Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪,

নিরাপদ পৃথিবী নিশ্চিত করার তাগিদ

রায়হান আহমেদ তপাদার

এপ্রিল ২৩, ২০২১, ০৭:৫৫ পিএম


নিরাপদ পৃথিবী নিশ্চিত করার তাগিদ

বর্তমান বিশ্বে পরিবেশগত প্রধান সমস্যাসমূহের অন্যতম। এটি জলবায়ুগত এমন এক পরিবর্তন আসন্ন করছে, যা প্রক্রিয়াগতভাবে গ্রিনহাউস প্রভাবের সাথে তুলনীয়। সমস্যাটিকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নিয়ে আসার বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি এ জন্য যে, পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের রাসায়নিক গঠনটি একশ বছর আগের অবস্থা থেকে ইতোমধ্যে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে এবং প্রকৃতপক্ষে বর্তমানের প্রযুক্তিগত অর্জনের মাধ্যমে নিকট ভবিষ্যতে এই পরিবর্তিত অবস্থাকে পূর্বের অবস্থানে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। একশ বছর পূর্বের গড় তাপমাত্রার তুলনায় বর্তমান বিশ্বে গড় তাপমাত্রা প্রায় ০.৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে। কম্পিউটার প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে জলবায়ুগত পরিবর্তন সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে যে, ২১ শতকের সমাপ্তিকালের মধ্যে বিশ্ব তাপমাত্রায় আরও অতিরিক্ত ২.৫-৫.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা যুক্ত হতে পারে। ফলে, পৃথিবীপৃষ্ঠের পানির স্ফীতি, অত্যুচ্চ পর্বতের বরফশীর্ষ এবং মেরু অঞ্চলের হিমবাহের দ্রুত গলনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের পানির উচ্চতার ক্ষেত্রে একটি বৃহৎ পরিবর্তন ঘটতে পারে। বেশ কয়েক দশক ধরে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগ বাড়ানোর তাগিদ অনেকেই দিয়ে আসছেন। যথেষ্ট প্রমাণাদি থাকার পরও পরিলক্ষিত হয়, আমরা গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন বাড়িয়ে চলেছি। তবে করোনা থেকে শিক্ষা নিয়ে, গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হ্রাসে আমাদের উদ্যোগ ও আকাঙ্ক্ষা দুটোই বাড়ানো প্রয়োজন। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়া থেকে রেহাই পেতে তা মোকাবিলায় এখনই পদক্ষেপ না নিলে বিশ্বব্যাপী মানুষের জীবন বিপর্যয়ের মধ্যে পড়বে বলে সতর্ক করেছেন পরিবেশ ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা।

এবং নানা ধরনের মেরুকরণ এবং রাজনীতিকে পাশ কাটিয়ে সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা নিয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নিরাপদ পৃথিবী নিশ্চিত করার তাগিদ দিয়েছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা ভাইরাস অস্থায়ী কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন কয়েক দশক ধরে চলতে থাকবে এবং বিশ্বব্যাপী বিপর্যয় সৃষ্টি করবে। বিশ্বের কোনো অঞ্চলই এ পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়া থেকে রক্ষা পাবে না। ক্রমবর্ধমান পরিবেশ দূষণ দৈনন্দিন জীবনযাত্রা, জনস্বাস্থ্য এবং খাদ্যনিরাপত্তা ব্যবস্থায় বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে। এমনকি ইউরোপের মতো দেশে উত্তাপে শত শত মানুষ মারা যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংকসহ নানা ধরনের আন্তর্জাতিক সংস্থা জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে প্রচারণা চালাচ্ছে, মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা করছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভূমিকার প্রশংসা করে আন্তর্জাতিক সংস্থার সাবেক এ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, একটি নতুন দেশ হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়ার সচেতনতা এবং কর্মপরিকল্পনায় বাংলাদেশ উল্লেখ করার মতো অগ্রগতি করেছে। বাংলাদেশ নিজস্ব অর্থায়নে ক্লাইমেট চেঞ্জ রিজিলিয়েন্স বা বিসিআর তৈরি করেছে, বাস্তবায়ন মেকানিজমসহ পলিসি ডকুমেন্ট তৈরি করেছে। বাংলাদেশ নিজস্ব তহবিল থেকে ১০ বিলিয়ন ডলারের বেশি ব্যয় করেছে জলবায়ু পরিবর্তনের পদক্ষেপ বাস্তবায়নে। বিশ্বের দেশে দেশে পরিবেশ দূষণে সবচেয়ে বড় প্রভাব ফেলে নগর। ফলে সরকারকে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করেই নগরায়ণের পদক্ষেপ নিতে হয়। কিন্তু ঢাকা চট্টগ্রামের মতো শহরগুলো গড়ে উঠেছে পরিকল্পনাহীন। সবচেয়ে চিন্তার বিষয় হচ্ছে, এই শহরগুলোয় সবুজ এলাকা কমে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যে বিপর্যয় তৈরি হচ্ছে, তাতে কী পরিমাণ মানুষ মারা যাচ্ছে, সে হিসাব কখনওই সামনে আসে না। কভিড হচ্ছে অদৃশ্য শক্তি, তবু এর হাত থেকে রেহাই পেতে আমরা টিকা তৈরি করে ফেলেছি। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়া তো চিহ্নিত এবং দৃশ্যমান বিষয়। টিকা দিয়ে এটি দূর করে ফেলতে পারব না।

সারা বিশ্বকে এক হয়ে এ থেকে পরিত্রাণের পথ বের করতে হবে। এবং বৈশ্বিক খাদ্য সুরক্ষার জন্য একটি সহযোগিতা পরিকল্পনা করতে হবে। ধনী, দরিদ্র, উন্নত, অনুন্নত— সব দেশ নিয়েই এটি করতে হবে, কেননা জলবাযু পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়া সব দেশকেই খাদ নিয়ে চিন্তায় ফেলবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিঘাতে প্রাকৃতিকভাবে অনেকটা করোনার মতো, ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যাতে থমকে না যায়, সেটা বিবেচনায় টেকসই জ্বালানি ব্যবহার বৃদ্ধি এবং সর্বোপরি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে সবুজ করা অনেকটাই বাস্তবসম্মত। আমরা গত ডিসেম্বর থেকে দেখেছি, প্রাকৃতিকভাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। প্রাকৃতিক এ পরিবর্তনের অনেক সুফল আমরা দেখেছি; তবে একে টেকসই পরিবর্তন বলা যাবে না। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়ার সঙ্গে গ্রিনহাউস নির্গমন ইতোমধ্যে বাড়া শুরু হয়েছে, কিন্তু অপ্রত্যাশিত এ কর্মকাণ্ড স্থবির বা প্রবৃদ্ধি মন্থর হয়ে যাওয়া থেকেও আমাদের শেখার রয়েছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়ে যাওয়া ঠেকাতে নাগরিক এবং ভোক্তাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। শুধু প্রাকৃতিক শক্তি ব্যবহার করলেই চলবে না বরং শক্তি ব্যবহারে মিতব্যয়ী হতে হবে। যেকোনো দুর্যোগ মোকাবিলায় দ্রুততম সময়ে উদ্যোগ নেয়া। পেছন ফিরে তাকালে দেখা যায়, করোনা পরিস্থিতি তারাই সবচেয়ে ভালো নিয়ন্ত্রণ করতে কিংবা ক্ষয়ক্ষতি কমাতে পেরেছে, যারা তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নিয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের দ্রুততম সময়ে বিভিন্ন খাতে দেয়া প্রণোদনার কারণে অর্থনীতি আবার ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। তেমনি জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায়ও আশু পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। জলবায়ু পরিবর্তনে আমাদের সামগ্রিক জীবনধারার যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে, যা আমরা হয়তো ব্যস্ততার মাঝে কিংবা গতানুগতিক চিন্তাচেতনার কারণে বুঝতে পারি না।

বলা বাহুল্য, পৃথিবীতে প্রতিদিন জ্বালানি কিংবা পানির যে অপচয় হয় তা একটু একটু করে কমিয়ে এনে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হ্রাস করা গেলে, তা জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়ংকর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে আমাদের বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষায় বিশেষ ভূমিকা রাখবে। বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতিগ্রস্ত অনেক দেশের মতো বাংলাদেশও লাখ লাখ মানুষের জীবন, স্বাস্থ্য পরিচর্যা পদ্ধতি ও অর্থনীতিকে নিরাপদ করার চেষ্টা করছে। বৈশ্বিক মোট নিঃসরণের ৮০ শতাংশের জন্য জি-২০ দেশগুলো দায়ী। প্রত্যেকের গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছাড়া বিশ্ব সাফল্যজনকভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি সামাল দিতে পারবে না। উল্লেখ্য যে, বৈশ্বিক উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণে ২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তি এখনো আমাদের জন্য সেরা সুযোগ। এখন পর্যন্ত ১৮৯টি দেশ এই চুক্তিটি অনুমোদন করেছে। এতে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি বন্ধে নিঃসরণ কমাতে সম্মিলিত পদক্ষেপের অঙ্গীকার রয়েছে। বিশ্বব্যাপী ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রার কারণে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় জলবায়ু বিজ্ঞানীরা সতর্কবার্তা দিয়ে বলেছেন, এখনই কিছু করুন নাহলে সংকটের ঝুঁকিতে থাকুন! মেরু অঞ্চলে বরফের স্তর ক্রমেই পাতলা হয়ে আসছে। যা বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির সতর্কবার্তা দেয়। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিবেদন অনুযায়ী তাপমাত্রায় বিপজ্জনক বৃদ্ধি এড়াতে বিশ্বকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। জাতিসংঘের বৈশ্বিক উষ্ণতাবিষয়ক আন্তঃসরকার প্যানেলের (আইপিসিসি) গবেষণায় দেখা যায়, আমাদের গ্রহটি ১২ বছরের মধ্যে তাপমাত্রা বৃদ্ধির চূড়ান্ত সীমা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করতে পারে। যেটা কি না প্রাক-শিল্পযুগের মাত্রার থেকেও বেশি। এতে আবহাওয়া পরিস্থিতি অস্বাভাবিক রূপ নেবে বিশেষ করে চরম দুর্ভিক্ষ, দাবানল, বন্যা সেইসঙ্গে লাখ লাখ মানুষের খাদ্য সংকটের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেবে। সুতরাং তাপমাত্রার এই সীমা অতিক্রম এড়াতে, বিশ্বের উচিত, সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে দ্রুত, সুদূরপ্রসারী ও নজিরবিহীন পরিবর্তন আনা। জার্মানভিত্তিক আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা জার্মানওয়াচ থেকে সম্প্রতি এটি প্রকাশিত হয়েছে।

২০০০ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে ১৮০টি দেশের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের তথ্য নিয়ে এটি তৈরি করা হয়েছে। গত ২০ বছরে দুর্যোগের সংখ্যা, মৃত্যু, ক্ষয়ক্ষতির মোট হিসাব এ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা হয়েছে— গত ২০ বছরে বাংলাদেশে ১৮৫টি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বড় দুর্যোগ আঘাত হেনেছে। এর মধ্যে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, পাহাড়ধসের মতো দুর্যোগ রয়েছে। এতে ১১ হাজার ৪৫০ জন মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। আর অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে ৩৭২ কোটি ডলার। চলতি বছরের প্রতিবেদনে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি জলবায়ু ঝুঁকিতে থাকা দেশের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে পুয়ের্তোরিকো। গতবারও শীর্ষে ছিলো দেশটি। এরপর যথাক্রমে— মিয়ানমার, হাইতি, ফিলিপাইন, মোজাম্বিক, বাহামা। বাংলাদেশ সপ্তম। গতবারও একই অবস্থানে ছিলো। এবার বাংলাদেশের পরে রয়েছে পাকিস্তান, থাইল্যান্ড ও নেপাল। প্রতিবেদনে শুধু ২০১৯ সালে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশ অবস্থানে ১৩তম। ২০১৮ সালে অবস্থান ছিলো ৮৮তম। চলতি বছরের ঝুঁকির তালিকায় থাকা দক্ষিণ এশিয়ার অপর দেশগুলোর মধ্যে ভারতের অবস্থান ২০তম, শ্রীলঙ্কা ২৩তম, ভুটান ১০৫তম এবং মালদ্বীপ ১৭৪তম। ২০১০ সাল থেকে জার্মানওয়াচ বিশ্বের সব কটি দেশের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও ঝুঁকি নিয়ে ওই সূচকভিত্তিক প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে আসছে। এমনকি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আর্থিক ক্ষতি, জীবনের ক্ষতি ও দুর্যোগের আঘাতের মোট সংখ্যাকে বিবেচনায় নেয়া হয়। এজন্য আমাদের আগের চেয়ে আরও বেশি করে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার প্রস্তুতি ও উদ্যোগ নিতে হবে।

লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট

আমারসংবাদ/জেআই