Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪,

কার্বন নিঃসরণ হ্রাসে বিশ্বনেতাদের প্রতিশ্রুতি

মোতাহার হোসেন

এপ্রিল ২৪, ২০২১, ০৮:৩০ পিএম


কার্বন নিঃসরণ হ্রাসে বিশ্বনেতাদের প্রতিশ্রুতি

বৈশ্বিকপর্যায়ে শিল্পোন্নত দেশসমূহ কর্তৃক কার্বন নিঃসরণ ক্রমাগত বৃদ্ধির কারণে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল উত্তপ্ত হচ্ছে। একই কারণে বিশ্বের বরফ আচ্ছাদিত দেশ ও অঞ্চলসমূহে বাড়ছে বরফ গলার পরিমাণ। এতে ক্রমাগত বাড়ছে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা, বাড়ছে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি। বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকিতে থাকা দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। কার্বন নিঃসরণ বৃদ্ধি ও বায়ুমণ্ডল উত্তপ্ত হওয়ার জন্য দায়ী না হয়েও এর অসহায় শিকার বাংলাদেশ। জলবায়ু পরির্বতনজনিত ঝুঁকি হ্রাসে নিজস্ব অর্থায়নে গৃহীত কর্মসূচি বাস্তবায়নে প্রতি বছর বাংলাদেশকে ব্যয় করতে হচ্ছে বিপুল পরিমাণ অর্থ। এমনই এক অবস্থায় কার্বন নিঃসরণ হ্রাসের জন্য অন্যতম দায়ী বিশ্বের দুই প্রভাবশালী দেশ যুক্তরাষ্ট্র ও চীন এক সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার প্রুতিশ্রুতি দেয়। অনুরূপ কানাডা, জাপান, ফ্রান্সসহ বিশ্বের ৪০ দেশও এ ধরনের প্রতিশ্রুতি দেয়। এসব শক্তিধর দেশ কর্তৃক ধরিত্র রক্ষায় কার্বন নিঃসরণ হ্রাসের প্রতিশ্রুতি জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় আশার আলো দেখাচ্ছে বাংলাদেশসহ বিশ্ববাসীকে। এখন অপেক্ষার পালা প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশকে বলা হয় প্রাকৃতিক দুর্যোগের ‘গ্রাউন্ড জিরো’। এ দেশের বহু মানুষের জন্য জলবায়ু পরিবর্তন মানে তাদের আশ্রয়, খাদ্য, বিশুদ্ধ পানীয় জলের সংকট, নারী, শিশু, বয়স্ক নর-নারী, গবাদিপশুর অস্তিত্বের সংকট। প্রতি বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বাংলাদেশ তার জিডিপির ২ শতাংশ হারায়; এই শতকের শেষে তা পৌঁছাবে ৯ শতাংশে। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাবে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা এভাবে বাড়তে থাকলে ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার ১৭ শতাংশ চলে যাবে পানির নিচে, তাতে বাস্তুচ্যুত হবে তিন কোটি মানুষ। এদিকে, জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবিলায় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে বৈশ্বিক পরিমণ্ডলসহ আঞ্চলিক, উপ-আঞ্চলিক এবং স্থানীয় পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট ফোরামে দাবি করে আসছে। এ জন্য ক্ষতিগ্রস্ত দেশসমূহকে প্রয়োজনীয় আর্থিক, প্রযুক্তিগত ও কৌশলগত সহায়তার পাশাপাশি প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে কমিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে একসঙ্গে কাজ করার।

উল্লেখ্য, জাতিসংঘের জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবিলায় অনন্য ভূমিকার জন্য ‘চ্যাম্পিয়ন অব দ্য আর্থ’ সম্মাননা জয়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ডিপ্লোম্যাট ম্যাগাজিনের এপ্রিল সংখ্যায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে লিখেছেন, ‘প্রকৃতির রুদ্ররোষের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ না হলে আমাদের পরাজয় নিশ্চিত। যে প্রকৃতি আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে, খুব সচেতনভাবে আমরা তাকে ধ্বংস করে চলেছি।’ তিনি লিখেছেন, সুইডেনের গ্রেটা থুনবার্গ অথবা বাংলাদেশের কোস্টাল ইয়ুথ অ্যাকশন হাবের তরুণ পরিবেশকর্মীদের জন্য আমরা কোন পৃথিবী রেখে যাবো? তাদের ভবিষ্যৎ আমরা জলাঞ্জলি দিতে পারি না বলেও তিনি মত ব্যক্ত করেন। প্রসঙ্গত, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ। ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের (সিভিএফ) বর্তমান সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঝুঁকিতে থাকা ৪৮ উন্নয়নশীল দেশের জোট ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের বর্তমান সভাপতি হিসেবে এ বছরের নভেম্বরে ইংল্যান্ডের গ্লাসগোতে ২৬তম বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনকে (কপ২৬) অর্থবহ করতে ঐক্যের এ আহ্বান জানান তিনি।

অপরদিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সদ্য বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নের অঙ্গীকার থেকে বেরিয়ে আসায় কার্বন নিঃসরণের বৈশ্বিক উদ্যোগ বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হয়। পরবর্তীতে মার্কিন নির্বাচনে জো বাইডেন নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নের পক্ষে থাকার ঘোষণা দেন। এ চুক্তি বাস্তবায়নে কাজ করার জন্য সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরিকে বিশেষ দূত হিসেবে নিয়োগ দেন। সম্প্রতি জন কেরি বাংলাদেশ সফরে এসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করে জলবায়ু পরিবর্তন জনিত ক্ষতি কমাতে বাংলাদেশের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার কার্যালয়ে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে জন কেরি প্রধানমন্ত্রীর হাতে জো বাইডেনের দেয়া লিডার্স সামিট অন ক্লাইমেটের নিমন্ত্রণপত্র তুলে দেন।

অনুরূপ প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নে যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের একসঙ্গে কাজ করার প্রতিশ্রতির দুদিনের মাথায় জলবায়ু সংকট নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার ঘোষণা দিলো যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। গত ১৮ এপ্রিল যৌথ বিবৃতি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন জানিয়েছে, জলবায়ু পরিববর্তন ইস্যুতে কাজ করার ব্যাপারে তারা পরস্পরকে শক্তিশালী প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এ সময় চীনা জলবায়ুবিষয়ক দূত জিয়ে ঝেনহুয়া ও জন কেরির মধ্যে বৈঠক হয়। এরপর দুই দেশের পক্ষে দেয়া যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, চলতি বছরের শেষে জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আলোচনা শুরুর আগেই এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়া হবে। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বৈশ্বিক সংকট নিরসনে তারা একে অপরকে সহায়তা করার বিষয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। দেশদুটির নেতারা এই সংকট মোকাবিলায় অন্যান্য দেশের সঙ্গেও কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। প্যারিস চুক্তি অনুসারে বার্ষিক গড় উষ্ণায়ন বা কার্বন নিঃসরণ ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখতে দৃঢ়প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে। উল্লেখ্য, জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত, রাশিয়া। এর আগে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির মধ্যস্থতায় প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে প্রত্যাবর্তন করেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন।

বিশ্বের উন্নত দেশসমূহের মাত্রাতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণের কারণে বায়ুমণ্ডল সর্বাধিক উত্তপ্ত হলেও এ জন্য তাদের নেয়া পদক্ষেপ নিতান্তই অপ্রতুল। এ কারণে বাংলাদেশসহ জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত দেশসমূহে প্রতি বছর কোটি কোটি মানুষ ভিটে মাটি হারিয়ে উদ্বাস্তু হচ্ছে। শুধু বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে প্রায় ৬০ লাখেরও বেশি মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছে। অন্যদিকে, সদ্য অনুষ্ঠিত ‘লিডারস সামিট’-এর উদ্বোধনী অধিবেশনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রদত্ত ভিডিও বার্তায় কার্বন নিঃসরণ ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নামিয়ে আনতে ও জলবায়ু সংকট নিরসনে চার দফা প্রস্তাব উত্থাপন করেন। তার প্রস্তাবে কার্বন নিঃসরণ কমানো, জলবায়ুর ক্ষতি প্রশমন, অভিযোজনে বার্ষিক ১০০ বিলিয়ন ডলার ফান্ড নিশ্চিত করা এবং পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির দিকে মনোযোগ দেয়ার তাগিদ দেন। গত ২২ এপ্রিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আয়োজিত জলবায়ুবিষয়ক দুদিনব্যাপী ‘লিডারস সামিট’র উদ্বোধনী সেশনে পাঠানো এক ভিডিও বার্তায় এসব পরামর্শ দেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৪০ বিশ্ব নেতাকে এ সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। যুক্তরাষ্ট্রে শুরু হওয়া দুদিনব্যাপী ভার্চুয়াল শীর্ষ সম্মেলনটি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস উদ্বোধন করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, এ বছর বাংলাদেশ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ‘মুজিববর্ষ’ উদযাপন করছে। আমরা দেশব্যাপী ৩০ লাখ গাছের চারা রোপণের পরিকল্পনা করেছি এবং কম-কার্বনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে ‘মুজিব ক্লাইমেট প্রসপারিটি প্ল্যান’ প্রণয়নের পরিকল্পনা নিয়েছি।’

চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ‘সবুজ উন্নয়নের’ অঙ্গীকার করেন। তিনি বলেন, ২০৬০ সালের মধ্যে চীন ‘কার্বন নিউট্রাল’ দেশ হওয়ার লক্ষ্য অর্জন করবে। শি জিনপিং বলেন, ‘সবুজ পর্বত হলো স্বর্ণের পর্বত’। পরিবেশ সুরক্ষা উৎপাদনশীলতাকে সুরক্ষা দিতে হবে। পরিবেশের উন্নতি করতে হলে উৎপাদনশীলতারও উন্নতি করতে হবে।’ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ২০৩৫ সালের মধ্যে তার দেশের কার্বন নির্গমন ৭৮ শতাংশ কমানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করেন। জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইয়োশিহিদে সুগা ২০৩০ সালের মধ্যে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন ৪৬ শতাংশ কমানোর লক্ষ্যের কথা জানান। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেন, মানবতার জন্য জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় দ্রুত ও বড় পরিসরে সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। তিনি বলেন, ভারত তার দায়িত্ব পালন করছে। উন্নয়ন চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও ভারত পরিচ্ছন্নতা জ্বালানি, দক্ষ জ্বালানি, বনায়ন ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষেত্রে অনেক সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছে। মোদি বলেন, ২০৩০ সালের মধ্যে ৪৫০ গিগাওয়াট নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনের লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ভারত।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও ভার্চুয়ালি জাতিসংঘের মহাসচিব এন্থোনি গুতেরেস, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং, জার্মান চ্যান্সেলর এঞ্জেলা মের্কেল, দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জেই-ইন, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইয়োশিদি সুগা, অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বোরিস জনসন, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জে ব্লিনকেন, মার্কিন প্রেসিডেন্টের জলবায়ুবিষয়ক বিশেষ দূত জন কেরিসহ বিশ্বের অন্য দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানরা তাদের বক্তব্য উপস্থাপন করে কার্বন নিঃসরণ হ্রাসের প্রতিশ্রুতি প্রদান করে। জলবায়ু ঝুঁকিতে থাকা দেশের নাগরিক হিসেবে কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে বাংলাদেশসহ ধরিত্রী রক্ষায় বিশ্ব নেতাদের এই প্রতিশ্রুতি আমাদের আশাবাদী করে।

লেখক : সাংবাদিক, সাধারণ সম্পাদক-বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম

আমারসংবাদ/জেআই