Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪,

ধর্মের নামে ব্যক্তি-গোষ্ঠীর স্বার্থে অরাজকতা নয় (২য় পর্ব)

জাহাঙ্গীর কবির

এপ্রিল ১৩, ২০২১, ১০:৩৫ পিএম


ধর্মের নামে ব্যক্তি-গোষ্ঠীর স্বার্থে অরাজকতা নয় (২য় পর্ব)
  • ধর্মের পবিত্রতা ও শান্তি বজায় রাখা। সামাজিকভাবে বিভাজন সৃষ্টি না করে সহনশীলতার আবর্তে ভাবগাম্ভীর্যে ধর্ম প্রচারে ব্রত থেকে ধর্মের শানিত বাণী প্রচার করা। ইসলামের দৃষ্টিতে মানব জাতির কল্যাণে মানবতাকে জাগ্রত রেখে সবাইকে নিয়ে একত্রে পথ চলা। ইসলামের আলোকে শান্তির পথ সুগম করা। যেখানে থাকবে না হিংসা দ্বেষ অপকর্মের লেসমাত্র। ব্যক্তি-গোষ্ঠী স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে আল্লাহর পথে মানবকল্যাণে এগিয়ে আসতে হবে। ধর্মের নামে ব্যক্তি-গোষ্ঠীর স্বার্থে অরাজকতা নয়। খোলা চোখ এমনটাই বলছে

স্বাধীন মুক্তভাবে চলাফেরা করার ক্ষেত্রে একটা নিয়ম-নীতি তাদের অনুসরণ করতে হয়। তাই তারা সাধারণ মানুষ থেকে আলাদা। সাধারণের মধ্যে তাদের চলাফেরা সীমিত। এ কারণেই তাদের জীবনযাপনে একটা পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। মনে হয় একটা জনগোষ্ঠী যেন আলাদা। সমাজে বা পাড়া-মহল্লায় সকলের সাথে সকলের মিলন মিশ্রণ থাকলেও তাদের ক্ষেত্রে কিছুটা ভিন্নতা থাকে। মানুষে মানুষে মিলে-মিশে থাকবে সেটাই স্বাভাবিক হওয়া উচিৎ। ইসলামিক ধর্মীয় শিক্ষার লোকেরা সমানভাবে সবার মধ্যে অবাধে মেলামেশার সুযোগ পায় না। কিন্তু সবার সাথে সবার অবাধে মেলামেশার মাধ্যমে সুন্দর সৌহার্দ্য গড়ে উঠবে— এমনটাই কাম্য হওয়া উচিৎ। আচার আচরণে কেউ কারো প্রতিপক্ষ নয়। নিজের আলো সৌন্দর্যের সাথে অপরজনকে মিশিয়ে আলোকিত করার মাঝেই সার্থকতা। ফুটে ওঠে আন্তরিকতা। কিন্তু বাস্তবে আমরা কি তা দেখতে পাই।

মাদ্রাসা শিক্ষার ছাত্রসমাজ আলেমওলামা দিন দিন যেন তাদের নিজেদের একটা আলাদা বলয়ে নির্ধারণ করে নিয়েছে। তাদের কর্মকাণ্ডে নিজেদের একটা আলাদা পরিচিতি দিতে চান। সাধারণ লোক কিংবা স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা গ্রহণকারী ও মাদ্রাসায় শিক্ষা গ্রহণকারীরা একই দেশের অভ্যন্তরে বসবাস করে। একই নাগরিক অধিকারে বসবাস করলেও সামাজিক চালচলনে একটা পার্থক্য বা বিভাজন পরিলক্ষিত হয়। বাংলাদেশে ইসলামিক দলগুলো তাদের ধ্যান-ধারণা ও মতাদর্শ মোতাবেক ব্যক্তব্য পেশ করেন। তাদের দাবির ইস্যুতে ঢাকায় জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের গেইট থেকে প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে আন্দোলনে নেমে পড়তে দেখা যায়। কোনো কোনো দল ইসলামিক অনুশাসনে রাষ্ট্র পরিচালনার বাসনায় রাজনৈতিকভাবে সরকারের পতন ঘটিয়ে নিজেরা রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের অভিপ্রায়ে সরকারবিরোধী আন্দোলনে অবতীর্ণ হয়। এসব আন্দোলনের ডাকে লোক সমাগমে নিজেদের শিক্ষার্থী ছাড়াও আমজনতা জমায়েত হয়। বক্তারা ঔদ্ধত্যপূর্ণ ক্ষিপ্ত হস্ত সঞ্চালন করে গলাফাটা বক্তৃতা দিলে হাজার হাজার মাদ্রাসার সাদা লম্বা পোশাক পরিহিত শিক্ষার্থীদের মুহুর্মুহ স্লোগান দিতে দেখা যায়। কোনো কোনো বক্তার উসকানিমূলক বক্তৃতা দেশে অরাজকতা ও নৈরাজ্য সৃষ্টি করে আন্দেলনের নামে হুমকি-ধামকি দিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে ঘোলা পানিতে যেন মাছ শিকার করতে চায়। খাঁচায় বন্দি নিজেদের ছাত্রদের এসব গুরুজন ওস্তাদরা মগজ ধোলাই করে তাদের মাঠে নামিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে রাষ্ট্রকে অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করার পাঁয়তারায় লিপ্ত থাকে। ভিতরে ভিতরে হাত প্রসারিত রাখে যেন অন্য কোনো দল বা গোষ্ঠী তাদের মদত দেয় এবং হাতে হাত মেলায়। সেই সুযোগে কোনো কোনো স্বার্থান্বেষীমহল প্রকাশ্যে কিংবা গোপনে তাদের সমর্থন জানিয়ে তাদের সাথে হাতে হাত মিলায়। তারা সরকারের বিরুদ্ধে বা সরকার পতনের হুমকি দিয়ে আন্দোলনের নামে নৈরাজ্য জ্বালাও পোড়াও তাণ্ডব চালিয়ে সাধারণ মানুষকে নির্বিচারে হত্যার হলি খেলায় মেতে ওঠে। তাদের সাথে যোগ দেয় তাদের দোষররা।

কোনো একজন অর্থনীতিবিদ বলেছেন, একটি দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা যতটা ভালো সে দেশের ধর্মকর্ম ততটা মজবুত। আমাদের দেশের নিম্ন বা নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা তত বেশি মজবুত না বলে তারা ধর্মকর্মের ক্ষেত্রে কখনো প্রবল থাকলেও সর্বসময় স্থির থাকতে পারে না। এ দুর্বলতার সুযোগে কিছু কৌশলধারী লোকের দ্বারা মগজ ধোলাইর মাধ্যমে নিজেদের অবস্থান থেকে কখনো বিচ্যুত হয়। ইহকাল বা পরকালের দোহাই দিয়ে প্রলোভন ও ভয় দেখিয়ে মগজ ধোলাই করে তাদের পরিবর্তন করে থাকে। তারা এসব লোকদের দলে টেনে দল ভারী করতে সমর্থ হয়। জান্নাতের লোভ দেখিয়ে তাদের নিজেদের স্বার্থে জঙ্গি তৎপরতায় সম্পৃক্ত করতে সমর্থ হয়। এসব অজ্ঞানী লোকেরা না বুঝে কৌশলধারী লোকদের খপ্পরে পড়ে যেমন আত্মাহুতি দিতে কার্পণ্য করে না তেমনি অন্যের জীবন হরণ করতেও দ্বিধাবোধ করে না। এদের স্বার্থান্বেষীমহল ব্যবহার করে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের অর্থনৈতিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তথাকথিত মোল্লা মুসল্লিরা নিজেদের মনগড়া তালিম দিয়ে তাদের রপ্ত করতে সিদ্ধহস্ত। সাধারণ ধর্মপ্রাণ লোক নগদে কিছু না পেলেও তাদের সহজ সরল মনে এসব ওয়াজিদের বক্তব্যে বিভ্রান্ত হয়ে থাকে। আর তাতে এসব ওয়াজিরা সাধারণ শ্রোতাদের সমর্থন লাভ করে সন্তুষ্ট চিত্তে আস্তানায় ফিরে যায়। তারা ধরে নেয় তাদের সঙ্গে দেশের সাধারণ জনগণ আছে। এ ধারণা বদ্ধমূল থেকে ইসলাম নামধারী কেউ কেউ সরকারবিরোধী আন্দেলনে হুঙ্কার দিতে কুণ্ঠাবোধ করে না। মুখে যা আসে তাই অবলীলায় বলে যায়। দেশের প্রচলিত আইন-কানুন, ন্যায়-অন্যায়ের তোয়াক্কা করে না। তাদের কারো মুখে এমন কথা বলে যে, ‘ আমি রাষ্ট্রপতি মানি, যদি সে ইসলাম মানে। প্রধানমন্ত্রী মানি, যদি সে ইসলাম মানে। এই কচুর প্রধানমন্ত্রী মানি না যদি সে ইসলামের বিরুদ্ধে যায়।’ তার এহেন দাম্ভিক অবাস্তব উসকানিমূলক বক্তব্য মানুষকে হতভম্ব করে তোলে। দেশের প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতি ইসলাম মানে না এটা সে কোথায় পেলো? দেশের প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতির প্রতি তার এত আক্রোশ কেন? এরূপ অসম্মানজনক উক্তি বিচারযোগ্য অপরাধ। মুখরোচক ওয়াজ বক্তৃতা দিয়ে এসব স্বার্থান্বেষীমহল সাধারণ লোককে বিভ্রান্তির বেড়াজালে আবদ্ধ করতে চায়।

নিজেদের যেকোনোভাবে অর্থ-বৈভব বা ক্ষমতাবান করার লক্ষ্যে ধর্মের দোহাই দিয়ে ফতোয়াবাজি করে সাধারণ ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। মিটিং-মিছিলে উচ্চস্বরে উত্তপ্ত আগুন ঝরা বক্তৃতা দিয়ে সাধারণ মানুষকে বোকা বানিয়ে নিজেদের হীনস্বার্থ কায়েমে জ্বালাও পোড়াও ধ্বংস লীলায় মেতে ওঠে। ইসলামের আলোকে ধর্মীয় শিক্ষায় জীবন পরিচালনায় কুরআন-হাদিসের ব্যাখ্যা তুলে ধরলেও স্বার্থ এবং অর্থ লিপ্সায় ধর্মের ভাবগাম্ভীর্য বজায় না রেখে দিনের পর দিন তারা উল্লাস উচ্ছৃঙ্খল বক্তব্য ও অসৎ কর্মকাণ্ডে নিজেদের লিপ্ত রাখে। প্রকৃত পক্ষে ধর্মকে খাটো করছে। বিনা কারণে জ্বালাও পোড়াও নির্বিচারে মানুষ হত্যা ঔদ্ধত্যমূলক উত্তপ্ত ভাষণ এবং উচ্ছৃঙ্খল আচরণ ইসলাম ধর্মকে আমাদের দেশে জঙ্গি ধর্ম নামে এরাই আখ্যায়িত করছে। ধর্মের সুনাম ধ্বংস করছে। তাদের কার্যকলাপে মহান জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে যথার্থই বলেছেন- ‘কিছু লোকের জন্য এই ধর্মে জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের নাম জুড়ে যাচ্ছে। এরা ধর্মের নামে ব্যবসা শুরু করেছে। এদের এত অর্থ কোথা থেকে আসে? এই বিনোদনের টাকা কোথা থেকে আসে সেটাও একটা প্রশ্ন।’ তাদের প্রতি সাধারণ মানুষেরও প্রশ্ন যারা ধর্মকর্ম পবিত্রতা শিখাবে তারা নিজেরাই যদি অপকর্মে লিপ্ত হয় তবে মানুষ ধর্মকর্ম শিখবে কার কাছে। তাদের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেললে সে ক্ষতি তাদেরই হবে। ধর্ম প্রচারে যারা লিপ্ত তাদের কারো অপকর্মের দায়ে কিছুটা হলেও ধমের্র সুনাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাদের কর্মকাণ্ড দেখে সাধারণ মানুষ বিবেকহারা হয়ে যায়। এর অবসান হওয়া দরকার। এর অবসান হতে পারে নিজেদের স্বার্থে কুরআন-হাদিসের অপব্যাখ্যা না করে সুকর্মে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা। ধর্মের পবিত্রতা ও শান্তি বজায় রাখা। সামাজিকভাবে বিভাজন সৃষ্টি না করে সহনশীলতার আবর্তে ভাবগাম্ভীর্যে ধর্ম প্রচারে ব্রত থেকে ধর্মের শানিত বাণী প্রচার করা। ইসলামের দৃষ্টিতে মানব জাতির কল্যাণে মানবতাকে জাগ্রত রেখে সবাইকে নিয়ে একত্রে পথ চলা। ইসলামের আলোকে শান্তির পথ সুগম করা। যেখানে থাকবে না হিংসা দ্বেষ অপকর্মের লেসমাত্র। ব্যক্তি-গোষ্ঠী স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে আল্লাহর পথে মানবকল্যাণে এগিয়ে আসতে হবে। ধর্মের নামে ব্যক্তি-গোষ্ঠীর স্বার্থে অরাজকতা নয়। খোলা চোখ এমনটাই বলছে।

লেখক : কলামিস্ট, কবি

আমারসংবাদ/জেআই