Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪,

ওরাই ভ্যারিয়েন্টের হুমকি!

মাহমুদুল হাসান

এপ্রিল ২৬, ২০২১, ০৭:১০ পিএম


ওরাই ভ্যারিয়েন্টের হুমকি!
  • রোগীরা কেন হাসপাতাল থেকে পালাতে চায় -ডা. মো. মুশতাক হোসেন, উপদেষ্টা, আইইডিসিআর
  • কারো অবহেলায় রোগী পালিয়ে গেলেই ব্যবস্থা -ডা. শেখ আবু শাহীন, সিভিল সার্জন, যশোর
  • চিহ্নিতদের হাসপাতালে ফেরত আনা হয়েছে -মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, যশোর জেলা পুলিশ

করোনা ভাইরাসে লণ্ডভণ্ড গোটা ভারত। বাড়ছে লাশের সারি। শ্মশানে সৎকারের অপেক্ষায় লাশের জট। সম্প্রতি আলোচিত যুক্তরাজ্য, ব্রাজিল ও আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্টের চেয়ে ইন্ডিয়ান ভ্যারিয়েন্ট কয়েকগুণ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। বারবার ভাইরাসের গতি ও প্রকৃতি পরিবর্তন হচ্ছে। ফলে ভারতে সংকট আরও ঘনীভূত হচ্ছে। প্রতিবেশীর শ্মশানের আভা যেনো এদেশেও লেগেছে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে নজেহাল গোটা দেশ। ভারতের পরিস্থিতি আতঙ্ক তৈরি করেছে। সংক্রমণ যেনো দেশে প্রবেশ না করে সেজন্য গতকাল থেকে দেশের সব সীমান্ত দুই সপ্তাহের জন্য বন্ধ করা হয়েছে। শেষ সময়ে বন্ধ করেও লাভ হয়নি। শেষ ১০ দিনে তিন হাজার ৮০১ জন বাংলাদেশি বেনাপোল আন্তর্জাতিক চেকপোস্ট দিয়ে দেশে প্রবেশ করেছেন। তাদের সবার করোনা নেগেটিভ সার্টিফিকেট থাকলেও ১২ জনের শরীরে করোনা শনাক্ত হয়।

ধারণা করা হচ্ছে, দেশে ইন্ডিয়ান ভ্যারিয়েন্ট গোপনে ছড়িয়ে পড়তে পারে। সম্প্রতি সেই ধারণা আরও পোক্ত হয়েছে। যশোর জেলা সদর হাসপাতাল থেকে ভারতফেরত যশোর, খুলনা ও রাজবাড়ীর ১০ করোনা রোগী পালিয়ে যাওয়ার কথা বলা হলেও সংশ্লিষ্ট প্রশাসন বলছে সাত করোনারোগী পালিয়েছে। পালিয়ে প্রত্যেকে তাদের পরিবারের সঙ্গে মেলামেশা করেছে। এতে পরিবার ও আশপাশে করোনা ছড়িয়ে পড়তে পারে। অল্প সময়ে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা তৈরি করেছে।

হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, বেনাপোল স্থলবন্দর হয়ে গত ১৮ থেকে ২৪ এপ্রিল যশোর, খুলনা ও রাজবাড়ীর সাত করোনা রোগী দেশে প্রবেশ করে। তাদের যশোর ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হাসপাতালের জরুরি বিভাগ থেকে তাদের তৃতীয় তলার করোনা ওয়ার্ডে পাঠানো হয়। কিন্তু তারা সেখানে না গিয়ে হাসপাতাল থেকেই পালিয়ে যান। পালিয়ে যাওয়া সাতজন হলেন— যশোর শহরের পশ্চিম বারান্দিপাড়া এলাকার মণিমালা দত্ত (৪৯), সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার প্রতাপপাড়া গ্রামের মিলন হোসেন (৩২), কালীগঞ্জ উপজেলার শেফালি রানী সরদার (৪০), রাজবাড়ী সদর উপজেলার রামকান্তপুর গ্রামের নাসিমা আক্তার (৫০), খুলনা সদর উপজেলার বিবেকানন্দ (৫২), পাইকগাছা উপজেলার ডামরাইল গ্রামের আমিরুল সানা (৫২) ও রূপসা উপজেলার সোহেল সরদার (১৭)। ভারতের ভয়াবহ পরিস্থিতিতে এই রোগীরা পালিয়ে যাওয়ায় জনমনে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, হাসপাতালের নার্স ও কর্মচারীদের অবহেলার কারণে তারা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন। সোস্যাল মিডিয়াতেও এ নিয়ে সমালোচনার ঝড় বয়ে গেছে।

আরিফ হোসেন নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর পর্যায়ের এক শিক্ষার্থী লিখেন, হাসপাতাল থেকে এক এক করে ভারত থেকে আসা করোনা রোগী পালিয়ে গেলো! এক সপ্তাহ পর সেটা জানা গেলো তাহলে হাসপাতাল প্রশাসন কিংবা পুলিশ করলোটা কি? লকডাউনে এসব কীভাবে ঘটে? হাসপাতাল প্রশাসন দায় এড়াতে পারে না, তাদের অবহেলায় রোগীরা পালিয়েছে। মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে রোগী পালাতে সহায়তা করতে পারে। জড়িতদের সবাইকে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসতে হবে।

নোয়াখালীর শহীদ বুলু স্টেডিয়ামের অস্থায়ী কোভিড হাসপাতালের রোগীরা বেরিয়ে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছেন। প্রয়োজন মতো কেনাকাটা কিংবা আড্ডায় মজে থাকছেন বলেও অভিযোগ ওঠে। দেশজুড়েই চলছে এমন অব্যবস্থাপনা। গত বছর মার্চের শুরুতে ভাইরাসটি দেশে শনাক্ত হলে অনেকেই বিমানবন্দর থেকে পালিয়ে বাড়ি গিয়ে পরিবার ও আশপাশে ভাইরাসটি ছড়িয়েছেন। অনেকে শনাক্ত হয়ে হাসপাতাল থেকেও পালিয়েছিলেন। ফলে অল্প সময়েই ভাইরাসটি রাজধানীসহ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। এবারো অবহেলায় ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়তে পারে।

জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, প্রতিবেশী দেশের ভয়াবহতা এদেশেও ছড়িয়ে পড়ার বড় ঝুঁকি রয়েছে। নিজেদের নিরাপদ রাখতে হলে করোনা মোকাবিলায় আরও কঠোর হতে হবে। শনাক্ত রোগী কোনো ক্রিমিনাল নয়। তাদের অভয় দিয়ে হাসপাতালে নিয়ে আসতে হবে। খুঁজে বের করতে হবে রোগীরা কেনো হাসপাতাল ছেড়ে পালাতে চায়। এক্ষেত্রে যশোরে যেটি ঘটেছে দুঃখজনক। পুলিশ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের গাফলতি রয়েছে। তদন্তসাপেক্ষে অবহেলায় জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।

সিভিল সার্জন জানিয়েছেন, ওয়ার্ডে না গিয়ে পালিয়ে যাওয়া সাত রোগীকে হাসপাতালে ফিরিয়ে আনতে তারা তৎপর। যাদের অবহেলায় এ ঘটনা ঘটেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

২৫০ শয্যাবিশিষ্ট যশোর জেনারেল হাসপাতাল তত্ত্বাবধায়ক দিলীপ কুমার রায় বলেন, ভারত থেকে করোনায় আক্রান্ত হয়ে কোনো রোগী হাসপাতালে আনা হলে তা পুলিশ স্কট করে দিয়ে যাবে। একইসাথে তাদের পাসপোর্ট পুলিশ হাসপাতালে জমা করবে। কিন্তু তার কোনোটাই করা হয়নি।

তিনি বলেন, পালিয়ে যাওয়া সাত করোনা রোগীকে হাসপাতালে ফেরত আনা হচ্ছে। হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডে ভর্তি থেকে তারা চিকিৎসা নেবেন। যশোর জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম বলেন, সোর্সের মাধ্যমে প্রথমে আমরা জানতে পেরেছি ২৫০ শয্যার যশোর জেনারেল হাসপাতাল থেকে ভারতফেরত করোনা রোগী পালিয়েছে। রোগী ভর্তি রেজিস্টারে ঠিকানা অনুসারে তাদের হাসপাতালে ফিরিয়ে আনতে সংশ্লিষ্ট জেলায় খবর পাঠানোর পর তালিকা ধরে সবাইকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হচ্ছে। আজ (গতকাল সোমবার) রাতেই সবাইকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হচ্ছে।

যশোর জেলা সিভিল সার্জন ডা. শেখ আবু শাহীন ভারতফেরত দশ করোনা রোগী পালানোর কথা বলছেন। আসলে পালিয়েছে সাত করোনা রোগী। তারা যশোর, খুলনা ও রাজবাড়ী জেলার বাসিন্দা। তাদের ঠিকানা সংগ্রহ করে ইতোমধ্যেই হাসপাতালে ফিরিয়ে আনতে কাজ করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, ভারতফেরত ভর্তি করোনা রোগীদের পাসপোর্ট হাসপাতালের নার্সদের কাছে জমা থাকার কথা। কিন্তু সেটা ছিলো না। কেন সেটা ছিলো না এবং হাসপাতালের নিরাপত্তাব্যবস্থা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। কারো অবহেলায় রোগী পালিয়ে গেলে কিংবা কেউ অন্যকোনো সুবিধা নিয়ে রোগী পালাতে সহায়তা করলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মো. মুশতাক হোসেন বলেন, ভারতে মিক্সড ভাইরাসের ভ্যারিয়েন্ট তৈরি হতে পারে। কেননা সেখানে রাজ্যে রাজ্যে চলছে নির্বাচন। এক অঞ্চলের মানুষ সংক্রমিত হয়ে ভাইরাস বহন করে অন্যত্র নিয়ে যাচ্ছে। এতে ভাইরাসের ক্ষীপ্রতা বাড়ছে। গতি ও ক্ষমতা পরিবর্তন হচ্ছে। বাংলাদেশেও গতবছর নভেম্বর থেকে মানুষ স্বাস্থ্যবিধি ভুলে সভা-সমাবেশ, মিছিল-মিটিং, ভ্রমণ ও সামাজিক অনুষ্ঠানে লিপ্ত যায়। ফলে ভারতের মতো একই কারণে দ্বিতীয় ঢেউ শনাক্ত-মৃত্যু বাড়িয়ে তুলছে।

তিনি বলেন, রোগীকে মানবিকভাবে দেখতে হবে। রোগী কোনো ক্রিমিনাল নয়। তাকে হৈচৈ করে ধরে না এনে বুঝিয়ে আনতে হবে। অভয় দিতে হবে যে বাড়ি থেকে হাসপাতাল তার জন্য নিরাপদ। নয়তো যশোরের মতো অন্যান্য যায়গায়ও রোগীরা হাসপাতাল থেকে পালাবে। খুঁজে বের করতে হবে রোগীরা কেনো হাসপাতাল ছেড়ে পালাতে চায়।

আমারসংবাদ/জেআই