এপ্রিল ১৯, ২০২১, ০৮:৩৫ পিএম
অরাজনৈতিক সংগঠন দাবি করেও রাজনৈতিক সরকারের সঙ্গেই সাংঘর্ষিক পর্যায়ে উপনীত হেফাজতে ইসলাম কৌশলের খেলায় সরকারের কাছে পরাজিত হয়েছে। তবে সরকারের সঙ্গে হেফাজতের বর্তমান সম্পর্ক অর্থাৎ কৌশলের খেলা এখনো শেষ হয়নি, বরং সাম্প্রতিক তাণ্ডবের মতো পাল্টা আঘাতেরও প্রস্তুতি নিচ্ছে হেফাজত- এমনটাই আলোচিত হচ্ছে বিভিন্ন মহলে। যে কারণে সরকারকে থাকতে হবে সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থানে- বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
সাম্প্রতিক তাণ্ডব-সহিংস কর্মকাণ্ডের পর প্রথমে সংগঠনটির নিচের সারির নেতারা পরবর্তীতে উপরের সারির একাধিক নেতা গ্রেপ্তারে যেমন-তেমন, সর্বশেষ মামুনুল হককে গ্রেপ্তারের পর থেকেই চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে হেফাজত কর্মীদের মধ্যে। যার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে গতকাল ঢাকার কেরানীগঞ্জ ও বাগেরহাটে। মামুনুল হককে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে রাজপথে নামতে সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে যেনো ওঁৎপেতে আছে হেফাজতকর্মীরা। তবে অনেকেই বলছেন, হেফাজতের বর্তমান দুর্বল-কোণঠাসা অবস্থার একমাত্র কারণ মামুনুল হক। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের বিরোধিতায় সংঘর্ষ, তাণ্ডব যা-ই ঘটেছে, সর্বশেষ সোনারগাঁওয়ের রয়েল রিসোর্টে কথিত স্ত্রীসহ মামুনুল হক অবরুদ্ধের ঘটনা-ই হেফাজতকে দেশের মানুষের কাছে আস্থাহীনতায় পরিণত করেছে। কারণ শুরু থেকেই ওই নারীকে তার স্ত্রী বলেই সাফাই গেয়ে আসছিল হেফাজতও। যদিও বিয়ের সপক্ষে আদৌ দেখাতে পারেননি শক্ত প্রমাণাদি। বরং দিন শেষে হেফাজত জানায়, বিষয়টি মামুনুল হকের ব্যক্তিগত ব্যাপার। এ নিয়েই যখন দেশজুড়ে সমালোচনার ঝড় বইছে ঠিক তখনই লকডাউনের মধ্যেই নিজ মাদ্রাসা থেকে গ্রেপ্তার হন মামুনুল হক।
২০২০ সালে ভাঙচুরের ঘটনায় মোহাম্মদপুর থানার একটি মামলায় গ্রেপ্তার মামুনুল হককে গতকাল সাতদিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। রিমান্ড আবেদন করেন মোহাম্মদপুর থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) সাজেদুল হক। রিমান্ড বাতিল চেয়ে মামুনুলের পক্ষে শুনানি করেন জয়নাল আবেদীন মেসবাহসহ কয়েকজন আইনজীবী। অন্যদিকে ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর আব্দুল্লাহ আবু, আজাদ রহমানসহ কয়েকজন জামিনের বিরোধিতা করে রিমান্ডের পক্ষে শুনানি করেন। আসামিপক্ষের আইনজীবী সৈয়দ মো. জয়নুল আবেদীন মেসবাহ শুনানিতে বলেন, ‘মামুনুল হক সাহেবকে মোহাম্মদপুর থানার একটি মামলায় সাতদিনের রিমান্ড চাওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষের অভিযোগ ছিলো বাদির ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লেগেছে। কারণ এই মামলায় মামুনুল হক সাহেবের নির্দেশে নাকি কোনো এক ব্যক্তিকে মারধর করা হয়েছে এবং মসজিদ থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু মামুনুল হক সাহেব কী নির্দেশ দিয়েছেন, কখন নির্দেশ দিয়েছেন এ-সম্পর্কিত কোনো বক্তব্য মামলার এজাহারে নেই। এর চেয়ে বড় কথা, মামুনুল হককে গত এক বছর সারা বাংলাদেশে দেখা গেছে, তিনি পলাতক ছিলেন না, তাহলে এতদিন কেন তাকে গ্রেপ্তার করা হলো না? তাছাড়া রোববার তাকে গ্রেপ্তারের পর পুলিশি হেফাজতে যে দীর্ঘ সময় ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে তার কোনো রিপোর্ট আদালতে উপস্থাপন করা হয়নি। আসলে কোনো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত নয়, মামুনুল হককে ছোট করার জন্য সুপরিকল্পিতভাবে এই মামলা করা হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘যেখানে মামুনুল হকের বিরুদ্ধে কোনো সুস্পষ্ট অভিযোগ নেই, সেখানে তাকে সাতদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করা যুক্তিযুক্ত নয়। সেই সাথে আদালতে আমার কয়েকজন সহযোগী আইনজীবীকে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি, যা আদালতের নিয়মকে সমর্থন করে না। এভাবে আদালত চললে বিচারব্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ হবে।’ অপরদিকে মহানগর আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর আব্দুল্লাহ আবু তার বিরোধিতা করে বলেন, ‘এই আসামি তার কর্মীবাহিনীকে দিয়ে দেশের মধ্যে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস সৃষ্টি করেছে, তাই তার জামিন আবেদন বাতিলপূর্বক রিমান্ডের আদেশ দেয়া হোক।’ ‘রাষ্ট্রবিরোধী আন্দোলনের ষড়যন্ত্র ও নীলনকশা তৈরি করছেন তিনি। ইতোমধ্যে তার অনেক প্রমাণ মিলেছে। তাকে আরও জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে তথ্য উদঘাটিত হওয়া আবশ্যক।’ রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আব্দুল্লাহ আবু বলেন, ‘মামলার বাদি মসজিদে গিয়েছিল, সেখানে মামুনুল হকের অনুসারীরা মামুনুল হকের নির্দেশে মামলার বাদির ওপর হামলা করে এবং তাকে মেরে মসজিদ থেকে বের করে দেয়। তার কাছ থেকে সাত হাজার টাকা এবং ২০০ ডলার ছিনিয়ে নেয়া হয়। সেদিন মামুনুল হক ও তার ভাইয়ের নির্দেশে মামুনুলের অনুসারীরা এ ঘটনা ঘটিয়েছে। বাদিকে মারধরের পাশাপাশি তাকে মসজিদ থেকে বের করে দেয়ায় মামলার এজাহার অনুযায়ী আসামি বাদিপক্ষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হেনেছে। মামলার শুনানিতে আমরা বিজ্ঞ আদালতের কাছে সাতদিনের রিমান্ড চেয়েছি, কারণ এ ঘটনায় আরও কারা কারা জড়িত ও পলাতকদের তথ্য জানতে আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন।’ উভয় পক্ষের শুনানি শেষে তাকে সাতদিনের রিমান্ড আদেশ দেন বিচারক দেবদাস চন্দ্র অধিকারী। বিচারক আদেশ পড়ে শোনান। এ সময় মামুনুল হককে আদালতের কাঠগড়ায় নিষ্প্রভ অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। বিচারক তাকে উদ্দেশ করে জিজ্ঞাসা করেন তার কিছু বলার আছে কি-না? উত্তরে মামুনুল হক বলেন, যেহেতু পবিত্র রমজান মাস তাই পুলিশের হেফাজতে থাকা অবস্থায় তাকে যেনো নিয়মিত রোজা রাখা, নামাজ পড়া ও কুরআন তিলাওয়াত করার সুযোগ দেয়া হয়। এ সময় তার পক্ষের আইনজীবীরা আদালতকে বলেন, তিনি (মামুনুল) দেশের একজন নামকরা আলেম। তাই তার ইচ্ছা অনুযায়ী ইবাদত করার সুযোগ যেনো দেয়া হয়। তবে আদালতের কার্যক্রম শুরুর কয়েক মিনিট আগে আইনজীবী জয়নাল আবেদীন মেসবাহসহ কয়েকজন আইনজীবীকে নিচু হয়ে মৃদুস্বরে মামুনুল হকের সঙ্গে কথা বলতে দেখা যায়। শুনানি শেষে মামুনুলকে ডিবি কার্যালয়ে নেয়া হয়।
মামুনুল হককে গ্রেপ্তার ও রিমান্ডের বিরোধিতা করে গতকাল ঢাকার কেরানীগঞ্জে পুলিশের সঙ্গে হেফাজতকর্মীদের সংঘর্ষে তিন পুলিশ ও এক পথচারীসহ চারজন আহত হয়েছেন। জিনজিরা ইউনিয়নের মান্দাইল মাদ্রাসা ও তার আশেপাশে শতাধিক হেফাজত নেতাকর্মী জড়ো হয়ে মিছিল বের করলে পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এ সময় হেফাজতকর্মীরা ইটপাটকেল নিক্ষেপ করলে তিন পুলিশ সদস্য ও এক পথচারী আহত হন। তবে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, মান্দাইল মসজিদ থেকে জোহর নামাজ শেষে মুসল্লিরা হেফাজতের পক্ষে একটি মিছিল বের করলে ধীরে ধীরে লোক সমাগম বাড়তে থাকে। পরে শতাধিক লোক মিছিল নিয়ে এগোতে চাইলে পুলিশ তাদের লাঠিচার্জ করে। ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে সহকারী পুলিশ সুপার কেরানীগঞ্জ সার্কেল শাহাবুদ্দিন কবির বলেন, ‘হেফাজতের হামলার আশঙ্কায় আগে থেকেই কেরানীগঞ্জে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন ছিলো। জোহরের নামাজ শেষে মান্দাইল মাদ্রাসা থেকে প্রায় দুই শতাধিক হেফাজতকর্মী মিছিল নিয়ে পুলিশের ওপর হামলা করে। এতে তিন পুলিশ সদস্যসহ চারজান আহত হয়। এ ছাড়া বাগেরহাটেও পুলিশের ওপর হামলা হয়েছে জানা গেছে। হামলায় সাত পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। মোল্লাহাট উপজেলার উদয়পুর কিন্ডার গার্টেন এলাকায় ওই ঘটনা ঘটে। বাগেরহাটের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মীর শাফিন মাহমুদ বলেন, ‘হেফাজত নেতা মামুনুল হককে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে হেফাজতের নেতাকর্মীরা উদয়পুর কিন্ডার গার্টেন এলাকায় জড়ো হয়ে মিছিল বের করার চেষ্টা করলে পুলিশ তাতে বাধা দেয়। এ সময় হেফাজতের নেতাকর্মীরা উত্তেজিত হয়ে পুলিশ সদস্যদের ওপর ইট-পাটকেল ছুড়া শুরু করে। হেফাজতকর্মীদের ছোড়া ইটের আঘাতে থানার ওসিসহ তিন পুলিশ সদস্য আহত হন। তবে দুই স্থানে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটলেও সারা দেশেই ওঁৎপেতে থাকা বিক্ষুব্ধ হেফাজতকর্মীরা রাজপথে নামতে অনুকূল পরিবেশ পাচ্ছে না সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে— এমনটাই মনে করছেন অনেকেই। অথচ হেফাজতের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ালে গদি থাকবে না বলেও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হেফাজত, ‘মামুনুলের কিছু হলে জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে’, এ ছাড়াও আরও কড়া কড়া স্লোগানে উত্তাল রাজপথে নানা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হেফাজত মামুনুল হকসহ কেন্দ্রীয় অনেক নেতাই গ্রেপ্তার হলেও কার্যত গতকাল দেশের দুই স্থান ছাড়া কোথাও কোনো কর্মসূচি কিংবা হাঁকডাক দিতেও দেখা যায়নি। যে কারণে সরকারের কৌশলি কঠোর অবস্থানের মুখে হেফাজতের বর্তমান নীরবতাই ব্যর্থতার জানান দেয়; বলছেন অনেকেই।
এদিকে জান্নাতুল ফেরদৌস ওরফে লিপি নামে এক নারীকে নিজের স্ত্রী দাবি করলেও কবে কোথায় বিয়ে করছেন এ বিষয়ে পুলিশকে কোনো তথ্য দেননি মামুনুল হক, দেখাতে পারেননি সন্তোষজনক কোনো প্রমাণও। এ ছাড়াও তৃতীয় স্ত্রী এখন কোথায় আছেন, সে বিষয়েও পুলিশকে সুনির্দিষ্ট কিছুই জানাননি তিনি। ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনারের কার্যালয়ে তৃতীয় বিয়ে নিয়ে মামুনুলকে জিজ্ঞাসাবাদের পর এমনটাই জানিয়েছে পুলিশ। মামুনুল হকের তৃতীয় বিয়ে নিয়ে তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) হারুন-অর-রশিদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘নিজের বোনকে হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মামুনুল হকের স্ত্রী দাবি করে রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানায় ১১ এপ্রিল একটি সাধারণ ডায়েরি করেছেন মো. শাহজাহান নামে এক ব্যক্তি। তার বোন জান্নাতুল ফেরদৌস ওরফে লিপি নিখোঁজ রয়েছেন বলেও জিডিতে উল্লেখ করা হয়।’ এ বিষয়ে মামুনুল হককে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি তাকে বিয়ে করেছি। সে আমার তৃতীয় স্ত্রী।’ তৃতীয় বিয়ে নিয়ে তার কাছে কোনো প্রমাণ আছে কি-না সে বিষয়ে জানতে চাইলে মামুনুল হক কিছুই বলতে পারেননি বলে জানান ডিসি তেজগাঁও। তিনি বলেন, ‘পরপর তিনটি বিয়ে। সোনারগাঁওয়ে রয়েল রিসোর্টে যে মেয়েটিকে নিয়ে গেছেন তাকে নিজের বিয়ে করা স্ত্রী বলে দাবি করেছেন। কিন্তু আপনার স্ত্রীকে (প্রথম স্ত্রী) আপনি বলেছেন ওই নারী অন্যজনের স্ত্রী। এসব কথা কেন বললেন, এ বিষয়ে আমরা মামুনুলকে প্রশ্ন করি। কিন্তু এসব বিষয়ে তিনি কোনো উত্তর দিতে পারেননি।’
মামুনুল হককে জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়ে তিনি আরও বলেন, ‘শেষ ধাপে আমরা জিজ্ঞাসা করি, শাহজাহান নামে এক ব্যক্তি জিডি করেছেন যে, তার বোনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তার বোনকে আপনি বিয়ে করেছেন। এ বিষয়ে তিনি (মামুনুল হক) কেন সম্পূর্ণ তথ্য জানেন না? তাকে (মামুনুল হক) আমরা জিজ্ঞাসা করি— বিয়ে তো বৈধ বিষয়, তাহলে আপনার শালাকে (শাহজাহান) এ বিষয়ে কেন জানাননি। এসব প্রশ্নেরও তিনি কোনো উত্তর দিতে পারেননি।’ মামুনুল শুধু বলেছেন, ‘আমি তাকে বিয়ে করেছি। অথচ জিডি করার সময় শাহজাহান বিয়ের চুক্তিনামাও দেখান। বোনকে খুঁজে পেতে তিনি পুলিশের সহায়তা চেয়েছেন। এছাড়া ৩ এপ্রিলের রয়েল রিসোর্টে জান্নাত আরা জান্নাত ওরফে ঝরনা নামে যে নারীসহ অবরুদ্ধ হন মামুনুল হক, সে নারীকে নিজের দ্বিতীয় স্ত্রী দাবি করলেও এ বিষয়ে তিনি নির্দিষ্ট কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেননি। জানা গেছে, রিসোর্টকাণ্ডের পর মামুনুল হকের বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন প্রথম স্ত্রী আমেনা তাইয়্যেবা। তিনি এখনো মোহাম্মদপুরের কাদেরাবাদ হাউজিংয়ে এক নম্বর সড়কে অবস্থিত মামুনুল হকের বাড়িতে আসেননি। বর্তমানে তাইয়্যেবা বাবার বাড়িতে আছেন।
আমারসংবাদ/জেআই