Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪,

তৈলবাজ ও তৈলসংস্কৃতি

ড. মো. আব্দুল কুদ্দুস সিকদার

এপ্রিল ১৭, ২০২১, ০৮:৪৫ পিএম


তৈলবাজ ও তৈলসংস্কৃতি
  • ক্ষমতার পালাবদলে কেউ ক্ষমতাবান আর কেউ ক্ষমতাহীন হলেও ক্ষমতা ব্যবহারে এরা কিন্তু একটি কমন আইটেম। প্রত্যেকটা প্রতিষ্ঠানেই কমবেশি এ ধরনের চামচা, চামুচ, চামচিকার অস্তিত্ব থাকে। বলা হয় যে, হাড়ি পাতিলের পরিবর্তন হলেও রান্নাঘরের চামচগুলো ঠিক রয়ে যায় যুগের পর যুগ। চামচগুলোর কাজই হচ্ছে কর্মঠ লোকগুলোর পেছনে লেগে থাকা এবং তাদের বিরুদ্ধ বসের কান ভারী করে তাদেরকে দূরে সরিয়ে রাখা। ২০২১ ও ২০৪১ সালে বাংলাদেশকে যথাক্রমে মধ্যম ও উচ্চ আয়ের দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছি আমরা। কিন্তু এটা অর্জিত হলেও কি অযোগ্য তৈলবাজদের তৈলবাজির হাত থেকে মুক্ত হতে পারবে বাংলাদেশ? পরিবর্তন হবে কি আমাদের তৈলমর্দন স্বভাব ও সংস্কৃতির?

তৈলবাজ লোকের বিচরণ সমাজ ও রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। তাই তৈল, তৈলবাজ, তল্পিবাহক, ধামাধরা ও তৈলের যথাযথ ব্যবহার ইত্যাদি বিষয় নিয়ে নানাবিধ গল্প প্রচলিত আছে সমাজে। তেলের তেলেসমাতি তড়িৎ প্রবাহের মতো দ্রুততর এবং বিস্ময়কর রকমের কার্যকর এ জগতসংসারে। কাকে, কোন সময়, কীভাবে, কী পরিমাণ এবং কী তৈল প্রয়োগ করতে হবে সে বিষয়ে তৈলবাজরা সিদ্ধহস্ত। যিনি যত তৈলসিদ্ধ তার কার্যসিদ্ধি তত বেশি। তৈলবাজিতে এরা এতটাই দক্ষ যে, যে মানুষটি কোনোভাবেই তৈলবাজি পছন্দ করেন না, তিনিও একসময় চেয়ারের পাশে তৈলবাজরা না থাকলে নিজেকে অসহায় ও নিঃস্ব মনে করেন। পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ১২৮৫ বঙ্গাব্দে ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় ‘তৈল’ নিয়ে একটি চমৎকার প্রবন্ধ লিখে আলোড়ন তুলেছিলেন। সেখানে তিনি বলেছিলেন, ‘যাহা বলের অসাধ্য, যাহা বিদ্যার অসাধ্য, যাহা ধনের অসাধ্য, যাহা কৌশলের অসাধ্য, তাহা কেবল একমাত্র তৈল দ্বারা সিদ্ধ হইতে পারে।’ এমন অসাধারণ ব্যাখ্যার পর তেলের গুরুত্ব ও বাজার দর যে বেড়ে গেছে সে কথা অনস্বীকার্য। বঙ্গদেশে তৈলের সঙ্গে বাঙালির প্রথম পরিচয় ঘটে শিশুকালে তাদের নানি-দাদির হাতে। সকালের মিষ্টি রোদে পা ছড়িয়ে নাতিকে নিয়ে বসেন তারা আয়েশ করে। পাশেই থাকে তৈলের বাটি। তৈল মর্দনে তুলতুলে হয়ে ওঠে শিশুর শরীর। তৈলের সাথে জীবনের প্রথম পরিচিতির সে কথা অনেকেই আর ভুলতে না পেরে বয়সের সাথে সাথে সিদ্ধহস্ত হয়ে ওঠেন তৈলের প্রয়োগে।

তৈল স্নেহজাতীয় পদার্থ। সুতরাং তৈলের প্রয়োগ যথাযথ হলে চেয়ারের কাছে তৈলবাজের স্নেহ-আদরও বেড়ে যায়। তবে তৈল প্রয়োগের ক্ষেত্রে মাত্রাজ্ঞান থাকাটাও জরুরি। কারণ, তৈল বা স্নেহের মহিমায় জীবন যেমন চকচকে হতে পারে, তেমনি ফকফকাও হতে পারে। স্থানভেদে তিন ফোঁটার জায়গায় চার ফোঁটা হলেই বরবাদ। সুতরাং সিদ্ধহস্ত না হলে এ কাজে সিদ্ধিলাভ সম্ভব নয়। ‘যে দেবতা যে ফুলে তুষ্ট’ তা না দিতে পারলে যেমন দেবতার আশীর্বাদ বা অনুগ্রহ পাওয়া যায় না, তেমনি বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী বা চেয়ারের কর্তাব্যক্তিকে কোনো না কোনোভাবে সন্তুষ্ট করতে না পারলে বিড়ম্বনারও অন্ত থাকে না। তৈলবাজ লোকের একটি বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তৈল প্রয়োগের মাধ্যমে তারা সব সময় নিজ স্বার্থ উদ্ধারে সক্ষম হতে না পারলেও কর্তাব্যক্তির কানে বিষ ঢেলে যোগ্য মানুষগুলোকে পচানো বা কর্তাব্যক্তির কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখার কাজে এরা সিদ্ধহস্ত হয়।

দ্বিতীয়ত, তৈলবাজরা সব সময় কর্তাব্যক্তির সামনে মাথা নিচু করে এবং অনেক ক্ষেত্র বসের পায়ের দিকে চোখ রেখে অতি আপনজনের সুরে কথা বলে। কাজেই কর্তাব্যক্তি তাকে ব্যক্তিগতভাবে পছন্দ না করলেও তার কথা কিন্তু সবসময় অবিশ্বাস করেন না। ফলে তৈলবাজ নন এমন যোগ্য মানুষগুলো সহজেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সুকরাং তৈল গ্রহণকারী ব্যক্তির সচেতন হওয়া অত্যন্ত জরুরি এ কারণে যে, তৈলবাজ বা তোষামোদকারীরা নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থ আদায়ে সমাজের বড় বড় ক্ষতি করতেও দ্বিধাবোধ করে না এমনকি চেয়ারচ্যুতি হলে ওই তৈলবাজগুলোই তার বিরুদ্ধে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে এবং চেয়ারে নতুন আগত কর্মকর্তার আস্থাভাজনে পরিণত হয়। অনেক সময় তৈলবাজ গ্রুপ সংঘবদ্ধ হয়ে কাজ করে চেয়ারের আস্থাভাজন হয়। তৃতীয়ত, তৈলবাজদের অবস্থান সমাজের সর্বত্র, ক্ষমতার চারপাশে তাদের অবাধ বিচরণ। মৌমাছি যেভাবে গাছের উঁচু ডালে ঝুলে থেকে চাকের মধু তৈরি ও পাহারা দেয়, তেমনি তৈলবাজ মানুষগুলোও ক্ষমতার গায়ে গায়ে লেগে থেকে ক্ষমতার মধু আহরণে নিজেদের নিয়োজিত রাখে। বাইরের কেউ মৌচাকের মধু ভাঙতে গেলে যেমন মৌমাছি হুল ফুটিয়ে দেয়, তেমনি তৈলবাজরাও হুল ফুটানোর ন্যায় নানাবিধ কৌশল অবলম্বন করে অন্যদেরকে ক্ষমতাধর ব্যক্তির সংস্পর্শ থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। এসব মানুষ প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে ‘সুচ’ হয়ে প্রবেশ করে ‘ফাল’ হয়ে বের হয়ে আসে।

এ ধরনের বহু ঘটনার নজির থাকা সত্ত্বেও চেয়ারের কর্তাব্যক্তিদের কাছে তোষামোদকারীদের দাপট  কখনোই কমে না। এটাই ইতিহাসের নির্মম বাস্তবতা। বিগত কয়েক দশকে এ দেশে কয়েকবার ক্ষমতার পালাবদল হয়েছে। আমাদের দেশের রাজনীতিতে মুখোমুখি অবস্থানে থাকা রাজনৈতিক দলের ক্ষমতা হারানো ও প্রাপ্তির ফলে অনেকেই বেশ ক্ষমতাশালী বা প্রভাবশালী হয়েছেন, আবার কারো কারো ক্ষমতা হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। কিন্তু এর মধ্যেও সু-চতুর শ্রেণির তৈলবাজ বা তোষামোদকারীদের অবস্থানের তেমন কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় না। অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই তারা চেয়ারে আসা নতুন ব্যক্তিটির খুব আস্থাভাজনে পরিণত হন। ক্ষমতার পালাবদলে কেউ ক্ষমতাবান আর কেউ ক্ষমতাহীন হলেও ক্ষমতা ব্যবহারে এরা কিন্তু একটি কমন আইটেম। প্রত্যেকটা প্রতিষ্ঠানেই কমবেশি এ ধরনের চামচা, চামুচ, চামচিকার অস্তিত্ব থাকে।

বলা হয় যে, হাড়ি পাতিলের পরিবর্তন হলেও রান্নাঘরের চামচগুলো ঠিক রয়ে যায় যুগের পর যুগ। চামচগুলোর কাজই হচ্ছে কর্মঠ লোকগুলোর পেছনে লেগে থাকা এবং তাদের বিরুদ্ধে বসের কান ভারী করে তাদেরকে দূরে সরিয়ে রাখা। ২০২১ ও ২০৪১ সালে বাংলাদেশকে যথাক্রমে মধ্যম ও উচ্চ আয়ের দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছি আমরা। কিন্তু এটা অর্জিত হলেও কি অযোগ্য তৈলবাজদের তৈলবাজির হাত থেকে মুক্ত হতে পারবে বাংলাদেশ? পরিবর্তন হবে কি আমাদের তৈলমর্দন স্বভাব ও সংস্কৃতির? অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটলেই কি আমাদের জীবনবোধ, আদর্শিকতা ও পথচলায় আমরা উন্নত মানুষ হয়ে যাবো?

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, ঢাকা কলেজ

Kuddus222@yahoo.com

আমারসংবাদ/জেআই