Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪,

সড়কে আইন গলি ঠাসা

এপ্রিল ১৯, ২০২১, ০৮:৩৫ পিএম


সড়কে আইন গলি ঠাসা
  • অভিজাত এলাকায় কঠোরতা, অলি  গলি ও মহল্লা লোকে লোকারণ্য
  • প্রতিষ্ঠান বন্ধ, পরীক্ষাও হচ্ছে না, সড়কে সড়কে ঘুরছে কিশোররা
  • লকডাউনে দিনের বেলায় কঠোরতা রাতের নীরবতা নিয়ে প্রশ্ন
  • তরুণরা আড্ডা দিচ্ছে যত্রতত্র, বয়স্করাও ঘরে থাকছেন না
  • রিকশা-মোটরসাইকেল আরোহীকে একাধিকবার জিজ্ঞাসাবাদ
  • ভিআইপি গাড়ি সহজে ছাড়
  • করোনার চেয়ে ক্ষুধার আতঙ্ক বেশি ভয়ানক  -দাবি অসহায়দের

গতকাল সোমবার বেলা ৩টা। রাজধানীর বাটা সিগন্যাল মোড়ে পুলিশের কঠোরতা। মুভমেন্ট পাশ ছাড়া কাউকে ছাড় দেয়া হচ্ছে না। চাওয়া হচ্ছে জবাব। উত্তর না মিললে করা হচ্ছে জরিমানা। ঠিক তার স্বল্প দূরত্বে হাতিরপুল কাঁচাবাজার। সেখানে মানুষের ঠাসাঠাসি। নেই শারীরিক দূরত্বের বালাই। কেউ জটলা বেধে ইফতার কিনছেন, আবার কেউবা বাজার করছেন। ঠিক তার পাশে জজগলি ও হাতিরপুল তিন রাস্তার মোড়।  সেখানে চলছে তিন-চার গ্রুপের আড্ডা। একদিকে ১০-১২ জন কিশোর আড্ডা দিচ্ছে, অন্যদিকে দুটি ভ্যানে বসে আলাপ করছেন সাত-আটজন বয়স্ক মানুষ। দু’-একজনের মাস্কও নেই।

সচেতন মহল বলছে, গলির আড্ডায় লাগাম নেই। রাজধানীর অলি-গলি ও মহল্লা লোকে লোকারণ্য। দোকান, বাজার সর্বত্র ভিড়। কোথাও মানা হচ্ছে না বিধিনিষেধ। সশস্ত্র বাহিনী, র্যাব, পুলিশের টহলের কারণে রাজপথ অনেকটা ফাঁকা থাকলেও অলি-গলিতে যেভাবে আড্ডা, খোশগল্প চলছে তাতে কোনো ধরনের উপকারে আসবে না লকডাউন। মানুষের মধ্যে কোনো ধরনের সচেতনতা নেই। কিশোর ও উঠতি বয়সি তরুণরা আড্ডা দিচ্ছে যত্রতত্র। বয়স্করাও ঘরে থাকছেন না। এ ছাড়া রাজধানীর অনেক জায়গায় কঠোর লকডাউনে দীর্ঘ জ্যামেও পড়তে হচ্ছে। রিকশা ও অটোরিকশা চলছে দেদার। ব্যক্তিগত হাজারো গাড়ি চলছে সড়কে। প্রয়োজনে বের হওয়া মানুষরা অভিযোগ করছেন— পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী শুধু রিকশা ও মোটরসাইকেলকেই বেশি হয়রানি করছে। ভিআইপি গাড়িগুলো অনায়াসে ছাড় পেয়ে যাচ্ছে। গতকাল বিকেলে হাতিরপুল জজগলিতে বসে আড্ডা দিচ্ছেন আব্দুস সোবহানসহ কয়েকজন। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ঘরে আর কতক্ষণ। বয়স বেড়েছে বাইরের প্রকৃতি না দেখলে ভালো লাগে না। রিকশা নিয়ে বের হন লিয়াকত।

সন্ধ্যা হলেই ঢাকার গলিতে গলিতে চলে আড্ডা : সন্ধ্যা ৭টার পর রাজধানীর দৃশ্যপট বদলে যায়। ৬টার পর ঘর থেকে বের না হওয়ার সরকারি নির্দেশ রয়েছে জনগণের প্রতি। কিন্তু সেই নির্দেশ প্রথম কয়েকদিন পালন করলেও, এখন আর সে নিয়ম পালন করছেন না কেউ। সন্ধ্যার পর রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ভ্রাম্যমাণ চা আর সিগারেটের দোকানের দেখা মিলেছে গেলো কয়েকদিন ধরেই। গতকাল সন্ধ্যায় রাজধানীর হাতিরপুল কাঁচাবাজার, সেগুনবাগিচা এলাকার শিল্পকলা একাডেমি, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, বারডেম হাসপাতালের সামনে, বিজয় নগর পানির টাঙ্কি, বাফুফের সামনে ভ্রাম্যমাণ চা আর সিগারেটের দোকানের দেখা মিলেছে। নিম্ন আয়ের এসব মানুষ নিতান্তই পেটের দায়ে ঘর থেকে বের হয়েছেন। যাদের মূল ক্রেতা হলো লকডাইন ভেঙে বের হওয়া মানুষরা।

প্রতিষ্ঠান বন্ধ পরীক্ষাও হচ্ছে না, সড়কে সড়কে ঘুরছে কিশোররা : দুপুরে রাজধানীর মতিঝিল এলাকা ঘুরে দেখা গেলো, মূল সড়ক ফাঁকা। তবে মোড়ে রিকশা দাঁড়িয়ে আছে। এদের বেশির ভাগই ছিন্নমূল মানুষ। কেউ বের হয়েছেন প্রয়োজনে আবার কেউ-বা ত্রাণের আশায় ঘুরছেন রাজধানীর এ মাথা থেকে ও মাথা। তবে বিভিন্ন এলাকার গলিতে ঢুকলে দেখা যায় ভিন্নচিত্র। দুপুর ২টা পর্যন্ত বেশির ভাগ দোকানের সামনেই দেখা গেছে ভিড়। রামকৃষ্ণ মিশন রোডের পেছনের গলিতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছিলো চার কিশোর।

তাদের সবাই এবারের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী। কিন্তু করোনা সংক্রমণের আশঙ্কায় স্থগিত হয়ে যাওয়া পরীক্ষা নিয়ে চলছিলো তাদের আড্ডা। এদের একজন আবির বললো, ‘আসলে ঘরে বসে থাকতে থাকতে বোর হয়ে গেছি। এ সময় পরীক্ষার পড়াও পড়তে ইচ্ছা করছে না। কারণ, পরীক্ষা কবে হবে তার কোনো ঠিক নেই। আর পড়াও শেষ।’ ওই দলের আরেক সদস্য রাব্বি বললেন, ‘ঘরে ভালো লাগছে না, তাই বের হইছি। মাস্ক-গ্লাভস পরে বের হয়েছি। একই চিত্র দেখা গেলো, স্বামীবাগের কেএম দাশ লেনেও। সেখানকার মিতালী হাইস্কুলের পাশে দেখা গেলো বেশ ভিড়। সেখানে দাঁড়িয়ে কথা বলতে দেখা যায় তিনজনকে। আরেকটু সামনেও চারজনের আরেকটি দলকে আড্ডা দিতে দেখা যায়।

ফুটপাতে ভিড়, রাস্তা-ঘাটে মানুষ, লেগেছে যানযটও :  প্রথম দিকে কড়াকড়ি থাকলেও সর্বাত্মক লকডাউনের ষষ্ঠ দিনে ঢাকার রাস্তা-ঘাটে মানুষ ও যানবাহনের চলাচল আরও বেড়েছে। গণপরিবহন বন্ধ থাকলেও রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে রিকশা, অটোরিকশা, ব্যক্তিগত গাড়ি চলছে দেদার। ফুটপাতেও বেড়েছে সাধারণ মানুষের চলাচল। গতকাল সোমবার সকালে কাকরাইল, বিজয় নগর, রামপুরা, মালিবাগ, শান্তিনগরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে এমন দৃশ্যই। সকাল সাড়ে ১০টায় কাকরাইলের নাইটিঙ্গেল মোড়ে পুলিশের তল্লাশি চৌকির সামনে রিকশা-ব্যক্তিগত গাড়ির লম্বা লাইন দেখা গেছে। প্রতিটি যানবাহন থামিয়ে ‘মুভমেন্ট পাস’ দেখতে চান পুলিশ সদস্যরা। যাদের পাস নেই তাদেরকে জরিমানা করে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। শান্তিনগরে রিকশাচালক আবদুর রহমান বলেন, ‘পেটের জন্য সকাল ৭টায় রিকশা নিয়া নামছি। এখন বাজে ১০টা। দুইটা খ্যাপ পাইছি। দেখেন স্যার, অনেক রিকশা মোড়ে মোড়ে আছে, প্যাসেঞ্জার নেই।’

চট্টগ্রামের অলিগলিতে আড্ডা-জটলা : করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সরকারের ঘোষিত কঠোর লকডাউনের প্রথমদিকে চট্টগ্রাম নগরী কার্যত যানবাহন চলাচলে কঠোরতা থাকলেও রিকশা-ভ্যান চলছে। মোটরসাইকেল বের হলেও  আটকাচ্ছে পুলিশ। মূল সড়কে এবং স্পটে লোকজন কম থাকলেও অলিগলিতে লোকজন বের হয়েছে। মাঝে মাঝে পুলিশ টহল দিলেও সাধারণ লোকজনের অহেতুক ঘর থেকে বের হওয়া ঠেকানো যাচ্ছে না। লকডাউন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আশরাফুল হাসান জানান বন্দরকেন্দ্রিক যেসব ভারী যানবাহন আছে সেগুলো চলছে। কাঁচাবাজারে মানুষ আছে। স্বাস্থ্যবিধি মানার প্রবণতা কারো কারো মধ্যে কম। তাদের সতর্ক করেছি। মূল সড়কের আশপাশের দোকানপাট বন্ধ আছে। তবে অলিগলিতে কিছু কিছু দোকান খোলা দেখেছি। সেগুলো বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে।

দিনের বেলায় কঠোরতা রাতের নীরবতা নিয়ে প্রশ্ন : প্রথমদিনের পর আর কেউই মানছে না লকডাউন। অনেকে বলছেন, দিনের বেলায় কঠোরভাবে লকডাউন আর রাতের বেলায় দেখা যাচ্ছে  চেকপোস্ট নেই। প্রশ্ন তুলে আতাউর অপু নামের একজন বলেন, ‘লকডাউন কি শুধু দিনের জন্য, রাতের জন্য না? লকডাউন মানেই তো খুবই জরুরি প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হতে পারবেন, তা ছাড়া নয়। অফিস বন্ধ, গাড়ি চলাচল বন্ধ। কেউই ঢাকার বাইরে যেতে পারবে না আর শহরের বাইরে থেকেও কেউ ঢাকায় আসতে পারবে না। কিন্তু এবার দেখি গণপরিবহন বন্ধ আর অফিস খোলা। এর মানে কী? যদি অফিস খোলা থাকে আর গাড়ি বন্ধ থাকে তাহলে মানুষ অফিস করবে কীভাবে? ঢাকার বাইরে থেকে মানুষ ঢাকায় আসছে আবার ঢাকা বাইরেও যাচ্ছে। তাদের সঙ্গে সঙ্গে মহামারিও ঢাকার বাইরে যাচ্ছে, আবার আসছেও। গতবারের লকডাউনে দেখেছিলাম, অফিস বন্ধ, গাড়ি চলাচল বন্ধ, পাড়া-মহল্লায় মানুষ নেই। আর পুলিশ মহল্লায় মহল্লায় টহল দিচ্ছে। মানুষ ঘর থেকে বের হলে পুলিশের লাঠির বাড়ি। এবার দেশে লকডাউনের কোনো চিহ্নই নেই।’

করোনার চাইতে ক্ষুধার আতঙ্ক বেশি ভয়ানক —দাবি অসহায়দের  : সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লকডাউনবিরোধে সোচ্চার হয়ে উঠেছে বড় একটি অংশ। লুবাবা নাজিয়াত তুবা বলেন, নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের আয় রোজগার বন্ধ করে শিল্পপতিদের কারখানার চাকা সচল রাখার নাম লকডাউন নয়। একদিকে আয় রোজগার বন্ধ, অপরদিকে বাজারে নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি আর এনজিওকর্মীদের ঋণের চাপে দিশাহারা নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা। কেবল ত্রাণ বরাদ্দ নয়, তা সঠিক বণ্টন নিশ্চিত করার পাশাপাশি টিসিবি পণ্য জনগণের দোড়গোঁড়ায় পৌঁছে দিলে লকডাউন কার্যকর হবে। অন্যথায় সাধারণ মানুষ ঘরে বসে থাকবে না। কারণ করোনার আতঙ্কের চাইতে ক্ষুধার আতঙ্ক বেশি ভয়ানক। আমিরুল খান বলেন, যারা ফের নতুন করে লকডাউনের সুপারিশ করেছে তাদেরসহ, সমস্ত সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বন্ধ করে দিয়ে ওই টাকা গরিব দুঃখীদের মাঝে বণ্টন করে দেয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। তারপরে লকডাউন করা হোক, সর্বত্র লকডাউন দেয়া হোক, কোনো অসুবিধা নেই।’ এম আহমেদ উল্লাহ বলেন, ‘ভাষা নাই, বাকরুদ্ধ! আমরা বাঙালি এখনো স্বাধীনতা পায়নি। এই? রমজানেও গরিব মানুষদের ওপর অত্যাচার চলছে। এটাই কি গণতন্ত্র? দেশের মানুষের কথা ভাবে না। নিজের কথাটাই ভাবে। নিজে ভালো থাকতে হাজারো বাঙালি গরিব মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্তদের পেটে লাথি মারছে সরকার।’ সাইফ উদ্দিন বলেন, ‘যার পেটে ক্ষুধা নেই তাদের জন্যই লকডাউন...গরিবের আবার কিসের লকডাউন, পেটে ভাত না পড়লে পিঠে সইবে কেমনে? আবিদুর রহমান বলেন, ‘সেনাবাহিনী ধারা প্রতিটি মধ্যবিত্ত ও গরিব মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে খাবার পৌঁছে দিয়ে আসুন। কোনো নেতা বা চেয়ারম্যান, মেম্বার দিয়ে নয়। তাহলেই কেউই আর বাইরে বের হবে না। কঠোর লকডাউন নয়, দরকার কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা! সবাই সাবধানে থাকুন সতর্ক হন আল্লাহ পাককে ভয় করুন, নামাজ পড়ুন, সবার জন্য দোয়া করুন...।’

সালিকুর রহমান মেহরাব বলেন, ‘লকডাউনের সময় বাড়ানোর পক্ষে যারা সুপারিশ করেছে তাদের সংখ্যা ঊর্ধ্বে গেলে ১০০ থেকে ২০০ জন। অথচ দেশের ১২ থেকে ১৪ কোটি মানুষ লকডাউনের সময় বাড়ানোর বিপক্ষে। এরপরও সরকার মূল্যায়ন করবে ওই ১০০ জনকে।’  সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ঢাকা জেলা প্রশাসনের নির্বাহী হাকিম শেখ মো. মামুনুর রশিদ বলেন, ‘অনেকে মুভমেন্ট পাশ নিয়েছেন একটা কাজের জন্য। কিন্তু তিনি এটি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন সারা শহরজুড়ে। আরো অনেক কাজ করছেন। আবার অনেকে দেখছি তুচ্ছ অজুহাতেও সড়কেও বেরিয়ে আসছেন। এর মধ্যে আমরা কিছু কিছু বিষয় ছাড় দিচ্ছি। কেউ টিকা নিতে যাচ্ছেন, কিংবা হাসপাতালে ডাক্তার দেখাতে যান আমরা এগুলো মিলিয়ে দেখছি; সত্যতা পেলে ছাড় দিচ্ছি।’

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম সাধারণ মানুষের কষ্টের বিষয় তুলে ধরে বলেন, ‘পরিকল্পনা ও চিন্তা ছাড়া সরকার লকডাউন দিয়ে সাধারণ মানুষকে অনেক কষ্ট ফেলেছে। সাধারণ মানুষের চিন্তা সরকার করছে না। মানুষ অনেক কষ্ট করছে। কিভাবে চলছে কিভাবে খাচ্ছে এই সমাধান সরকারের নেই। রাস্তার মোড়ে মোড়ে ছোট পুঁজির দোকানদার দিন এনে দিনে খায়, তারা অনেক দুর্বিষহ জীবনের মধ্যে রয়েছে। তাদেরকে নগদ অর্থের ব্যবস্থা করতে হবে। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী যারা রয়েছেন তাদের সাহায্য নিশ্চিত করতে হবে।’

আমারসংবাদ/জেআই