Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪,

ধর্মের নামে ব্যক্তি-গোষ্ঠীর স্বার্থে অরাজকতা নয় (১ম পর্ব)

জাহাঙ্গীর কবির

এপ্রিল ১২, ২০২১, ০৮:৪৫ পিএম


ধর্মের নামে ব্যক্তি-গোষ্ঠীর স্বার্থে অরাজকতা নয় (১ম পর্ব)
  • সামাজিকভাবে আমরা সাধারণ লোকরা যেভাবে একে অপরের সাথে একত্রে খোলামেলাভাবে বিচরণ বা বসবাস করে থাকি মাদ্রাসা শিক্ষাজীবনে শিক্ষানবিশরা তা পারে না। তাদের চলাফেরা বিশেষ করে মাদ্রাসার গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ। তারা শিক্ষা গ্রহণের জন্য একরকম মাদ্রাসার চার দেয়ালে আটকা থাকতে বাধ্য হয়। ইসলামিক বা ধর্মীয় কোনো সভা-সমাবেশ ওয়াজ-মাহফিল অনুষ্ঠানাদি হলে তখন একত্রে বহুজনকে জমায়েত হতে দেখা যায়। অনুষ্ঠান বা মিছিল-মিটিং শেষে আবার মাদ্রাসার অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ে

ধর্মীয় সংগঠনের ব্যক্তি এবং গোষ্ঠীর স্বার্থে উচ্ছৃঙ্খল অরাজকতা কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেড়ে গেছে। এর শেষ কোথায় বলা মুশকিল। আমাদের দেশে কিছুকাল আগে জঙ্গি তৎপরতা ছিলো। যদিও সরকারের সদিচ্ছায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চেষ্টায় তা বর্তমানে নিয়ন্ত্রিত আছে বলে সরকার দাবি করছে। কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে ধর্মীয় ব্যক্তি-গোষ্ঠীর উসকানিতে যে উচ্ছৃঙ্খল অরাজকতা দেখা দিয়েছে তা যেন জঙ্গি তৎপরতারই সামিল। এ ধ্বংসাত্মক তৎপরতা দমনে সরকারের আন্তরিকতার দিকে চেয়ে আছে দেশবাসী। গত কদিন আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যে তাণ্ডব ঘটে গেল তা দেখে অনেকেরই মনে প্রশ্ন জাগতে পারে আবার নতুন করে জঙ্গি তৎপরতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে কি না। মানুষ হত্যা থেকে শুরু করে সেখানকার মানুষের ঘরবাড়ি ভূমি অফিস জ্বালানোর চিত্র জাতির পিতার ভাস্কর্য বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দেয়ার হুমকি দেশের মানুষের বিবেককে নাড়া দিয়েছে।

মানুষ ভাবতে শুরু করেছে তা হলে কি জঙ্গি তৎপরতা এতদিন ঘাপটি মেরে ছিলো? সরকার এই অপকর্মকারী উচ্ছৃঙ্খল দুস্কৃতকারীদের দমাতে সক্ষম হবে তো? হটাৎ করে এমন তৎপরতা ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড চালানোর উদ্দেশ্যই কি? কি চায় উগ্রবাদীরা? তাদের এত বেপরোয়া হওয়ার পেছনে কারণই বা কি? হেফাজতের এক নেতা তার ঔদ্ধত্য বক্তৃতায় বলেই বসেছেন. হেফাজতে ইসলাম মানেই বাংলাদেশ আর বাংলাদেশ মানেই হেফাজতে ইসলাম। তাহলে এতকাল এ দেশের লেখক সাহিত্যিক কবি বুদ্ধিজীবী সাংবাদিক জ্ঞানীগুণী রাজনৈতিক নেতা দেশের আপামর জনসাধারণ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণকারী এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শ অনুসরণকারীরা যে বলে আসছেন ‘বঙ্গবন্ধু মানে বাংলাদেশ আর বাংলাদেশ মানে বঙ্গবন্ধু।’ হেফাজত নেতার এরূপ পরস্পর-বিরোধী গরম বক্তব্য ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ তাহলে কি প্রমাণ করে? কি কারণে বাংলাদেশ একমাত্র হেফাজতের হয়ে যাবে? তারা কি নিজেদের সকল মানুষের প্রতিপক্ষ ভাবছে? অকারণে তাদের কেন এত বাড়াবাড়ি? দেশটা কি হেফাজতের নির্দেশে বা তাদের আন্দোলনে স্বাধীন হয়েছে? বঙ্গবন্ধুর দেয়া বাংলাদেশে বাস করে তারা এত ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ দেখানোর সাহস পায় কোথা থেকে। কারা এদের মদতদাতা। তাদের অরাজকতা দেখে দেশের মানুষের মনে অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। তাদের জন্মই তো হয়েছে সেদিন বাংলাদেশ স্বাধীনের পরে। কথায় কথায় তাদের এত আস্ফাালনের অর্থ কি? স্বাধীনতা যুদ্ধে তাদের কি এমন অগ্রণী ভূমিকা ছিলো যার প্রেক্ষিতে এমন কথা বলতে পারে? তাহলে কি কোনো স্বার্থান্বেষী মহল নিজেদের নামে বাংলাদেশকে ছিনিয়ে নেয়ার পাঁয়তারা করছে? মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণকারী এ দেশের জনগণকে ভাড়া করা শব্দ তৌহিদী জনতায় ভূষিত করে গগনচুম্বী আওয়াজ তুলে কি বোঝাতে চায়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ এ দেশের সংগ্রামী জনতা তাদের সে অসৎ উদ্দেশ্য কোনো দিনই সফল হতে দেবে না। তাদের এই উচ্ছৃঙ্খল অরাজকতা কীসের আলামত। কথায় কথায় ত্যাজি গলায় ঔদ্ধত্যভাবে হুঙ্কার দেয় আর একটি যুদ্ধ ঘোষণার। এ যুদ্ধ ঘোষণা কি কারণে তা দেশবাসী জানতে চায়। রাষ্ট্রে কি এমন ঘটে গেল যে স্বাধীন বাংলাদেশকে আবার স্বাধীন করার প্রয়োজনীতা দেখা দিল? প্রকৃতপক্ষে তাদের এই উচ্ছৃঙ্খল অরাজকতা ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করারই শামিল। এ চক্রান্ত দেশের সাধারণ শান্তিপ্রিয় মানুষের বুঝার বাকি নেই। এর আগেও জঙ্গি কর্মকাণ্ড দেশের মানুষ দেখেছে। সরকারের কঠোর হস্তক্ষেপ ও দমন নীতির ফলে এদের এখন আর তেমন খুঁজে পাওয়া যায় না। কে কি করতে পারে আর কে কি করবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণকারী এ দেশের মানুষকে নতুন করে দেখানোর কিছু নাই। পঞ্চাশ বছর ধরে তা বাংলাদেশের মানুষ দেখেছে। হিসাব নিকাশও মানুষের মধ্যে আছে। আপাতত এ দেশের মানুষ শেখ হাসিনাকে ছাড়া বিকল্প কিছুই ভাবছে না। জনগণের অন্তরদোরগোড়ায় গেলে তা যে কেউ সহজে বুঝতে পারবে। একই সাথে তাদের নিজেদের অবস্থানটাও নির্ণয় করতে পারবে। কে কি উদ্দেশ্যে লাফালাফি আর গলাবাজি করে তা দেশের সচেতন মানুষ অন্তত এটুকু বোঝে। কাজেই দেশের মানুষ বলতে চায় সাধু সাবধান!

আমাদের দেশে ইসলামিক মাদ্রাসাগুলোতে কুরআন-হাদিসের আলোকে ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা দেয়া হয়। তারা নিঃসন্দেহে ইসলামিক শিক্ষায় শিক্ষিত। অনেকেই ইসলামিক শিক্ষায় ডিগ্রিধারী হয়ে উচ্চতর স্তরে পৌঁছে যায়। জ্ঞানগর্ভে মাওলানা খেতাবপ্রাপ্ত হয়। সাধারণ শিক্ষিত মানুষও ঘরে বসে নিজ ইচ্ছায় পবিত্র কুরআন ও হাদিস পাঠ করে জ্ঞান অর্জন করে থাকে। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে বহুল ইসলামিক বইপুস্তক প্রকাশিত হওয়ার পর তার সিংহ ভাগই কিনে নেয় সাধারণ মানুষ। ইসলাম ধর্মের ওপর যত জ্ঞানীগুণী লেখক আছেন এবং তাদের মেধা-প্রজ্ঞা দিয়ে বই রচনা করেছেন তাদের সেইসব বই সাধারণ শিক্ষিত মানুষ পড়ে। তারা ইসলাম এবং ধর্মের ওপর জ্ঞান অর্জন করছে। কুরআন ও হাদিসের আলোকে জীবন পরিচালনার ক্ষেত্রে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের এ আগ্রহটা অনেকটা লক্ষ্য করার মতো। তাছাড়া মুসলমান ঘরে জন্ম নেয়া প্রত্যেক নর-নারী জন্মলগ্ন থেকেই ইসলামিক ধর্মীয় শিক্ষায় পারিবারিক আচার-আচরণে অভ্যস্ত হয়ে থাকে। কাজেই আপাতদৃষ্টিতে বলা যায়— কুরআন-হাদিসের আলোকে ধর্মীয় শিক্ষার আলো সকল মুসলমানের মধ্যেই কম-বেশি আছে। কোনো মুসলিম নর-নারীর মধ্যে ইসলামের আলো নেই— একথা সহজে বলা ঠিক হবে না। অনেক সাধারণ মানুষ আছেন যারা ব্যক্তিগতভাবে কুরআন-হাদিসের উপর চর্চা করেন। তারা হয়তো মাদ্রাসাপড়ুয়া বা ইসলামিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রী নয়। তারা ইসলামিক মাদ্রাসাপড়ুয়া লোকদের মতো বাহ্যিক পোশাক বা লেবাস পরিধান করেন না। তাই বলে তাদের মধ্যে ইসলাম বা ধর্মের আলো নেই— এ অবিশ্বাসও রাখা ঠিক নয়। এমন অনেক সাধারণ শিক্ষিত মানুষ আছেন যারা কুরআন-হাদিস ও ইসলামিক শিক্ষায় গবেষণা করে থাকেন। তাদের মধ্যে যারা জ্ঞান প্রজ্ঞা দিয়ে বইপুস্তক রচনা করেছেন তারা মাদ্রাসায় শিক্ষা গ্রহণ না করলেও তাদের ক্ষীণ করে দেখার সুযোগ নাই। শিক্ষা বা জ্ঞান অর্জনের কোনো সীমারেখা নেই। অনেকে মাদ্রাসায় পড়ে সব শিক্ষা বা জ্ঞান অর্জনে সক্ষম হয়েছে— এমনটা যেমন বলা যাবে না তেমনি মাদ্রাসার বাইরে অনেকে বিভিন্নভাবে ইসলামিক শিক্ষা বা বইপুস্তক পড়ে জ্ঞান লাভে সমৃদ্ধ হয়েছে। কাজেই কে কোথায় লেখাপড়া করেছে এমনটির কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রাধান্য পেলেও সাধারণভাবে ধর্মকর্মে নিয়োজিত স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিত ব্যক্তিদেরও তাদের অসাধারণ জ্ঞান-প্রজ্ঞার মাপকাঠিতে বিবেচনা করতে হবে। অনেকেই বইপুস্তক পড়ে জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত হয়েছেন।

কেউ বিশেষ বিদ্যালয় বা মাদ্রাসায় লেখাপড়া করে বিশেষ বিদ্যা শিক্ষার অধিকারী হতে পারেন তবে জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে শেষ কথা নয়। বিদ্যালয়ে না গিয়েও অনেকে ধর্মীয় ধ্যান-জ্ঞানে বিশেষ স্তরে পৌঁছেছেন। মহামানব কিংবা মহামনীষী হয়েছেন। ধর্মীয় জ্ঞানে নিদর্শন রেখেছেন। মাদ্রাসায় যারা কুরআন-হাদিস শিক্ষা গ্রহণ করে তারা সাধারণত মাদ্রাসার গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকে। তাদের বাইরে সাধারণ মানুষের সাথে তেমন মেলামেশা বা বিচরণ করতে দেখা যায় না। তারা মাদ্রাসার চার দেয়ালে আটকা থেকে ওস্তাদের নিকট থেকে তালিম নিয়ে থাকেন। মাদ্রাসার শিক্ষকরা তাদের যেভাবে শিক্ষা দেন সেভাবেই গড়ে ওঠেন। শিক্ষা সময়কালটা তারা নির্দিষ্ট পরিসরের মধ্যে কাটিয়ে থাকেন এবং জীবন যাপন করেন। তাদের যেকোনো বিষয়ে যেভাবে বোঝানো হয় তারা সেভাবেই বোঝেন। সামাজিকভাবে আমরা সাধারণ লোকরা যেভাবে একে অপরের সাথে একত্রে খোলামেলাভাবে বিচরণ বা বসবাস করে থাকি মাদ্রাসা শিক্ষাজীবনে শিক্ষানবিশরা তা পারে না। তাদের চলাফেরা বিশেষ করে মাদ্রাসার গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ। তারা শিক্ষা গ্রহণের জন্য একরকম মাদ্রাসার চার দেয়ালে আটকা থাকতে বাধ্য হয়। ইসলামিক বা ধর্মীয় কোনো সভা-সমাবেশ ওয়াজ-মাহফিল অনুষ্ঠানাদি হলে তখন একত্রে বহুজনকে জমায়েত হতে দেখা যায়। অনুষ্ঠান বা মিছিল-মিটিং শেষে আবার মাদ্রাসার অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ে।

লেখক : কলামিস্ট, কবি

আমারসংবাদ/জেআই