Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪,

অনিষ্পন্ন মামলা বেড়েছে ১৭ লাখ

এপ্রিল ২৬, ২০২১, ০৭:১০ পিএম


অনিষ্পন্ন মামলা বেড়েছে ১৭ লাখ
  • মামলাজট কমাতে কোনো উদ্যোগেও সফলতা নেই
  • নেই বিচারক ও অবকাঠামো সংকটের সমাধান
  • প্রতি লাখ মানুষের বিপরীতে বিচারক মাত্র একজন
  • অনেক জেলায় এখনো নির্মাণ হয়নি চিফ জুডিশিয়াল ভবন
  • বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি ব্যাপকভাবে গ্রহণ করা জরুরি -ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ

মামলাজট বেড়েই চলছে। নানা উদ্যোগের পরও জট কমানো সম্ভব হচ্ছে না। অপরাধ সংগঠিত হলেই নিয়মিত মামলাও হচ্ছে। তবে বিচার প্রক্রিয়ায় এসেই থমকে যাচ্ছে। আদালতে মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে নামমাত্র। নিম্ন আদালতই নয়, মামলার পাহাড় জমেছে উচ্চ আদালতেও। মামলা দায়েরের চেয়ে নিষ্পত্তির হার কমেই চলছে। আর এতেই সৃষ্টি হয়েছে ভয়াবহ মামলার মহাজট। ফলে বিচারপ্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হওয়ায় ভুগছেন বিচারপ্রার্থীরা।

এদিকে বিচারক সংকট ও বিচার সহায়ক অবকাঠামো উন্নয়নের ঘাটতিকে মামলাজট ও বিচার ধীরগতির অন্যতম কারণ হিসেবে দায়ী করেছেন বিশ্লেষকরা। প্রয়োজনীয় বিচারক সংকটের কারণে মামলা জমে আছে বলেও অভিযোগ করেছেন তারা। তবে গত ১৮ এপ্রিল এক ভার্চুয়াল শুনানিতে যুক্ত হয়ে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বলেছেন ভিন্ন কথা।

তিনি বলেন, ‘যা আছে তার চেয়েও তিনগুণ বিচারক দরকার, নইলে কখনো মামলাজট কমানো সম্ভব হবে না। আবার নিম্ন আদালতে দুপুরের পর আইনজীবীদের পাওয়া যায় না। এজন্য সকালের পরিবর্তে বিকালে জামিন শুনানির জন্য বিচারকদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তাতে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। কিন্তু করোনার কারণে সেই সিদ্ধান্ত এখন বহাল রাখা যাচ্ছে না।’ জবাবে আইনজীবীরা বলেন, শুধু আইনজীবী কেন, নিম্ন আদালতে দুপুরের পর অনেক বিচারকও এজলাসে বসেন না। বর্তমানে উচ্চ আদালতসহ নিম্ন আদালতগুলোতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা প্রায় ৩৮ লক্ষাধিক। এসব মামলার নিষ্পত্তি নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে বিচার বিভাগ। মামলাজট কমাতে নেয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। কিন্তু কোনো উদ্যোগেই মামলার জট কমছে না। দিন দিন আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিচার বিভাগের এই বেহাল দশার মধ্যেই আবার জেঁকে বসেছে প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস। ফলে সংকট আরও ঘনীভূত হচ্ছে। এদিকে করোনা ভাইরাস পরিস্থিতি কবে নাগাদ স্বাভাবিক হবে সেটারও নেই কোনো নিশ্চয়তা। ফলে মামলাজট আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে বলে হুঁশিয়ারি করেছেন বিচারসংশ্লিষ্টরা।

বিচারক ও আইনজীবীরা জানান, বিচার বিভাগ পৃথক হওয়ার পর থেকে সিএমএম আদালতে বিচারক সংকট কমলেও দেওয়ানি আদালতে সংকট এখনো রয়েছে। তবে এখনো অনেক জেলায় চিফ জুডিশিয়াল ভবন নির্মাণ সম্ভব হয়নি। ভবন তো দূরের কথা এখনো জমিই অধিগ্রহণ করা যায়নি। মামলার তুলনায় বিচারকের সংখ্যা কম হওয়ায় মামলা নিষ্পত্তিতে দেরি হচ্ছে। ভবন নির্মাণে কোথাও জমি অধিগ্রহণ নিয়ে জটিলতা রয়েছে। এক জমির মালিকানা দাবি করছে দু-তিন মন্ত্রণালয়। জমি অধিগ্রহণের জটিলতার সমাধান করে ভবন নির্মাণের তাগিদ দেয়া হয়েছে বারবার। জায়গা নিয়ে গোলমাল, দু-তিন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে এটি সুরাহা হয় না। এছাড়া নানাবিধ সমস্যার কারণে মামলাজট দিন দিন বাড়ছে।

আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিভিন্ন আইনে আপসযোগ্য মামলায় বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা যেমন মধ্যস্থতা, সালিশ ও আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে পক্ষগণের বিরোধ নিষ্পত্তি করে মামলার প্রবণতা থেকে মানুষকে দমিয়ে আনা সম্ভব হলে লাখ লাখ মামলা আদালত পর্যন্ত আসবে না। কিন্তু এ পদ্ধতিও প্রতিপালিত হচ্ছে না যথাযথভাবে। তাই জট কমানো সম্ভব হচ্ছে না।

বিশেষজ্ঞদের মতে, মামলা উদ্ভবের কারণ চিহ্নিত করে মামলার জট সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসতে না পারলে বিচারপ্রার্থী মানুষ আইন ও বিচার বিভাগ নিয়ে আস্থার সংকটে পড়বে। মামলাজটের এ ঊর্ধ্বমুখিতাকে ভয়াবহ আখ্যায়িত করে একে বিচার বিভাগের জন্য অশনি সংকেত বলছেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা। তাদের মতে, মামলা উদ্ভবের কারণ চিহ্নিত করে মামলার জট অবশ্যই সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে। ব্যত্যয় হলে বিচারপ্রার্থী মানুষ আইন ও বিচার বিভাগ নিয়ে আস্থার সংকটে পড়বে।

সুপ্রিম কোর্টের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, উচ্চ আদালতসহ নিম্ন আদালতে প্রায় ৩৮ লাখ মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে ২৩ হাজার ৬১৭, হাইকোর্ট বিভাগে চার লাখ ৮৯ হাজার ৬৮টি এবং অধঃস্তন আদালতে ৩১ লাখ ৭২ হাজার ৪৩টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। সে হিসাবে মাত্র এক দশকে মামলা বেড়েছে ১৬ লাখের বেশি। ২০২০ সালের প্রায় শুরু থেকে করোনা ভাইরাসের কারণে দীর্ঘ সময় উচ্চ ও অধঃস্তন আদালত বন্ধ থাকে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ২০২১ সালের মামলার পরিসংখ্যান প্রস্তুতের সম্পন্নের কাজ চলছে।

এদিকে ২০১১ সালের শেষে দেশের উচ্চ ও অধঃস্তন আদালতে বিচারাধীন অনিষ্পন্ন মামলার সংখ্যা ছিলো ২১ লাখ ৩২ হাজার। এখন সেটা ৩৮ লাখ ছাড়িয়েছে। সে হিসাবে মাত্র এক দশকে মামলা বেড়েছে ১৭ লাখের বেশি।

জট কমাতে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির তাগিদ দিয়ে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, ‘মামলা বাড়লে শুনানিও দীর্ঘায়িত হচ্ছে। আজকে পাঁচটা মামলা হলো। এর মধ্যে একটার শুনানি করতে চলে গেলো ১৫ দিন। এদিকে প্রতিদিন নতুন মামলা ফাইল হচ্ছে। এসব কারণে কিন্তু মামলার দীর্ঘসূত্রতা হয়। মামলার জট বাড়ে। এখন কাদের স্বার্থে মামলা জিইয়ে রাখা হচ্ছে বুঝি না। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে একটা মামলা থেকে আরেকটা মামলা সৃষ্টি হচ্ছে। বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (এডিআর) ব্যবস্থা কেন ব্যাপকভাবে গ্রহণ করা হচ্ছে না বোধগম্য নয়। খুন, ধর্ষণ, নারী ও শিশু নির্যাতনের মতো গুরুতর ফৌজদারি মামলা এবং গুরুত্বপূর্ণ দেওয়ানি মামলা ছাড়া অন্যান্য আপসযোগ্য মামলাগুলো শুধু সালিশ, মধ্যস্থতা ও আলোচনার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা সম্ভব। তাহলে এত মামলার জট হবে না, উভয়পক্ষ সন্তুষ্ট হবে এবং সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরে আসবে।’

এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘অনেক মামলার পাঁচ বছরেও বিচার শুরু হবে না, ২০ বছরেও বিচার শেষ হবে না এ ধরনের অসৎ সাহসটা কিন্তু সরকারের প্রশাসন যারা চালায় বা তদন্ত করে তাদের সম্মিলিত ফলাফল। এর দায়টাও সরকারের ওপরই পড়ে। এ দুই ধারার ক্ষেত্রেই সরকার বা প্রশাসন যত ভালো ব্যবস্থা নেবে মামলা তত কমে আসবে। সরকারকে গুরুত্ব দিয়ে মহাপরিকল্পনা করতে হবে। না হলে কোনো লাভ হবে না।’

প্রশিক্ষণ কর্মশালায় ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী বলেছেন, ‘প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে মামলাজট কমানোর জন্য মেডিয়েশন (মধ্যস্থতা) পদ্ধতি প্রয়োগের বিকল্প নেই। তিনি বিচারকদের উদ্দেশে বলেন, সুশৃঙ্খল অবস্থায় মেডিয়েশনের প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর বিচার কাজে তা প্রয়োগের মাধ্যমে মামলাজট কমানো সম্ভব।’

প্রধান বিচারপতির উদ্বেগ : এদিকে বিচারাধীন ৩০ লাখ মামলা নিষ্পত্তির জন্য বর্তমানে যে পরিমাণ বিচারক রয়েছেন, এর  তিনগুণ বিচারক দরকার, নইলে কখনো মামলাজট কমানো সম্ভব হবে না বলে মন্তব্য করেছেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। গত ১৮ এপ্রিল আপিল বিভাগের ভার্চুয়াল বেঞ্চে আইনজীবীদের উদ্দেশে প্রধান বিচারপতি এসব কথা বলেন। সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বলেন, ‘২০০৭ সালে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ হয়েছে। কিন্তু অনেক জেলায় এখনো চিফ জুডিশিয়াল ভবন নির্মাণ সম্পন্ন হয়নি। কোথাও জমি অধিগ্রহণ নিয়ে জটিলতা রয়েছে। এক জমির মালিকানা দাবি করছে দু-তিন মন্ত্রণালয়। জমি অধিগ্রহণের জটিলতার সমাধান করে ভবন নির্মাণের তাগিদ দেয়া হয়েছে বারবার।’ জায়গা নিয়ে গোলমাল, দু-তিন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে এটি সুরাহা হয় না। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সহ-সভাপতি আইনজীবী মো. ওজিউল্লাহ বলেন, ‘মামলা দায়েরের সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। আগের চেয়ে এখন মামলা দায়েরের হারও বেশি।’ এরপর প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘নিম্ন আদালতে দুপুরের পর আইনজীবীদের পাওয়া যায় না। এজন্য সকালের পরিবর্তে বিকালে জামিন শুনানির জন্য বিচারকদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তাতে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। কিন্তু করোনার কারণে সেই সিদ্ধান্ত এখন বহাল রাখা যাচ্ছে না।’ জবাবে আইনজীবীরা বলেন, শুধু আইনজীবী কেন, নিম্ন আদালতে দুপুরের পর অনেক বিচারকও এজলাসে বসেন না। পরে আদালত এ দিনের কার্যক্রম অনুসারে কার্যতালিকায় থাকা মামলার ওপর শুনানি করেন।

আমারসংবাদ/জেআই