Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪,

অগ্নিকাণ্ডে প্রাণহানির দায় কার!

এপ্রিল ২৩, ২০২১, ০৭:৪৫ পিএম


অগ্নিকাণ্ডে প্রাণহানির দায় কার!
  • আরমানিটোলায় অগ্নিকাণ্ডে আবারো চারজনের প্রাণহানি
  • ১১ বছরেও সরেনি রাসায়নিক কারখানা ও গুদাম
  • দগ্ধ ২১ জনের ২০ জন শেখ হাসিনা বার্ন ইউনিটে ভর্তি, সবারই শ্বাসনালী পুড়েছে
  • ঢিলেঢালা রুটিন অভিযানেরই ফল মুসা ম্যানশনের অগ্নিকাণ্ড : অভিযোগ স্থানীয়দের
  • ভবনটিতে থাকা রাসায়নিক গোডাউনের লাইসেন্স দেয়নি ফায়ার সার্ভিস : দেবাশীষ বর্ধন উপপরিচালক, ফায়ার সার্ভিস 

দুটি বড় অগ্নিকাণ্ড। মৃত্যু ১৯৫ জনের (প্রথমটি ২০১০ সালে নিমতলীর আগুনে ১২৪ জন, দ্বিতীয়টি ২০১৯ সালে চুড়িহাট্টার আগুনে ৭১ জন)। প্রথমটির পর পেরিয়েছে ১০ বছরেরও বেশি, দ্বিতীয়টির পর কেটেছে দুই বছর। কিন্তু খুব একটা বদলায়নি পুরান ঢাকার চিত্র। এখনো হরদমই চলছে রাসায়নিক ব্যবসা, দোকান, গুদাম ছাড়াও চলছে খোদ রাসায়নিক কারখানা। সার্বিক অবস্থা যেনো অনেকটা আগের মতোই। এর মধ্যে ঝুঁকি নিয়েই বাস করছে মানুষ। অথচ সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর বড় দুটি অগ্নিকাণ্ডের পর রাসায়নিক গুদাম ও কারখানা সরানোর কথা থাকলেও দৃশ্যত কিছুদিন উচ্চবাচ্য করলেও কার্যত মাঝে মাঝে চালিয়েছে দু-চারটি রুটিন অভিযান। যে অভিযানকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েই দীর্ঘদিন ধরে রাসায়নিক কারবার চালিয়ে আসা আরমানিটোলার হাজী মুসা ম্যানসন ভবনের রাসায়নিক গুদামে এবার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় গতকাল শুক্রবার ভোররাতে চারজন নিহতের ঘটনা ঘটেছে।

শুধু হাজী মুসা ম্যানশন ভবনই নয়, পুরান ঢাকাজুড়েই চলছে অবাধ অবৈধ রাসায়নিক কারবার। নিচে রাসায়নিক কারখানা, গুদাম কিংবা দোকান আর ওপরে ঝুঁকি নিয়েই চলছে বাসিন্দাদের বসবাস। শুক্রবারের ঘটনার পর থেকেই এখন সংশ্লিষ্ট এলাকার বিভিন্ন মহলের প্রশ্ন— এ প্রাণহানির দায় কার? এর আগের আলোচিত দুটি দুর্ঘটনার পর দুই বছরেও পুরান ঢাকায় রাসায়নিক ঝুঁকি আগেও যেমন ছিলো, এখনো তেমনই রয়েছে। বড় আগুনের ঝুঁকিও কমেনি আদৌ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুরান ঢাকাকে নিরাপদ বলার মতো কোনো সুযোগই নেই। এখনো যে অবস্থা দেখা যাচ্ছে— তাতে বড় দুর্ঘটনার আশঙ্কাও থেকেই যাচ্ছে। তবে সংশ্লিষ্টরা এও বলছেন, উন্নতি একটা হয়েছে, সেটা বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে চলা রুটিন অভিযান। যে অভিযানের তোয়াক্কাই করে না রাসায়নিক কারবারিরা। আর ঢিলেঢালা এমন অভিযানেরই ফলে গতকাল ভোর রাতে ঘটে যাওয়া আরমানিটোলার হাজী মুসা ম্যানসন ভবনের অগ্নিকাণ্ড— এমন অভিযোগ স্থানীয়দের। ভবনটিতে রাসায়নিক গুদাম থেকেই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে বলে ধারণা করছে পুলিশ। পুলিশ বলছে, ভবনের নিচতলার মার্কেটে ১৬ থেকে ২০টি দোকান রয়েছে। এসব দোকানে রাসায়নিক পণ্য কেনাবেচা হতো। ভবনের নিচতলার পেছনের দিকের একটি রাসায়নিকের গুদাম থেকেই আগুনের সূত্রপাত বলেই ধারণা পুলিশের।

পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) অতিরিক্ত উপকমিশনার কামরুল ইসলাম বলেন, ‘ভবনটির নিচতলায় দোকান রয়েছে। এসব দোকানে রাসায়নিক পণ্য বিক্রি হতো। রাসায়নিক পণ্য বিক্রির কোনো দোকানের গোডাউন থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়ে থাকতে পারে।’ পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, ভবনের নিচতলায় পেছনের দিকে বেশ কয়েকটি দোকানে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। সরেজমিন দেখা গেছে, ভবনটির নিচতলার ৫৬টি দোকান আগুনে প্রায় পুরোটাই পুড়ে গেছে। দোকান ও গুদামের ভেতরে বড় বড় ড্রামগুলো পুড়ে গেছে। এ ছাড়া রাসায়নিক পণ্য কেনাবেচায় ব্যবহূত কিছু ছোট ছোট কন্টেইনারও দেখা গেছে। ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিল্লুর রহমান বলেন, ‘কোথা থেকে আগুনের সূত্রপাত, তা তদন্ত করে দেখা হবে। তারা একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন বলেও জানিয়েছেন। অন্যদিকে ঢাকার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ভাস্কর দেবনাথ বলেছেন, ‘শিল্প মন্ত্রণালয়ের একটি দল ঘটনাস্থলে আসবে। তারা পরীক্ষা করে দেখবে রাসায়নিক থেকে আগুন লেগেছে কি-না এবং ভবনের দোকানগুলোতে এ ধরনের পদার্থ আছে কি-না। আগুন লাগার আর কোনো ঝুঁকি আছে কি-না।

এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত এ ঘটনায় মারা গেছেন চারজন (নিহতদের মধ্যে ইডেন কলেজের শিক্ষার্থী সুমাইয়া আক্তার, সিকিউরিটি গার্ড রাসেল মিয়ার নাম জানা গেছে), আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ২১ জন। তার মধ্যে মোস্তফা নামের একজন চিকিৎসা নিয়ে ফিরে গেছেন। চারজন আইসিইউতে চিকিৎসাধীন। আইসিইউসহ বিভিন্ন ওয়ার্ডে ভর্তি ২০ জনেরই শ্বাসনালী পুড়ে গেছে। এদের মধ্যে দুজনের ফিজিক্যাল বার্ন। এছাড়া আহতরা হলেন— আশিকুজ্জামান (৩৩), তার স্ত্রী ইসরাত জাহান মুনা (৩০), শ্বশুর ইব্রাহিম সরকার (৬০), শাশুড়ি সুফিয়া বেগম (৫০), শ্যালক জুনায়েদ (২০), মোস্তফা (৪০), ইউনুস মোল্লা (৬০), সাকিব হোসেন (৩০), সাখাওয়াত হোসেন (২৭), সাফায়েত হোসেন (৩৫), চাষমেরা বেগম (৩৩), দেলোয়ার হোসেন (৫৮), আয়সাপা (২), খোরশেদ আলম (৫০), লায়লা বেগম (৫৫), মোহাম্মদ ফারুক (৫৫), মেহেরুন্নেসা (৫০), মিলি (২২), পাবিহা (২৬), আকাশ (২২) ও আসমা সিদ্দিকা (৪৫)। শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের প্রধান সমন্বয়ক চিকিৎসক সামন্ত লাল সেন জানান, সেখানে চিকিৎসাধীন চারজনের শরীরের ২৫ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে। তাদের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) রাখা হয়েছে। বংশাল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহিন ফকির বলেন, ‘হাজী মুসা ম্যানশনের মালিক মোস্তাক আহমেদ পুলিশি নজরদারিতে রয়েছেন। ভবনের মালিক হলেও তিনি সেখানে থাকতেন না। তিনি ধানমন্ডিতে থাকেন। তার ওপরে আমরা সব ধরনের নজরদারি রাখছি। এ ঘটনায়  যাদের গাফিলতি পাওয়া যাবে, তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হবে।’ 

ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, রাত সোয়া ৩টার দিকে ওই ভবনে আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিসের ১৯টি ইউনিট তিন ঘণ্টার চেষ্টার পর সকাল সাড়ে ৬টার দিকে আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। ওই ভবনের পাশের একটি ভবনের এক বাসিন্দার অভিযোগ, ভবনটির নিচে রাসায়নিকের গুদাম রয়েছে। তার দাবি, আশপাশের প্রায় সব ভবনেই এ ধরনের গুদাম রয়েছে।’ ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিল্লুর রহমান জানান, ‘ভবনের বাসিন্দাদের জানালার গ্রিল কেটে বের করে আনা হয়েছে। অগ্নিকাণ্ডের কারণ এখনো বোঝা যায়নি। ফায়ার সার্ভিস তদন্ত কমিটি গঠন করবে।’ ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, আগুন লাগার পরপর ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায় ভবনের নিচতলা। ধীরে ধীরে ধোঁয়া উঠতে থাকে ওপরের দিকে। এতে ওপরের তলার বাসিন্দারা আগুনের বিষয়টি টের পান। এ সময় মানুষ বেরিয়ে আসার চেষ্টা করলেও ধোঁয়া ও আগুনের কারণে বের হতে পারেননি। তারা ওপরের দিকে উঠতে থাকেন। তবে ভবনের ছাদ তালাবদ্ধ থাকায় কেউ ওপরে উঠতে পারেননি। বিভিন্ন ফ্লোরে আটকে থাকা লোকজন চিৎকার করতে থাকেন। আটকে পড়া বাসিন্দারা বারান্দা ও জানালা থেকে মোবাইলের আলো জ্বেলে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন। ভোর পৌনে ৫টার দিকে বিভিন্ন ফ্লোর থেকে অন্তত ১৩-১৪ জনকে ক্রেন ব্যবহার করে বের করে আনেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। তারা বারান্দার গ্রিল কেটে বাসিন্দাদের উদ্ধার করেন। পরে একে একে আটকেপড়া সবাইকে উদ্ধার করেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। সকাল সাড়ে ৬টার দিকে ফায়ার সার্ভিস আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়।

এদিকে ভবনটিতে থাকা রাসায়নিক গোডাউনের লাইসেন্স দেয়নি বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের ঢাকা বিভাগের উপপরিচালক দেবাশীষ বর্ধন। তিনি বলেন, ‘ভবনটিতে প্রচুর কেমিক্যাল রয়েছে। এগুলো অবৈধ কেমিক্যালের দোকান। জানা মতে, ফায়ার সার্ভিস এদের কোনো ধরনের লাইসেন্স দেয়নি। তবে আমি জানি না সিটি কর্পোরেশন তাদের ট্রেড লাইসেন্স দিয়েছে কি-না। সম্পূর্ণ অবৈধভাবে এ কেমিক্যাল গোডাউন গড়ে উঠেছে। নিচতলায় কেমিক্যাল গোডাউন আর উপরে মানুষের বসবাস, এর মানে অগ্নিকুণ্ডে বসবাস করা ছাড়া আর কিছুই নয়। এ জন্য যারা দায়ী তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। রাসায়নিকের ধরন জানতে চাইলে তিনি বলেন, আসলে এগুলো হ্যাজার্ডিয়াস কেমিক্যাল। বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যাল রয়েছে এখানে। এগুলো দেখে বোঝা যাচ্ছে কঠিন হ্যাজার্ডিয়াস কেমিক্যাল। আমরা যখন ঘটনাস্থলে প্রথম আগুন নেভাতে আসি কেমিক্যালগুলোর জন্য অনেক সমস্যা হয়েছে। সম্পূর্ণ অবৈধভাবে কেমিক্যাল খোলা রাখা হয়েছে, যা স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকি। যারা কেমিক্যালগুলো এখানে রেখেছেন, এই মৃত্যুর জন্য তারা দায়ী।

আমারসংবাদ/জেআই