Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪,

রহমত মাগফিরাত এবং নাজাতের মাস রমজান

মুফতি মোহাম্মদ ইব্রাহিম খলিল

এপ্রিল ১৫, ২০২১, ০৮:১০ পিএম


রহমত মাগফিরাত এবং নাজাতের মাস রমজান

রমজান মাস সিয়াম সাধনা ও তাকওয়ার মাস, কল্যাণ ও বরকতের মাস, রহমত ও মাগফিরাত এবং জাহান্নামের অগ্নি থেকে মুক্তি লাভের মাস। মহান আল্লাহ এ মাসটিকে বহু ফযীলত ও মর্যাদা দিয়ে অভিষিক্ত করেছেন। রমজান আল-কুরআনের মাস, আল্লাহ রমজানকে কুরআন নাযিলের মর্যাদাপূর্ণ সময়রুপে চয়ন করেছেন। তিনি বলেন, ‘রমযান মাস- এতে কুরআন নাযিল হয়েছে’ (সূরা বাকারাহ, ১৮৫)। এ মাসে জান্নাতের দ্বারসমূহ উন্মুক্ত রাখা হয়, জাহান্নামের দ্বারসমূহ রুদ্ধ করে দেয়া হয় এবং শয়তান ও দুষ্ট জিনদের শৃংখলিত করে রাখা হয়। রাসূল (স:)  বলেন, রমযান মাসে এলে জান্নাতের দ্বারসমূহ উন্মুক্ত রাখা হয়, জাহান্নামের দ্বারসমূহ রুদ্ধ করে দেয়া হয় এবং শয়তানদের শৃংখলিত করা হয়, (বুখারী, ১৮০০)। এ মাসে রয়েছে বরকতময় রজনী।  মহান আল্লাহ বলেন, ‘লাইলাতুল ক্বদর হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। এ রাত্রে ফেরেশতাগণ ও রূহ অবতীর্ণ হন, প্রত্যেক কাজে, তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে। শান্তিময় এ রজনী, ঊষার আবির্ভাব পর্যন্ত’ (ক্বদর, ৫)।

রমজান দুআ কবুলের মাস। রাসূল (স:)  বলেন, রমযানের প্রতি দিন ও রাতে (জাহান্নাম থেকে) আল্লাহর কাছে বহু বান্দা মুক্তিপ্রাপ্ত হয়ে থাকে। তাদের প্রত্যেক বান্দার দুআ কবুল হয়ে থাকে (যা সে রমযান মাসে করে থাকে), (আহমদ, ৭৪৫০)। ত্বাকওয়া অর্জনের এ মুবারক মাসে মুমিনদের উপর অর্পিত হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব, সৃষ্টি হয়েছে পূণ্য  অর্জনের বিশাল সুযোগ এবং প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে মহান চরিত্র অর্জনের সুন্দর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। এ অর্পিত দায়িত্ব পালন এবং সুবর্ণ সুযোগের সদ্ব্যবহার করে আজ সারা বিশ্বের মুসলিমদের উচিত চারিত্রিক অধ:পতন থেকে নিজেদের রক্ষা করা, নেতিয়ে পড়া চেতনাকে জাগ্রত করা এবং সকল প্রকার অনাহুত শক্তির বলয় থেকে মুক্ত হয়ে হক প্রতিষ্ঠার প্রতিজ্ঞাকে সুদৃঢ় করা, যাতে তারা রিসালাতের পবিত্র দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারে এবং কুরআন নাযিলের এ মাসে কুরআনের মর্ম অনুধাবন করতে পারে, তা থেকে হিদায়াত লাভ করতে পারে এবং জীবনের সর্বক্ষেত্রে একেই অনুসরণের একমাত্র মত ও পথ রূপে গ্রহণ করতে পারে।

রোযার গুরুত্ব এবং ফযিলত: রোযার রয়েছে অনেক গুরুত্ব এবং ফযিলত। রোযার পুরস্কার আল্লাহ স্বয়ং নিজে প্রদান করবেন, হাদীসে কুদসীতে রাসূল (স:) বলেন, আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘বনী আদমের সকল আমল তার জন্য, অবশ্য রোযার কথা আলাদা, কেননা রোযা আমার জন্য এবং আমিই এর পুরস্কার দিব’ (বুখারী, ১৮০৫)। রোযা রাখা গুনাহের কাফফারা স্বরূপ এবং ক্ষমা লাভের কারণ। রাসূল (স:) বলেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সাওয়াবের আশায় রমযান মাসে রোযা রাখবে, তার পূর্বের সকল গোনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে, (বুখারী, ১৯১০)। রোযা জান্নাত লাভের পথ। রাসূল (স:)  বলেন, ‘জান্নাতে একটি দরজা রয়েছে যাকে বলা হয় ‘রাইয়ান’ - কিয়ামতের দিন এ দরজা দিয়ে সায়িমগণ প্রবেশ করবে। অন্য কেউ এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। সায়িমগণ প্রবেশ করলে এ দরজা বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে আর কেউ সেখান দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না, (বুখারী, ১৭৯)। সায়িমের জন্য রোযা শাফায়াত করবে। রাসূল (স:) বলেছেন, রোযা এবং কুরআন কিয়ামতের দিন বান্দার জন্য শাফায়াত করবে। রোযা বলবে, হে রব! আমি তাকে দিবসে পানাহার ও কামনা চারিতার্থ করা থেকে নিবৃত্ত রেখেছি। অতএব, তার ব্যাপারে আমাকে শাফায়াত করার অনুমতি দিন, (মুসনাদ, ৬৬২৬)। সায়িমের মুখের দুর্গন্ধ আল্লাহর কাছে মিসকের সুগন্ধির চেয়েও উত্তম। রাসূল (স:) বলেন, ‘যার হাতে মুহাম্মাদের প্রাণ তার শপথ! সায়িমের মুখের গন্ধ কিয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে মিসকের চেয়েও সুগন্ধিময়, (বুখারী, ১৮৯৪)।

রোযা ইহ-পরকালে সুখ-শান্তি লাভের উপায়। রাসূল (স:) বলেন, ‘সায়িমের জন্য দু’টো খুশীর সময় রয়েছে। একটি হলো ইফতারের সময় এবং অন্যটি স্বীয় প্রভু আল্লাহর সাথে মিলিত হওয়ার সময়, (বুখারী, ১৮০৫)। রোযা জাহান্নামের অগ্নি থেকে মুক্তিলাভের ঢাল। রাসূল (স:) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় একদিন রোযা রাখে, আল্লাহ তাকে জাহান্নাম থেকে সত্তর বৎসরের দূরত্বে নিয়ে যান, (বুখারী, ২৬৮৫)।

মাহে রমযানের ইবাদতে কিছু পরামর্শ: এক: সায়িমকে ইফতার করানো।  রাসুল (স:) বলেন, যে ব্যক্তি কোন সায়িমকে ইফতার করায়, সে উক্ত সায়িমের সাওয়াবের কোনরূপ ঘাটিত না করেই তার সমপরিমাণ সওয়াব লাভ করবে, (তিরমিযী, ৮০৭)। দুই: কিয়ামুল লাইল নিয়মিত করা। তারাবীহ, তাহজ্জুদ এবং রাতের যে কোন নফল স্বলাত এর অন্তর্ভূক্ত। যে সকল আমলের মাধ্যমে মু’মিন ব্যক্তি রমাদ্বন মাসে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করতে পারে, তন্মধ্যে কিয়ামুল লাইল সবচেয়ে উত্তম। রাসুল (স:) বলেন, ফরয স্বলাতের পর সর্বোত্তম স্বলাত হচ্ছে রাতের স্বলাত, (মুসলিম, ২৮১২)। রাতের স্বলাতের প্রশংসায় আল্লাহ তায়ালঅ বলেন, রহমানের বান্দাহ তারাই, যারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে এবং মূর্খ ব্যক্তিরা যখন তাদেরকে সম্বোধন করে কথা বলে, তখন তারা বলে, ‘সালাম’ এবং যারা রাত্রিযাপন করে তাদের পানলকর্তার উদ্দেশ্যে সেজদাবনত হয়ে ও দন্ডায়মান হয়ে,(সূরা ফুরকান, ৬৪)। আল্লাহ অন্যত্র বলেন, রাতের কিয়দংশে তারা নিদ্রা যেত এবং রাতের শেষ প্রহরে তারা ক্ষমা প্রার্থনা করত, (সূরা যারিয়াত, ১৮)। তিন: কুরআন তেলাওয়াত করা এবং এর মর্ম উপলব্ধি করা। রমযান মাস কুরআন নাযিলের মাস। এ মাসে রাসুল (স:) জিবরীলের সাথে কুরআন পাঠ করতেন। তার সীরাত অনুসরণ করে প্রত্যেক মু’মিনের উচিত এ মাসে বেশী বেশী কুরআন তেলাওয়াত করা, বুঝা এবং আমল করা। ইবনু আববাস (রা) বলেন, জিবরীল রমযানের প্রতি রাতে এসে রাসুলের (স:) সাথে সাক্ষা  করতেন এবং তাকে নিয়ে কুরআন পাঠ করতেন, (বুখারী, ৩০৪৮)। যে ব্যক্তি কুরআন পাঠ করে এবং সে অনুযায়ী আমল করে, তার ব্যাপারে আল্লাহ এ নিশ্চয়তা দিয়েছেন যে, সে দুনিয়ায় ভ্রষ্ট হবে না এবং আখিরাতে দুর্ভাগা- হতভাগাদের অন্তর্ভুক্ত হবে না। আল্লাহ বলেন, সুতরাং যে আমার দেয়া হিদায়াতের পথ অনুসরণ করবে, সে পথভ্রষ্ট হবে না এবং দু:খ-কষ্টে পতিত হবে না, (সূরা ত্বহা, ১২৩)। উসমান (রা:) রমযানে প্রতিদিন একবার কুরআন খতম করতেন। সলফে সালেহীন স্বলাতে ও স্বলাতের বাইরে কুরআন খতম করতেন। রমযানের কিয়ামুল লাইলে তাদের কেউ তিনদিনে, কেউ সাতদিনে এবং কেউ দশদিনে কুরআন খতম করতেন। ইমাম যুহরী রমযান এলেই হাদীস পাঠ ও ইলমের মজলিস ত্যাগ করে কুরআন পাঠে লেগে যেতেন। খেয়াল রাখতে হবে যে, কুরআন কারীম শুধু খতম করার জন্যই নাযিল হয়নি। তাই কোনরূপ অর্থ না বুঝে, চিন্তাভাবনা না করে অন্তরে আল্লাহ ভীতি ও বিনম্রভাব সৃষ্টি না করে কবিতার মত কুরআন আবৃত্তি করে যাওয়া আমাদের মূল লক্ষ্য হওয়া ঠিক নয়। কেননা আল্লাহ নিজেই বলেন, ‘এটি একটি বরকতময় কিতাব, যা আমি আপনার প্রতি অবতীর্ণ করেছি, যাতে মানুষ এর আয়াতসমূহ অনুধাবন করে এবং বোধশক্তি সম্পন্ন ব্যক্তিগণ গ্রহণ করে উপদেশ, (সূরা সোয়াদ, ২৯)। চার: আল্লাহর রাস্তায় বেশী বেশী দান ও সদকা করা। আল্লাহর রাস্তায় দান-সদকা ও ব্যয় করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত। সব সময় যাতে সামর্থবান ব্যক্তিবর্গ এ ইবাদাত পালন করে সে ব্যাপারে ইসলাম ব্যাপক উৎসাহ প্রদান করেছে। আর রমাদ্বন মাসে এ ইবাদাতের তাৎপর্য ও গুরুত্ব আরো বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়। কেননা ইমাম বুখারী ইবনে আববাস (রা) হতে বর্ণনা করেন যে, রাসুল (স:) সকল মানুষের চেয়ে বেশী দানশীল ছিলেন। আর রমযান মাসে যখন জিবরীল তার সাথে সাক্ষাতে মিলিত হতেন তখন তিনি আরো দানশীল হয়ে উঠতেন। জিবরীলের সাক্ষাতে তিনি বেগবান বায়ুর চেয়েও বেশী দানশীল হয়ে উঠতেন, (বুখারী, ৩০৪৮)। পাঁচ: উমরা পালন করা। রাসুল (স:) বলেন, রমযান মাসে উমরা করা হজ্জের সমতুল্য’’ অথবা ‘‘আমার সাথে হজ্জ করার সমতুল্য, (বুখারী, ১৬৯০)। ছয়: ইতেকাফ করা। রমযান মাসের শেষ দশদিন ইতেকাফে বসা অতি উত্তম ইবাদাত। শুরুতে রাসুল (স:) রমযানের প্রথম দশদিন ইতেকাফে বসেন। এরপর লাইলাতুল ক্বদরের অনুসন্ধানে মাঝের দশদিন  ইতেকাফে বসেন। এরপর যখন লাইলাতুল ক্বদর শেষ দশদিনে হওয়া স্পষ্ট হয়ে গেল, তখন থেকে তিনি শেষ দশদিন ইতেকাফে বসতে লাগলেন। অত:পর তার মৃত্যুর পর তার স্ত্রীগণ ইতেকাফে বসেন। সাত: রমযানের শেষ দশদিনে লাইলাতুল ক্বদরের অনুসন্ধানে ব্যাপৃত থাকা। রাসুল (স:) বলেন, যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে এবং সওয়াবের আশায় ক্বদরের রাত্রিতে (স্বলাতে) দাঁড়ায়, তার পূর্ববর্তী সকল গোনাহ ক্ষমা করে দেয়া হল, (বুখারী, ১৮০২)। রাসুল (স:) রমযানের শেষ দশ রাতে নিজে লাইলাতুল ক্বদরের অনুসন্ধানে ব্যাপৃত থাকতেন এবং পরিবার পরিজনকে জাগিয়ে দিতেন। আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত, রাসুল (স:) রমযানের শেষ দশদিনে আল্লাহর ইবাদাতে এতটা পরিশ্রম করতেন যা তিনি অন্য সময় করতেন না, (মুসলিম, ২৮৪৫)। আট: বেশী বেশী দুআ, যিকর এবং ইস্তেগফার করা। রমযানের দিনগুলোতে পুরো সময়টাই ফযীলতময়। তাই সকলের উচিত এ বরকতময় সময়ের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করা- দুআ, যিকর ও ইসস্তেগফারের মাধ্যমে। কেননা রমযান মাস দুআআ কবুল হওয়ার খুবই উপযোগী সময়। নয়: সকল প্রকার ইবাদতে নিজেকে ব্যাপৃত রাখা।  রাসুল (স:) রমযান মাসে অন্য মাসের চেয়েও বেশী বেশী ইবাদাত করতেন। আল্লামা ইবনুল কাইয়েম (র.) বলেন, ‘রাসুলের (স:) আদর্শ ছিল রমযান মাসে সকল ধরনের ইবাদাত বেশী বেশী করা। তিনি ছিলেন সবচেয়ে দানশীল এবং রমযানে আরো বেশী দানশীল হয়ে যেতেন,  কেননা এ সময়ে তিনি সদকা, ইহসান ও কুরআন তেলাওয়াত, স্বলাত, যিকর ও ইতেকাফ ইত্যাদি সকল প্রকার ইবাদাত অধিক পরিমাণে করতেন। তিনি রমযানে এমন বিশেষ ইবাদাতসমূহ পালন করতেন যা অন্য মাসগুলোতে করতেন না,(যাদুল মাআ‘দ ১/৩২১)।

আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকল আমল কবুল করুন এবং আমাদের সবাইকে আরো উত্তম আমল করার তাওফীক দান করুন। আমীন।

লেখক : প্রভাষক (আরবি), চাটখিল কামিল মাদরাসা, নোয়াখালী

আমারসংবাদ/জেআই