০ জনে পৌঁছায়। সুস্থতার হারও ৪২ দশমিক ৫৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। সংখ্যায় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২২ হাজার ৬০৩ জনে। এ ছাড়াও গত সপ্তাহে ৪৪৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। এতে এক সপ্তাহের ব্যবধানে মৃতের হাড় বেড়ে ৩০ দশমিক ২৩ শতাংশে ঠেকেছে। দেশের মোট জনসংখ্যার  হিসেবে প্রতি ১০ লাখে চার হাজার ২০ জন রোগী শনাক্ত হচ্ছে। সুস্থ হচ্ছে তিন হাজার ৩৮৫ জন ও মৃতের সংখ্যা কম করে হলেও ৫৭ জনের বেশি।

সারা দেশে ১০ হাজার ৩৬৪টি সাধারণ ও ৬৭২টি আইসিইউ বেড রয়েছে। তার মধ্যে পাঁচ হাজার ৪৮৪টি সাধারণ বেডে রোগী ভর্তি আছে। ফাঁকা আছে চার হাজার ৮৮০টি বেড। এদিকে ৬৭২টি আইসিইউ বেডের মধ্যে ৫৩০টিতে রোগী ভর্তি রয়েছে। ফাঁকা আছে ১৪২টি।  তার মধ্যে রাজধানীর ২২ সরকারি বেসরকারি কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালে চার হাজার ২৩টি সাধারণ বেডের তিন হাজার ৫৬২টি বেড ফাকা আছে। ৩৭৭ আইসিইউ বেডের মধ্যে ৩৭০টিতে রোগী ভর্তি ও সাতটি বেড ফাঁকা আছে। কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতাল, সরকারি কর্মচারী হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (ইউনিট-২) ও বার্ন ইউনিট, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, আসগর আলী হাসপাতাল, স্কয়ার হাসপাতাল, ইবনে সিনা হাসপাতাল, ইম্পালস হাসপাতাল, এ এম জেড হাসপাতাল, বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতাল, ল্যাব এইড হাসপাতাল ও পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আইসিইউ বেড ফাঁকা নেই। দেশে ১৫ হাজার ৯১৩টি অক্সিজেন সিলিন্ডার, এক হাজার ১৫৮টি হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা ও ৯৫৮টি অক্সিজেন কনসেনট্রেটর রয়েছে।

গতকাল স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব সুশীল কুমার পাল স্বাক্ষরিত এক পরিপত্রে বলা হয়, করোনা মহামারির সময়ে দেশের তৃণমূলের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে ৪৮৩টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে তিন লাখ করে মোট ১৪ কোটি ৪৯ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এই টাকায় তারা করোনা চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদি, করোনা আইসোলেশন হাসপাতালে ভর্তিকৃত রোগীদের পথ্য, ওষুধ সামগ্রী, গজ, ব্যান্ডেজ ও তুলা, কেমিকেল-রি-এজেন্ট (এক্সরে ফিল্ম, ইসিজি পেপারসহ), অক্সিজেন ও অন্যান্য গ্যাস সরবরাহ ও ক্রয়সহ বিভিন্ন কাজে ব্যয় করবেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিটের ইনচার্জ ডা. মুক্তাদির বলেন, করোনা সংক্রমণ ঠিক কিভাবে বাড়ছে সেটা এখন আপনারা সবাই জানেন। আমরা নিরুপায় হয়ে পড়ছি। প্রতিদিন রোগী ও তার স্বজনরা আইসিইউ ও অন্যান্য জটিলতার জন্য ভিড় করেন। কিন্তু আমরা ননস্টপ সেবা দিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু আক্রান্তের হার এত বেশি আমরা সবাইকে ভর্তি নিতে পারছি না। চিকিৎসা দিতে পারছি না। আমরাও হাপিয়ে উঠছি। অনেক চিকিৎসাক ও স্বাস্থ্যকর্মী করোনা রোগীদের সেবা দিতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছে। এর থেকে পরিত্রাণের জন্য আমাদের নিজেদের সুরক্ষিত থাকতে হবে। শতভাগ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। সরকার ঘোষিত লকডাউনে নিজের ও পরিবারের সুরক্ষার জন্য প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের হবে না।

গতকাল ফের সর্বোচ্চ মৃত্যু : স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, রাজধানীসহ সারা দেশে ১২১টি আরটি পিসিআর ল্যাব, ৩৪টি জিন এক্সপোর্ট ল্যাব ও ৯৩টি র্যাপিড অ্যান্টিজেন ল্যাবসহ ২৪৮টি সরকারি বেসরকারি ল্যাবে গতকাল আরও ২৯ হাজার ৩৭৬টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এ পর্যন্ত ৫০ লাখ দুই হাজার ৮৬৫টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। তার মধ্যে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ৩৭ লাখ ৩৯ হাজার ১৫৫টি আর বেসরকারি ববস্থাপনায় আরও ১২ লাখ ৬৩ হাজার ৭১০টি। এতে একদিনে আরও পাঁচ হাজার ৮১৯ জনের নমুনায় করোনা শনাক্ত হয়েছে। এ নিয়ে দেশে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়ালো ছয় লাখ ৮৪ হাজার ৭৫৬ জনে। তার মধ্যে গতকাল সুস্থ হয়েছে আরও চার হাজার ২১২ জন। এতে মোট সুস্থ রোগীর সংখ্যা বেড়ে পাঁচ লাখ ৭৬ হাজার ৫৯০ জনে পৌঁছেছে। এছাড়াও গতকাল একদিনে সর্বোচ্চ ৭৮ জনের মৃত্যুতে দেশে করোনায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৯ হাজার ৭৩৯ জন। গতকাল শনাক্তের হার ১৯ দশমিক ৮১ শতাংশ। এ পর্যন্ত শনাক্তের হার ১৩ দশমিক ৬৯ শতাংশ। সুস্থতার হার ৮৪ দশমিক ২০ শতাংশ আর মৃত্যুহার আগের মতোই এক দশমিক ৪২ শতাংশ।

গতদিনে যারা মারা গেছেন, তাদের মধ্যে ৫৩ জন পুরুষ আর নারী ২৫ জন। তাদের প্রত্যেকেই হাসপাতালে মারা গেছেন। মৃতদের মধ্যে ৪৮ জনের বয়স ছিলো ৬০ বছরের বেশি, ১৬ জনের বয়স ৫১ থেকে ৬০ বছর, সাতজনের বয়স ৪১ থেকে ৫০ বছর, ছয়জনের বয়স ৩১ থেকে ৪০ বছর এবং এক জনের বয়স ১০ বছরের কম ছিলো। মৃতদের মধ্যে ৪৭ জন ঢাকা বিভাগের, ২০ জন চট্টগ্রাম বিভাগের, চারজন রাজশাহী বিভাগের, চারজন খুলনা বিভাগের, দুইজন সিলেট বিভাগের এবং একজন রংপুর বিভাগের বাসিন্দা ছিলেন। দেশে এ পর্যন্ত মারা যাওয়া ৯ হাজার ৭৩৯ জনের মধ্যে সাত হাজার ২৭৯ জনই পুরুষ এবং দুই হাজার ৪৬০ জন নারী।

আমারসংবাদ/জেআই