Amar Sangbad
ঢাকা মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪,

হেফাজতে ভাঙনের সুর

এপ্রিল ১৬, ২০২১, ০৯:১০ পিএম


হেফাজতে ভাঙনের সুর
  • শাপলা চত্বরের ঘটনায় কথা দিয়েও ফের সহিংস হেফাজত হারিয়েছে কর্মীদের নিয়ন্ত্রণ
  • প্রথমে নিচের সারি হলেও এখন গ্রেপ্তার হচ্ছেন উপরের সারির নেতারাও, ঘটছে পদত্যাগের ঘটনাও
  • ২০১৩ সালে শাপলা চত্বরে তাণ্ডবের পর হেফাজতের বর্তমান আমির মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরীকে গ্রেপ্তার করা হলে তিনি কথা দিয়েছিলেন, আর কখনো কোনো সহিংস আন্দোলন করবেন না। কিন্তু তারা কথা রাখেননি -মো. মাহবুব আলম, যুগ্ম কমিশনার, ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ
  • মামুনুল হকের নৈতিক স্খলনের বিষয়টিও স্বীকার করে হতাশা ব্যক্ত করেছেন সংগঠনটির শীর্ষ নেতারা, তাকে বহিষ্কারের প্রস্তাবও করেছিল। যদিও জুনায়েদ বাবুনগরী তার গ্রেপ্তার এড়াতে সেই প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছেন

মুখের কথার সঙ্গে বাস্তবতার মিল নেই হেফাজতে ইসলাম নেতাদের। তাদের কথিত আন্দোলন আবার সহিংস রূপ ধারণ করেছে। নিজেদের কর্মীদেরও নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না তারা। যে সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে জামায়াত-শিবির ও বিএনপি কর্মীরাও। এ ছাড়া হেফাজতের আন্দোলনকে পুঁজি করে উগ্রবাদী জঙ্গিরাও ফায়দা নিচ্ছে বলে বলছেন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

তারা বলছেন, হেফাজতের এসব কর্মকাণ্ড নতুন করে ভাবিয়ে তুলছে প্রশাসনকে। হেফাজতে সৃষ্ট একাধিক বড় সমস্যার কথা মাথায় রেখেই সংগঠনটির সামপ্রতিক সহিংসতার পর কঠোর অবস্থানও নিয়েছে সরকার। সতর্ক করার পরও দেশের বিভিন্ন স্থানে জ্বালাও পোড়াও-ভাঙচুরের ঘটনায় প্রথম দিকে নিচের সারির কর্মীরা গ্রেপ্তার হলেও ধীরে ধীরে উপরের সারির নেতারাও এখন গ্রেপ্তার হচ্ছেন।

সংগঠনটির উগ্রতা নিয়ন্ত্রণে দেশব্যাপী সাঁড়াশি অভিযানও শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন গোয়েন্দা সংস্থার একাধিক কর্মকর্তা। তারা বলছেন, শীর্ষ পর্যায়ের আরও কয়েক নেতা নজরদারিতে রয়েছেন, শিগগিরই তারাও গ্রেপ্তার হতে পারেন। হেফাজতে ইসলামের সামপ্রতিক তাণ্ডবে সম্পৃক্ততার অভিযোগে সর্বশেষ গত বুধবার গ্রেপ্তার হন সংগঠনটির কেন্দ্রীয় দুই সহকারী মহাসচিব মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দি ও মুফতি শাখাওয়াত হোসাইন রাজী। 

গত ২৬ মার্চ ঢাকায় বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে সরকার সমর্থকদের সঙ্গে সংঘর্ষের পর চট্টগ্রামের হাটহাজারী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তাণ্ডব চালায় হেফাজতকর্মীরা। সে সময় গুলিতে নিহত হন চারজন। দুইদিন পর ব্রাহ্মণবাড়িয়া ছাড়াও নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান, হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ, কিশোরগঞ্জে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও আওয়ামী লীগের কার্যালয়েও হামলা চালানো হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সহিংসতার সময় দুই দিনে নিহত হন ১২ জন।  এরপর ৩ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ের রয়েল রিসোর্টে নারী নিয়ে মামুনুল হক অবরুদ্ধ হওয়ার পর হেফাজতকর্মীরা ওই এলাকা ছাড়াও মুন্সিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জে তাণ্ডব চালান। ওই ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল ও সরকারি দল আওয়ামী লীগের শীর্ষ স্থানীয় নেতারা হেফাজতকে সতর্ক করে বক্তব্য রাখতে থাকেন। অন্যদিকে, সামপ্রতিক ঘটনার পাশাপাশি ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বর তাণ্ডবের মামলাও আবার সচল করা হয়। ৫ মের মামলায় গত রোববার রাতে পুলিশ চট্টগ্রাম থেকে হেফাজতের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদীকে গ্রেপ্তার করে। এর এক দিন পরই গ্রেপ্তার হন সহপ্রচার সম্পাদক মুফতি শরিফউল্লাহ। তাকেও শাপলা চত্বরে তাণ্ডব মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। হেফাজতের নারায়ণগঞ্জ জেলা সেক্রেটারি মুফতি বশির উল্লাহকে গত ২৮ মার্চ নারায়ণগঞ্জ হরতাল চলাকালে তাণ্ডবের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। এ ছাড়া, ২৬ মার্চ বায়তুল মোকাররমে সংঘর্ষের মামলায় আসামি করা হয়েছে হেফাজত নেতা মামুনুল হককেও। ব্রাহ্মণবাড়িয়া, পটিয়া, হাটহাজারীতে  শতাধিক হেফাজতকর্মীকে গত কয়েক দিনে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পাশাপাশি গত সেপ্টেম্বরে হাটহাজারী মাদ্রাসায় হাঙ্গামার পর মারা যাওয়া হেফাজত আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফীকে হত্যার অভিযোগ এনে করা মামলায় গত রোববার যে প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে সেখানে হেফাজতের বর্তমান আমির জুনাইদ বাবুনগরীকেও আসামি করা হয়েছে।

পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, শাপলা চত্বরে সহিংসতার ঘটনায় হেফাজতের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে শুধু ঢাকাতেই মামলা হয়েছিল ৫৩টি। হেফাজতের শীর্ষ নেতাদের আসামি করা হয় সেসব মামলায়। চারটি মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয়া হয়েছে। আরও দুটি মামলার তদন্ত শেষে চূড়ান্ত প্রতিবেদন তৈরির অপেক্ষায় আছে। ২০১৩ সালে শাপলা চত্বরে ও সামপ্রতিক সময়ে হেফাজতের তাণ্ডবের সময় সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে ডিএমপির মতিঝিল জোনে। মতিঝিল জোনের উপ-পুলিশ কমিশনার সৈয়দ নূরুল ইসলাম বলছেন, ‘মামলার গ্রাউন্ড, মামলায় যা যা অভিযোগ আনা হয়েছে তার প্রতিটি বিষয় তদন্ত করা হবে। তদন্ত করে যারা দোষী প্রমাণিত হবেন, তাদের বিরুদ্ধেই চার্জশিট হবে। অপরাধী যেই হোক ছাড় দেয়া হবে না, তার কোনো রাজনৈতিক পরিচয় বিবেচনা করা হবে না।’ হেফাজতের বিরুদ্ধে পুরনো মামলাগুলো সচলের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘তদন্তাধীন মামলার বিষয়ে কখনো অগ্রগতি হয়; কখনো হয় না। আবার কিছু সময় আসে যখন এসব মামলাকে মনিটর করা হয় ও ত্বরিৎগতিতে নিষ্পত্তি করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। হেফাজত নেতাদের বিরুদ্ধে ২০১৩ সালের মামলাগুলো তদন্তাধীন ছিলো, এখন সেগুলো পুনরায় বিবেচনার সময় এসেছে।’

ডিএমপির গোয়েন্দা শাখার যুগ্ম কমিশনার মো. মাহবুব আলম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘২০১৩ সালে শাপলা চত্বরের তাণ্ডবের পর হেফাজতের বর্তমান আমির মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, তখন তিনি আমাদের কথা দিয়েছিলেন, হেফাজত আর কখনো কোনো সহিংস আন্দোলন করবে না। আরও কিছু বিষয়ে তারা নমনীয় হয়েছিল বলেই তখন তাদের ছাড় দেয়া হয়েছিল, কিন্তু তারা তাদের কথা রাখেননি। তাই বাধ্য হয়েই এখন কঠোর পন্থা অবলম্বন করতে হচ্ছে।’ একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারাও জানান, হেফাজতকে নিয়ন্ত্রণে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়েই এগোচ্ছে সরকার। এ বিষয়ে গত ৭ এপ্রিল সরকারের পক্ষ থেকে আইশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার কাছে পরিষ্কার নির্দেশনা এসেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গোয়েন্দা সংস্থার দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, ‘পরিকল্পনা বাস্তবায়নে দেশের সব গোয়েন্দা সংস্থা তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করলেও হেফাজত দমনে মাঠপর্যায়ের অভিযানে গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি) ও র্যাবকে নেতৃত্ব দিতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সামপ্রতিক অভিযানগুলোতেও এর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে।’  

এদিকে সরকারের কঠোর অবস্থানের মুখে হেফাজতে ভাঙনের মতো পরিস্থিতিও সৃষ্টি হয়েছে। গেলো ১৩ এপ্রিল জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে হেফাজতের নায়েবে আমির পদ থেকে সরে দাঁড়ান বাংলাদেশ ফরায়েজী আন্দোলনের সভাপতি মাওলানা আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ হাসান। হেফাজতে যোগ্য নেতৃত্বের অভাবকেই পদত্যাগের কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন তিনি। এ ছাড়া হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হকের নৈতিক স্খলনের বিষয়টিও স্বীকার করে হতাশা ব্যক্ত করেছেন সংগঠনটির শীর্ষ নেতারা। তাকে বহিষ্কারের প্রস্তাবও করেছিল একটি অংশ। তবে সংগঠনটির আমির জুনায়েদ বাবুনগরী সেই প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছেন। গ্রেপ্তার হওয়া হেফাজত নেতাদের জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে এমন তথ্য জানিয়েছে পুলিশ। এ ছাড়া হেফাজতের সামপ্রতিক তাণ্ডবে জামায়াত-শিবিরসহ জঙ্গিদের সম্পৃক্ততাও পাওয়া গেছে বলে জানায় পুলিশ। 

সোনারগাঁওয়ে রিসোর্টকাণ্ডের পর হাটহাজারী মাদ্রাসায় বসা জরুরি বৈঠকে মামুনুল হকের নৈতিক স্খলনের বিষয়টি স্বীকার করে হতাশা ব্যক্ত করেন সংগঠনটির শীর্ষ নেতারা। সংগঠন থেকে তাকে বহিষ্কারের প্রস্তাবও দেন আজিজুল হক ইসলামাবাদী। প্রস্তাবটি নাকচ করে দেন সংগঠনটির আমির জুনায়েদ বাবুনগরী। এই মুহূর্তে বহিষ্কার করা হলে তিনি গ্রেপ্তার হতে পারেন। ফলে এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসা হয়। মামুনুলের গ্রেপ্তার এড়াতে মাদ্রাসা খোলা রাখারও সিদ্ধান্ত হয়। রিসোর্টকাণ্ড তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি করা হয়। কমিটিতে রাখা হয় হেফাজতের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির মাওলানা হাফেজ তাজুল ইসলাম, সহকারী মহাসচিব শাখাওয়াত হোসাইন রাজী এবং হাটহাজারী মাদ্রাসার সিনিয়র শিক্ষক ড. মাওলানা নুরুল আফসার আজহারীকে। এ প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কমিশনার মাহবুব আলম বলছেন, মামুনুলের বিষয়ে হেফাজত হতাশ। তবে হেফাজতের সঙ্গে আরও অনেকেই জড়িত। বর্তমান প্রজন্মের স্বপ্নকে ধ্বংস করার জন্য হেফাজতের কর্মকাণ্ডকে যথেষ্ট বলে মনে করছে পুলিশ।

আমারসংবাদ/জেআই