Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪,

পেটের ক্ষুধা মেটাবে কে

এপ্রিল ১৮, ২০২১, ০৮:৩০ পিএম


পেটের ক্ষুধা মেটাবে কে
  • এবার রাজনৈতিক দলের কেউ মাঠে নেই শীর্ষ নেতারা  আক্রান্ত-ঘরবন্দি
  • শহরের মোড়ে মোড়ে ভিড় করেও খাবার মিলছে না
  • পুলিশের গাড়ি দেখলেই ভাসমান মানুষ ঘিরে ধরছে খাবারের জন্য
  • লকডাউন বাস্তবায়ন নিয়ে এবার শুধু পুলিশই সড়কে একা লড়ছে 
  • ঢাকার দুই মেয়রকেও গতবারের মতো ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে না 
  • দুর্বলতা স্বীকার করে বিএনপির দাবি ‘সর্বদলীয় কমিটি’ গঠনের
  • এই শহরে মন্ত্রী আছেন, মেয়র আছেন, নেতা আছেন, আমলা আছেন, কাউন্সিলর আছেন, দলের জন্য জীবন উৎসর্গকারী কর্মী আছেন। কিন্তু  দিন এনে দিন খাওয়া মানুষদের দেখার কেউ নেই -সোহরাব হাসান, সিনিয়র সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

দিন এনে দিন খাওয়া গরিব মানুষ, শ্রমিক, চালক ও নিম্নবিত্তরা মহাবিপদে। এবারের লকডাউনে কেউ তাদের খোঁজ নিচ্ছেন না। কার্যকরী ভূমিকা নিয়ে সরকার পাশে নেই। রাজনীতিবিদরা নেই। মেয়র ও কাউন্সিলররাও নেই। কোনো এনজিওকেও দেখা যাচ্ছে না। সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবীরা প্রথম লকডাউনে যেভাবে গরিবদের পাশে ছিলো এবার তারাও নেই। প্রশ্ন উঠেছে, অনিশ্চয়তার লকডাউনে গরিবদের ক্ষুধা মেটাবে কে? তাদের পাশে থাকবে কে?

খেটে খাওয়া মানুষকে মাস গেলে ভাড়ার জন্য বাড়িওয়ালা তাগাদা দিচ্ছে। স্কুল-কলেজের ফি, চিকিৎসা ব্যয়, পানি ও বিদ্যুতের খরচ সবই কড়ায়-গণ্ডায় পরিশোধ করতে হচ্ছে। গণপরিবহন না থাকায় অনেক ক্ষেত্রে যাতায়াতের খরচ প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। এ ছাড়া রমজানের শুরু থেকে শাক সবজির দাম বেড়েছে কয়েক গুণ। বেড়েছে সব জিনিসেরই দাম। লকডাউন চলমান রয়েছে। পথে পথে পুলিশের কঠোরতা কেউ বের হয়েও রেহাই পাচ্ছেন না। খাবারের সন্ধানে শহরের মোড়ে মোড়ে ভিড় করেও খাবার মিলছে না। লকডাউনে তিন বেলা খাবার জোটাতে হিমশিম খাওয়া মানুষের সংখ্যা বাড়লেও সরকারি-বেসরকারি সহায়তা বা প্রণোদনারও খোঁজ মিলছে না। গতকাল রোববার সন্ধ্যায় কাকরাইল মোড়ে দেখা গেছে একটি পুলিশের গাড়িকে ১৫-২০ জন ভাসমান মানুষ ঘিরে ধরেছে খাবারের জন্য। জানতে চাইলে পুলিশের এক সদস্য বলেন, এরা সারাদিন অপেক্ষা করেও মানুষ থেকে তেমন সাহায্য পায়নি। তাই তাদের ঘিরে ধরেছে। গাড়িতে থাকা কিছু খাবার তাদের দিয়ে রেহাই পায় পুলিশ সদস্যরা। এমন ঘটনা রাজধানীর বিভিন্ন জায়গাও ঘটছে বলে খবর পাওয়া গেছে।

এবার রাজনৈতিক দলের কেউ মাঠে নেই শীর্ষ নেতারা ঘরবন্দি : এবারের লকডাউনে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, বিএনপিসহ ১৪ দল ও ২০ দলীয় জোটের নেতাকর্মীরা মাঠে নেই। শীর্ষ নেতারা এখন ঘরবন্দি। গত বছর রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা খাবার নিয়ে, অর্থনৈতিক সাহায্য নিয়ে, প্রতিরোধকসামগ্রী মাস্ক ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার নিয়ে দাঁড়িয়েছে। মৃতদের দাফনে সহযোগিতা নিয়ে এবং ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা কৃষকের ধান কেটে দিয়ে পাশে ছিলেন— এবার অতীতের সেই দৃশ্যপট আর  চোখে পড়ছে না। তবে বিচ্ছিন্নভাবে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের অল্প কিছু লোক রান্না করা খাবার দিয়ে পাশে থাকতে দেখা গেছে। মানুষকে সচেতন করার জন্য বেশ কিছু উদ্যোগ থাকলেও এবার তাও নেই। বেসরকারি উদ্যোগের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। লকডাউন বাস্তবায়ন নিয়ে এবার শুধু পুলিশ একাই লড়ছে। অনেক ক্ষেত্রে হিমশিম খেতে এবং সামাল দিতে কষ্টকর দৃশ্য দেখা গেছে।

ঢাকার দুই মেয়রকেও গতবারের মতো ভূমিকা পালন করতে দেখা যাচ্ছে না : ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ও কাউন্সিলররা গত বছর খাবারসামগ্রী নিয়ে মানুষের পাশে থাকার ভূমিকা নজর কেড়েছে। তালিকা করে ঘরে ঘরে খাবার পৌঁছে দিয়েছেন। মানুষকে সহায়তা দিয়েছেন।  রান্না করা খাবারও বিতরণ করেছেন ঢাকার বিভিন্ন এলাকায়। এ বছর তাদেরও তৎপরতা নেই। সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে শাহ আলম বলেন, নিম্ন আয়ের লোকজন করোনায় আক্রান্ত হওয়া বা লকডাউনের চেয়েও বেশি গুরুত্ব দেয় উপার্জনকে। কারণ, সংসারের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস ও পেটের ক্ষুধা এসব কিছুই বুঝতে চায় না।

রাজু আহমেদ বলেন, ‘মানুষ কিভাবে সচেতন হবে? লকডাউনে সবার রুটি রুজি বন্ধ, অনেকে চাকরি হারাচ্ছে, কাজ হারাচ্ছে, পুঁজি হারাচ্ছে। সরকার কি মানুষের খাদ্যের যোগান দিচ্ছে? কর্মের নিশ্চয়তা দিতে পারছে? পেট কি লকডাউন বোঝে?’ আসিফুর রহমান বলেন, ‘অফিস খোলা প্রতিদিন সকালে বের হয়ে গন্তব্য স্থানে পৌঁছানোর জন্যে একপ্রকার সংগ্রাম করতে হয় গাড়ির জন্য তাও ডাবলের অধিক ভাড়া দিয়ে, কর্মজীবী যাদের ব্যক্তিগত গাড়ি আছে তাদেরও নানা রকম প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় পুলিশের কাছে। এ কেমন লকডাউন কলকারখানা খোলা, অধিকাংশ অফিস খোলা, বাজার দোকানপাট খোলা, এই লকডাউন শুধু শপিংমল এবং পরিবহনের জন্য।’ এন এম মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘গরিব মারার লকডাউন না দিয়ে, লকডাউন দিলে সব কিছুই লকডাউনের আওতায় রাখা উচিত, শিল্প কারখানা, ব্যাংক, বিমা সবকিছু।’ একটি রাজনৈতিক দলে শীর্ষ নেতা শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, ‘লুণ্ঠনের জন্য রাষ্ট্র, মাফিয়াদের জন্য সরকার।’ ইনামুল শাহীন বলেন, ‘প্রত্যেক ওয়ার্ড মেম্বার ও কাউন্সিলরদের জানা আছে, নিজ এলাকায় হতদরিদ্র ও ছিন্নমূল মানুষের সংখ্যা। প্রসাশনের সহায়তায় সঠিক তালিকা তৈরি করতে হবে এবং সকল হতদরিদ্র পরিবার ও ছিন্নমূল মানুষকে রেশনিং বা ত্রাণ ব্যবস্থার আওতায় এনে একজন সরকারি কর্মকর্তা, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সেনাসদস্যদের মাধ্যমে বিতরণ করতে হবে। অতীতে প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিশেষ করে বন্যার সময়ে এভাবেই ত্রাণ বিতরণে অনিয়ম খুব কম হয়েছে। কোনোক্রমেই রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের সম্পৃক্ত করা সমীচীন হবে না।’

প্রশ্ন তুলে দিত্য অন্তর বলেন, ‘এ যেনো এক ব্যর্থ রাষ্ট্রের ইতিবৃত্ত, স্বাধীনতার ৫০ বছর পর পেরিয়ে গেলো, পাখির মতো গুলি করে মানুষ মারছে প্রতিদিন, মানুষ মরছে চিকিৎসার অভাবে, প্রত্যেক নাগরিকের মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ ২৫ হাজার টাকা, অতি দরিদ্রের হার ৪৫ শতাংশ, করোনার মোকাবিলার নামে বৈদেশিক ঋণ ২০ হাজার কোটি টাকা, মানুষ রাস্তায় প্রতিবাদ করতে পারবে না এ কেমন বাংলাদেশ?’

মুহাম্মদ মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘সত্যিই প্রশ্ন জাগে কাদের জন্য সরকার? সাধারণ জনগণ যখন কোনো প্রণোদনা পায় না, যখন গরিবের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ তথাকথিত জনপ্রতিনিধি নামক দুর্নীতিবাজদের পকেটে উঠে, যখন কর্ম হারিয়ে হাজারো মেহনতী মানুষ অনিশ্চয়তায় দিনাতিপাত করে, যখন টিউশন হারিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলেটিকে রিকশার প্যাডেল ঘুরাতে হয় তখন সত্যিই প্রশ্ন জাগে কাদের জন্য সরকার?

জানা গেছে গত বছর করোনা শুরু হওয়ার পর এপ্রিল-মে মাসে এক লাখ ২৩ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়। এর মধ্যে ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতের জন্য ছিলো ৩০ হাজার কোটি টাকা। এরই মধ্যে ২২ হাজার কোটি টাকা সরবরাহ করা হয়েছে। নগদ সহায়তার মধ্যে ৫০ লাখ পবিবারকে দুই হাজার ৫০০ টাকা করে দেয়া হয়। ৩১ লাখ পরিবারের অনুকূলে সহায়তা পাঠানা হলেও ১৪ লাখের অর্থ ফেরত এসেছিল। গতবারের সহায়তার সবটা এখনো সরবরাহ করা না হলেও এবারে এ বিষয়ে সরকারকে বড় ধরনের কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি।’

করোনাকালে কাজ হারিয়ে গরিব মানুষের সংখ্যা বেড়েছে বলে দাবি করেছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। তারা বলছেন, শহর এলাকায় অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করে এমন ১০০ জনের মধ্যে চাকরি হারানোর ঝুঁকির মধ্যে আছে ৬৯ জন।’

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘বিএনপির অসংখ্য  নেতাকর্মী করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। তারা বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।’ করোনা ভাইরাস পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় করোনা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ সেল গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু খন্দকার মোশাররফ নিজেই করোনা আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ছিলেন। তাই কিছুটা ব্যাঘাত ঘটেছে পাশে থাকা নিয়ে। তিনি এখন কিছুটা সুস্থ। সেলের কার্যক্রম আবার শুরু হবে। এই পর্যবেক্ষণ সেলের মাধ্যমে সারা দেশের দলের পক্ষ থেকে করোনা কার্যক্রম চালানো হবে। করোনা ভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় আমরা জনগণকে সম্পৃক্ত করতে ‘সর্বদলীয় কমিটি’ গঠনের জন্য সরকারকে প্রস্তাব দিয়েছিলাম। কিন্তু এখনো সাড়া পাইনি। এখনো সময় আছে, সর্বদলীয় কমিটি গঠন করে এ সমস্যার সমাধান করা যাবে।

এদিকে বৈশ্বিক সংকটে সরকারের পাশাপাশি অসহায় ও কর্মহীন মানুষের পাশে দাঁড়াতে দল-মত নির্বিশেষে সব শ্রেণিপেশার মানুষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, ‘করোনা ভাইরাস রাজনৈতিক দল চেনে না। আমরা প্রতিদিনই হারাচ্ছি মূল্যবান প্রাণ। দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। এই সময়ে দোষারোপের রাজনীতি নয়, নয় অন্ধ সমালোচনার তীর ছোড়া; সবাইকে সংক্রমণ রোধে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।’ সিনিয়র সাংবাদিক ও কবি সোহরাব হাসান বলেন, ‘প্রতিবার লকডাউনের আগে গরিব মানুষেরা বাস, ট্রেন, লঞ্চে করে দলে দলে গ্রামে যান। ট্রেন বা লঞ্চ না থাকলেও তারা হেঁটে, ভ্যানে বা রিকশায় চড়ে, ইজিবাইকে, ট্রাকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দূরের পথ পাড়ি দেন। কেননা, তারা জানেন, শহরে থাকলে না খেয়ে মরতে হবে। এই শহরে মন্ত্রী আছেন, মেয়র আছেন, নেতা আছেন, আমলা আছেন, কাউন্সিলর আছেন, দলের জন্য জীবন উৎসর্গকারী কর্মী আছেন। কিন্তু এসব দিন আনা দিন খাওয়া মানুষকে দেখার কেউ নেই।’

১৪ এপ্রিল শুরু হওয়া লকডাউন কিংবা এর আগে ৫ এপ্রিল থেকে ঢিলেঢালা আরেক দফা লকডাউনের আগমুহূর্তে যে শহর থেকে হাজার হাজার মানুষ গ্রামে চলে গেছে, তার কারণ কি সরকারের কর্তাব্যক্তিরা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন? করলে দেখতে পেতেন, জীবন-জীবিকার অনিশ্চয়তার কারণে তারা ঢাকা বা অন্যান্য শহর ছাড়ছেন। তারা জানেন, লকডাউন মানে রিকশাচালক রাস্তায় রিকশা নিয়ে নামতে পারবেন না, দিনমজুর কোনো কাজ পাবেন না, নির্মাণশ্রমিককে ঠায় ঘরে বসে থাকতে হবে। যেসব ভদ্রলোকের বাড়িতে গৃহকর্মীরা কাজ করেন, তারা তাদের ঢুকতে দেবেন না। আমাদের দেশে ব্রিটিশ প্রবর্তিত জমিদারি উঠে গেছে অনেক আগে। কিন্তু শহুরে ভদ্রলোকদের জমিদারি বহাল আছে। ধানমন্ডি, গুলশান, বনানীসহ বিভিন্ন আবাসিক এলাকার অনেক অ্যাপার্টমেন্টে নোটিস ঝুলতে দেখেছি, গৃহকর্মী ও ড্রাইভাররা লিফট ব্যবহার করতে পারবেন না। ভদ্রলোকদের লিফটে ড্রাইভার ও গৃহকর্মীরা উঠলে তাদের কৌলীন্য চলে যায়।

আমারসংবাদ/জেআই