Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪,

লকডাউনে বের হতে লাখ লাখ আবেদন

এপ্রিল ১৩, ২০২১, ০৯:১৫ পিএম


লকডাউনে বের হতে লাখ লাখ আবেদন
  • মুভমেন্ট পাস চালুর পর সাড়ে ৬টা নাগাদ মোট আবেদন প্রায় ছয় লাখ। একই সময়ে নিবন্ধনভুক্ত হয়েছে প্রায় ৬০ হাজার আবেদন, ইস্যু করা হয়েছে প্রায় ৩০ হাজার পাস, এ পাস সবাই পাবে -সোহেল  রানা,  সহকারী  মহাপরিদর্শক  (এআইজি মিডিয়া), বাংলাদেশ পুলিশ    
  • যদি লাখ লাখ লোককে পাস দেয়া হয় তাহলে লকডাউন কার্যকরের বিষয়ে যেভাবে আমরা আশা করেছিলাম সেভাবে হয়তোবা হবে না -ডা. অধ্যাপক কনক কান্তি বড়ুয়া, সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
  • এটা অসম্ভব ব্যাপার মনে হচ্ছে আমার কাছে। কঠোরতা কার্যকর নিয়ে অনেকটাই সন্দিহান আমি। যারা পাস নিচ্ছে এরাই তো ভিড় করবে। কার্যকারিতা হারিয়ে যাবে, অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ

করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রথম দফা মোকাবিলায় সরকার ঘোষিত লকডাউন রীতিমত তামাশায় পরিণত হয়েছিল। সড়কে যানবাহন আর মানুষের চাপ ছিলো স্বাভাবিক দিনের মতোই। সে সময়কার অবস্থা এমন হয়েছে যে, একদিকে সরকার লকডাউন ঘোষণা করলেও কার্যকরে ছিলো নীরব, অন্যদিকে জনজীবনে করোনাভীতি থাকলেও জীবিকার তাগিদে সর্বত্রই ছিলো স্বাভাবিকতা। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল যে, কে শুনে কার কথা। প্রথম দফায় লকডাউনের বাস্তবতা যখন এমন, ঠিক তখনই সারা দেশে করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েই যাচ্ছিল হু হু করে। যা এখনো ক্রমেই বাড়ছে। আর করোনার এই চোখ রাঙানিতে ফের নড়েচড়ে বসেছে সরকার। প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে গত সোমবার জানানো হয় দেশজুড়ে সর্বাত্মক কঠোর লকডাউন। জারি করা হয় কঠোর বিধিনিষেধও। আর দেশের মানুষকে কঠোর এসব বিধিনিষেধ মানানোর মাধ্যমে লকডাউন কার্যকরের নির্দেশনাও দেয়া হয় প্রশাসনকে।

সরকারের সর্বাত্মক লকডাউনের এই সিদ্ধান্তকে দেশের দিনমজুর থেকে শুরু করে খেটে খাওয়া মানুষ জীবন-জীবিকার কথা চিন্তা করে প্রথমদিকে সাদরে গ্রহণ না করলেও পরবর্তীতে তারাসহ দেশের সকল মানুষই সাধুবাদ জানিয়েছে। কিন্তু মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে জারি করা প্রজ্ঞাপনে একটা নির্দিষ্ট সময় কাঁচা-বাজার, হোটেল-রেস্তোরাঁ খোলা রাখা এবং শিল্প-কলকারখানা চালু রাখার কথাও উল্লেখ করা হয়। আবার অতি প্রয়োজনে জনসাধারণের চলাচলের লক্ষ্যেও বাংলাদেশ পুলিশ চালু করে মুভমেন্ট পাস। যে পাসের ব্যবহার করে জরুরি প্রয়োজনের কথা বলে চলাচল করতে পারবে জরুরি সেবার আওতাবহির্ভূত যে কেউই। এছাড়াও শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত গতকাল জানা গেছে, প্রথমে বন্ধ রাখার ঘোষণা দেয়া হলেও পরে বিশেষ প্রয়োজনে ব্যাংক খোলা রাখতেও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে চিঠি পাঠানো হয়েছে। সবই যখন খোলা, তখন দেশের সাধারণ মানুষ ছাড়াও বিভিন্ন মহল থেকে সরকারের সর্বাত্মক এই লকডাউনের কার্যকারিতা নিয়ে দেখা দিয়েছে নানান প্রশ্ন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধিতে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাঁচাবাজার, হোটেল, রেস্তোরাঁসহ শিল্প-কলকারখানা সবই চালু রাখা হয়েছে। এরই মধ্যে আবার পুলিশের লাখ লাখ মানুষকে মুভমেন্ট পাস দেয়ায় লকডাউন কার্যকরে যে কঠোরতার কথা বলছে সরকার তাতেও দেখা দিয়েছে শঙ্কা। পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি মিডিয়া) সোহেল রানা আমার সংবাদকে জানিয়েছেন, এ পাস সবাই পাবে। যদি সবাই এ পাস পেয়ে থাকে তাহলে সরকার ঘোষিত কঠোর লকডাউনের কার্যকারিতার বিষয়ে জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য কনক কান্তি বড়ুয়া আমার সংবাদকে বলেন, ‘প্রথমত এটা নিয়ে একটা ক্রাইটেরিয়া ঠিক করা উচিত। সবাইকেই যদি পাস দেয়া হয় তাহলে লকডাউন কার্যকরের বিষয়ে যেভাবে আমরা আশা করেছিলাম সেভাবে হবে না হয়তোবা। যদি লাখ লাখ লোককে পাস দেয়া হয়, আর যদি আবেদনের সংখ্যা এত বেশি হয়েই থাকে তাহলে স্ফীত লক্ষ্যে যাওয়া যাবে না বলে মনে করছেন তিনি।’

এদিকে আজ বুধবার থেকে আটদিনের সর্বাত্মক লকডাউনে সরকার ঘোষিত বিধিনিষেধের মধ্যে অতি প্রয়োজনে মুভমেন্টের জন্য যে পাসের ব্যবস্থা করছে বাংলাদেশ পুলিশ, তাতে দেখা গেছে মুভমেন্ট অ্যাপসটির উদ্বোধনের আগে গতকাল সকাল থেকেই পাস আবেদনের হিড়িক পড়েছে। একসঙ্গে এত পরিমাণ পাস আবেদনের চাপে পুলিশ সদর দপ্তরের সার্ভারও ডাউন হয়ে যায় বলে জানা গেছে। কেউ কেউ একাধিকবার চেষ্টা করেও আবেদন করতে পারেননি। পুলিশ সদর দপ্তরের মিডিয়া শাখা থেকে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠানো ক্ষুদে বার্তায় জানানো হয়, প্রথম এক ঘণ্টায় আবেদন জমা পড়েছে এক লাখ ২৫ হাজার। পরবর্তীতে প্রতি মিনিটে গড়ে পনের হাজার আবেদন জমা পড়ছে। জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি মিডিয়া) সোহেল রানা আমার সংবাদকে বলেন, ‘অ্যাপটি চালু হওয়ার পর থেকে গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা নাগাদ প্রায় ছয় লাখ আবেদন জমা পড়েছে। একই সময়ের মধ্যে প্রায় ৬০ হাজার আবেদন নিবন্ধভুক্ত হয় এবং প্রায় ৩০ হাজার পাস ইস্যু করা হয়েছে।’ এর আগে তিনি বলেন, আবেদনকারী সবাই পাস পাবে। ইঞ্জিনিয়াররা সার্ভারের গতি বাড়াতে কাজ করছে।

জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ আমার সংবাদকে বলেন, এটা অসম্ভব ব্যাপার মনে হচ্ছে আমার কাছে। সর্বাত্মক লকডাউনে বিধিনিষেধ মানাতে যে কঠোরতার কথা বলা হচ্ছে, পুলিশের এ পাসে সেই কঠোরতা কতটা কার্যকর হবে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, কঠোরতা কার্যকর নিয়ে অনেকটাই সন্দিহান। কার্যকর করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। কারণ যারা পাস নিচ্ছে এরাই তো ভিড় করবে, জমবে। তাই কার্যকারিতা হারিয়ে যাবে বলে বলছেন প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত এই চিকিৎসক।

এদিকে এ পাসের অপব্যবহার হবে কি-না অ্যাপসটির উদ্বোধনকালে এমন প্রশ্নে বাংলাদেশ পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনারেল (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদ বলেন, মহামারির মধ্যেও কেউ যদি বাইরে বের হওয়ার জন্য প্রতারণা করে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আমরা আইনানুগ ব্যবস্থা নেবো। এটা অতি প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যাবে। এক ফোন নম্বর ও একটি গাড়ির নম্বর প্লেট দিয়ে একবার আবেদন করা যাবে। তবে প্রথমে কতজন এই পাস পাবে এই সংখ্যা নির্ধারণ করা নেই। যে কেউ গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনে পাস নিতে পারবে। তিনি বলেন, বাজার, করোনা টিকার ডেটসহ অতিপ্রয়োজনীয় কাজ থাকলেও বের হওয়া যাবে। এমনকি অ্যাম্বুলেন্সে রোগী যাওয়ার প্রয়োজন হলেও মুভমেন্ট পাস লাগবে। এছাড়াও করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে চলমান লকডাউনে মানুষের অনিয়ন্ত্রিত ও অপ্রয়োজনীয় চলাচল রোধে এবং জরুরি বিশেষ প্রয়োজনে যাতায়াত নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ পুলিশ চালু করছে এ পাস। দেশের যেকোনো নাগরিক ওয়েবসাইটের মাধ্যমে কয়েকটি তথ্য সরবরাহ করে খুব সহজেই এ পাস সংগ্রহ করতে পারবেন। পাসের জন্য ওয়েবসাইটে গিয়ে শুরুতেই একটি সক্রিয় মোবাইল ফোন নম্বর দিতে হবে। আবেদনকারী কোথা থেকে কোথায় যাবেন, তা জানতে চাওয়া হবে। সেইসব তথ্য ধাপে ধাপে প্রদান করতে হবে। এরপর আবেদনকারীর একটি ছবি আপলোড করে ফর্মটি জমা দিতে হবে। জমা দেয়া ফর্মে আবেদনকারী প্রদত্ত তথ্যাবলির ভিত্তিতে পাস ইস্যু করা যাবে। ওয়েবসাইট থেকেই পাসটি ডাউনলোড করে সংগ্রহ করা যাবে। চলাচলের সময় কর্তব্যরত পুলিশ অফিসারকে পাস প্রদর্শন করতে হবে।

এ নিয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার আমার সংবাদকে বলেন, মানুষ আবেদন করতেই পারে। পুলিশও তাদের দিবেই। তিনি বলেন, লকডাউন মানে- যে যেখানে আছে সেখানেই লকআপ। সেখান থেকে একেবারেই অতি প্রয়োজন কিংবা জরুরি প্রয়োজন না হলে মুভমেন্ট পাস দেয়া উচিত নয়। আর যদি দেয়া হয়- এটা তো লকডাউন হলো না, যেখানে অনেক কিছুই খোলা থাকবে। গার্মেন্ট খোলা থাকবে, অন্যান্য শিল্প-কলকারখানাও খোলা থাকবে। এটা তো আসলে লকডাউন হলো না। আমি আশা করছি, পুলিশ এ পাস বিবেচনা করেই দিবে। তা না হলে তো কোনো লাভই হলো না।

আমারসংবাদ/জেআই