Amar Sangbad
ঢাকা বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪,

ব্যাংকের উপশাখায় আগ্রহ বেশি

জাহাঙ্গীর আলম

এপ্রিল ১৫, ২০২১, ০৮:১০ পিএম


ব্যাংকের উপশাখায় আগ্রহ বেশি
  • দুই কর্মকর্তা দিয়েই অফিসে চলে সব সেবা
  • সব জায়গা ব্যাংকিং সেবা দিতে এ উদ্যোগ -বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র
  • অল্প সময়ে সেবা দিতেই উপশাখায় নজর দেয়া হয় -মো. মুখতার হোসেন, এনআরবিসি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক

করোনায় ভাইরাসে দূরে যাওয়া ঝামেলা। কৃষিমার্কেট যেতে হবে না। বসিলায় ইসলামী ব্যাংকের উপশাখা হয়েছে। সেখানেই লেনদেন করা যাবে। বেশি সময় লাগবে না। ভাড়াও লাগবে না। হাতের নাগালেই ব্যাংকিং সুবিধা বলে জানান রফিকুল ইসলাম। এত সহজে ব্যাংকিং সুবিধায় খুশি তিনি। শুধু গ্রাহক নন, ইসলামী ব্যাংকসহ অন্যান্য ব্যাংক কর্তৃপক্ষও কম খরচে বেশি জায়গায় সেবা দিতে অগ্রহী হয়ে উঠছে। কারণ মাত্র এক হাজার বর্গফুট জায়গায় দুই কর্মকর্তা দিয়েই বৈদেশিক বাণিজ্য ছাড়া সব ব্যাংকিং সেবা দেয়া যাচ্ছে। এ জন্য ৬১টি ব্যাংকের মধ্যে অল্প সময়ের ব্যবধানে বর্তমানে ৩০টি ব্যাংক উপশাখার মাধ্যমে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও সেবা দিতে পারছে। এর মধ্যে এনআরবিসি ব্যাংক সবচেয়ে বেশি উপশাখা খুলেছে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম আমার সংবাদকে বলেন, সাধারণত একটা ব্যাংকের শাখা অফিস করতে অনেক জায়গা লাগে, চার থেকে পাঁচ হাজার বর্গফুট। ভাড়াও বেশি দিতে হয়। অনেক লোকবলও লাগে। অপারেশন ব্যয়ও বেশি লাগে। এতে ব্যাংকের পরিচালনা খরচ অনেক বেশি হয়। তাই খরচ কমাতে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দেয়া হলে দেরিতে হলেও তারা বুঝতে পেরে কম খরচে বেশি করে সেবা দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। এ জন্য শহরের ছোট ছোট জায়গার মতো প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দেয়া সম্ভব হয়েছে। কারণ মাত্র এক হাজার বর্গফুট জায়গায় মাত্র দুই জন অফিসার দিয়ে উপশাখার কার্যক্রম পরিচালনা করা যাচ্ছে। তাতে টাকা জমা থেকে শুরু করে আমানত, ঋণ কার্যক্রমও পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে।

সব জায়গা ব্যাংকিং সেবা দিতে এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। যারাই আবেদন করছে নিয়ম মেনে তাদের অনুমোদন দেয়া হচ্ছে বলেও জানান তিনি। বাংলাদেশে প্রথম উপশাখা চালু করে এনআরবিসি ব্যাংক। জানতে চাইলে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মুখতার হোসেন এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘সরকারের বিভিন্ন সেবা জনগণের কাছে অল্প সময়ে পৌঁছে দিতেই উপশাখা চালু করার উদ্যোগ নেয়া হয়। বিআরটিএ, ভূমি নিবন্ধন অফিসে অল্প সময়ে গ্রাহকদের সেবা দিতেই আমরা তৎপর হয়ে উঠি। সব ভূমি নিবন্ধন অফিসে এর সেবা সম্প্রসারণ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। দনিয়ায় প্রথমে শুরু করে এ পর্যন্ত ৪২৩টি উপশাখা চালু করা হয়েছে। আরও কয়েকশ আবেদন করা হয়েছে। অনুমোদন পেলেই কার্যক্রম শুরু করা হবে। উদ্দেশ্য সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী কম খরচে অল্প সময়ে সবাইকে ব্যাংকিং সেবার আওতায় আনা।’    

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, তফসিলভূক্ত ব্যাংকের শাখা খুলতে অনেক অর্থ ব্যয় করতে হয়। প্রায় চার থেকে পাঁচ হাজার বর্গফুটের জায়গা, ডেকোরেশন ও প্রতি মাসে ভাড়া বাবদ লাখ লাখ টাকা ব্যয় করতে হয়। শাখা ম্যানেজারসহ অনেক কর্মকর্তাও লাগে। সাথে ইউটিলিটি, আপ্যায়নসহ অন্য ব্যয়ও রয়েছে। এ জন্য ব্যাংকের সংখ্যা বাড়লেও কয়েক বছর থেকে শাখা বাড়ছে না। বর্তমানে ৬১টি তফসিলভূক্ত ব্যাংকের শাখার পরিমাণ হচ্ছে ১০ হাজার ৭৫২টি। অপরদিকে তৃণমূলে ব্যাংকিং ইনক্লশনের (ব্যাংক সেবা) লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে সরকার। এ জন্য ব্যাংকগুলো অল্প ব্যয়ে বেশি সেবার দিকে ঝুঁকছে। কারণ বৈদেশিক বাণিজ্যিক (এলসি ওপেন) কার্যক্রম ছাড়া এসব উপশাখার মাধ্যমে ঋণ বিতরণ, আমানত সংগ্রহসহ যাবতীয় ব্যাংকিং সেবা দেয়া যাচ্ছে। কাছের একটি শাখার আওতায় উপ-ব্যবস্থাপকের নেতৃত্বে উপশাখার কার্যক্রম পরিচালনা করে তা শাখার সাথে যোগ করা হয়। সূত্র আরও জানায়, বাংলাদেশে ২০১৮ সালের অক্টোবরে রাজধানীর দনিয়ায় প্রথম উপশাখার ধারণা নিয়ে কাজ শুরু করে চতুর্থ প্রজন্মের এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক। এরপর ওই বছরের ডিসেম্বরে ব্যাংকের ব্যবসায়িক কেন্দ্র স্থাপন-বিষয়ক নীতিমালায় বুথ ব্যাংকিংকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তবে বুথ ব্যাংকিং শব্দ নিয়ে অনেকের মধ্যে অস্পষ্টতা থাকায় ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে নীতিমালা সংশোধন করে নামকরণ করা হয় উপশাখা। এরপর স্বল্প সময়ে বর্তমানে ৩০টি ব্যাংক উপশাখা কার্যক্রম শুরু করে ব্যাংকিং সেবা দিচ্ছে। ২০২০ সালের মার্চে করোনা ভাইরাস মহামারি সংক্রমণে ব্যাংকিং সেবা সীমিত করা হলে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে উপশাখা। করোনার প্রকোপ দীর্ঘায়িত হলে সারা দেশে ব্যাপকভাবে ঝুঁকেছে ব্যাংকগুলো। বর্তমানে এক হাজার ১৪৭টি উপশাখার মাধ্যমে ৩০টি ব্যাংক সেবা দিচ্ছে। একেবারে প্রত্যন্ত এলাকায় উপশাখা খুলে খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে বেশি মুনাফাও করতে পারছে ব্যাংক। এ জন্য ব্যাংকগুলো নতুন শাখা খোলার গতি একেবারে কমিয়ে এনেছে। গত বছর সব ব্যাংক মাত্র ১০৩টি শাখা খুলেছে। যেখানে ২০১৯ সালে খুলেছিল ২৮৭ শাখা। এর আগে কয়েক বছর গড়ে তিন শতাধিক শাখা খুলত। অথচ ২০১৮ সালের অক্টোবরে একেবারে নতুন ধারণা নিয়ে শুরু হওয়া উপশাখার সংখ্যা বাড়ছে। দেশে তফসিলভূক্ত ৬১ ব্যাংকের মধ্যে এখন পর্যন্ত ৩৭ ব্যাংক উপশাখা খোলার অনুমোদন নিয়েছে। তবে কার্যক্রম শুরু করেছে ৩০টি। এসব ব্যাংকের মোট উপশাখা পৌঁঁছেছে এক হাজার ১৪৭টি। এর মধ্যে শীর্ষে থাকা ১০ ব্যাংক খুলেছে এক হাজার ৩০২টি। বাংলাদেশ ব্যাংকও কম খরচে এসব উপশাখার সেবাকেন্দ্র খোলার প্রতি ব্যাংকগুলোকে উদ্বুদ্ধ করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকসহ অন্য ব্যাংক সূত্র জানায়, এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ ৪২৩ উপশাখা খুলেছে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক। আরও দেড় শতাধিক উপশাখা খোলার প্রক্রিয়া করছে ব্যাংকটি। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৩৯০ উপশাখা খুলেছে আইএফআইসি ব্যাংক। তৃতীয় সর্বোচ্চ ১৬১টি খুলেছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ। আরও অনেক আবেদন করা হয়েছে। অনুমোদন পেলে কার্যক্রম শুরু করা হবে বলে সূত্র জানায়।  চতুর্থ অবস্থানে থাকা সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক খুলেছে ৭২ উপশাখা। পঞ্চম অবস্থানে থাকা ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক খুলেছে ৬৬টি। তালিকার মধ্যে ইউসিবিএলের রয়েছে ৫৯টি, এক্সিমের ৫৪টি, যমুনা ব্যাংকের ৩৮টি, মিউচ্যুয়াল ট্রাস্টের ৩২টি এবং ওয়ান ব্যাংকের রয়েছে ২৫ উপশাখা। মূলত ব্যাংকগুলো বর্তমানে কম খরচে মানুষের কাছে সেবা পৌঁছানোর জন্য উপশাখার মাধ্যমে সেবার দিকে জোর দিয়েছে। নতুন শাখা খুলার ঝামেলা থাকায় সেবার হাত বাড়াতে মার্চে সরকারি বেসিক ব্যাংকও পাঁচ উপশাখা খুলেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, সেখানে শাখা খোলার মতো একাধিক ভবন নেই সেখানে একই ভবনে দুটি উপশাখার অনুমোদন দিতেও কোনো বাধা নেই। ব্যাংকগুলো আবেদন করলেই তাদের অনুমোদন দেয়া হচ্ছে। কম খরচে উপশাখার মাধ্যমে যে যার মতো করে কার্যক্রম চালাতে পারছে। শহরের পাশাপাশি প্রত্যন্ত অঞ্চলেও উপশাখা বেশি খোলা হচ্ছে। যেখানে অর্থ বহনের সুবিধা রয়েছে, সেখানেই অনুমোদন দেয়া হচ্ছে। কারণ সরকার চাচ্ছে সবাই যাতে ব্যাংকিং সেবার আওতায় আসে। উপশাখায় পূর্ণাঙ্গ একটি শাখার মতোই গ্রাহকরা ঋণ আবেদন, আমানত সংরক্ষণ, টাকা স্থানান্তর, ইউটিলিটি বিল পরিশোধ, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স বিতরণসহ সব ধরনের সেবা পাচ্ছেন।  সূত্র আরও জানায়, সারা দেশে ৬১টি ব্যাংকের ১০ হাজার ৭৫২টি শাখা রয়েছে। এর মধ্যে আরবানে (শহর) পাঁচ হাজার ৫৩১টি এবং রুরালে (গ্রাম) পাঁচ হাজার ২২১টি। রাষ্ট্রীয় ছয়টি ব্যাংকের তিন হাজার ৭৯৮টি শাখার মধ্যে শহরে এক হাজার ৭৬১টি শাখা থাকলেও গ্রামে রয়েছে দুই হাজার ৩৭টি। সবচেয়ে বেশি সোনালী ব্যাংকের শাখা রয়েছে এক হাজার ২২৪টি। এর মধ্যে শহরে ৫১৩টি এবং গ্রামে ৭১১টি। দ্বিতীয় পর্যায়ে রয়েছে অগ্রণী ব্যাংকের ৯৬০টির মধ্যে শহওে ৪৫২টি ও গ্রামে ৫০৮টি। জনতার ৯১২টির মধ্যে শহরে ৪৫২টি এবং গ্রামে ৫০৮টি। রূপালীর ৫৮৩টির মধ্যে শহরে ২৮৮ এবং গ্রামে ২৯৫টি শাখার মাধ্যমে সেবা দিচ্ছে। আর বেসরকারি ৪৩টি ব্যাংকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পুবালী ব্যাংকের শাখা রয়েছে ৪৮২টি। এর মধ্যে শহরে ২৮৪টি এবং গ্রামে ১৯৮টি। আর দ্বিতীয় পর্যায়ে ইসলামী ব্যাংকের ৩৭৩টি শাখার মধ্যে শহরে ২৩১ এবং গ্রামে ১৪২টি। এভাবে সব ব্যাংকেরই শহরের মতো গ্রামে শাখা গড়ে উঠেছে। তারপরও সব এলাকায় মানুষের কাছাকাছি ব্যাংকিং সেবা পৌঁছাতে না পারায় উপশাখা, এজেন্ট ব্যাংকিং ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে সেবা নিশ্চিত করা হচ্ছে বলে সূত্র জানায়। 

আমারসংবাদ/জেআই