Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪,

প্রজ্ঞাপনেই লকডাউন!

এপ্রিল ২৮, ২০২১, ০৮:১৫ পিএম


প্রজ্ঞাপনেই লকডাউন!
  • দ্বিতীয় ঢেউয়ের তৃতীয় দফায় বিধিনিষেধ ঘোষণা
  • সরব ভূমিকায় থাকা পুলিশ হয়ে গেছে নিষ্প্রভ, চেকপোস্টে দেখা যাচ্ছে না উপস্থিতি
  • সড়কে বেড়েছে যান ও মানুষ চলাচল, কমছে চেকিং
  • শপিংমলে রাতে বাড়ছে ক্রেতাদের ভিড়, স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষিত
  • গাড়ির বাড়তি চাপ, চেক করে কুলিয়ে ওঠা কঠিন —পুলিশ 
  • লকডাউন নয়, কর্মসূচি হাতে নিতে হবে, যার মাধ্যমে মানুষের আচরণ বদলাবে এবং মানুষ এলাকাভিত্তিক দায়িত্বও নেবে, তবেই এর থেকে উত্তরণ ঘটবে -ড. বদিউল আলম মজুমদার, সুজন সম্পাদক 

করোনা ভাইরাসে বিধ্বস্ত ভারতের বর্তমান অবস্থা পুরো বিশ্বের জন্যই সৃষ্টি করেছে আশঙ্কা ও মারাত্মক উদ্বেগ। দেশটিতে ব্যাপক মাত্রায় সংক্রমণ ও উচ্চহারে মৃত্যু ভাবিয়ে তুলছে বিশ্বনেতাদের। কেননা, এই সংকট কেবল ভারতের জন্যই নয়, বরং এখন সারা পৃথিবীর জন্যও সংকটে পরিণত হতে যাচ্ছে। যেখানে বিশ্বনেতাদের ভাবনায় চলমান করোনা সংকট, সেখানে ভারতের পার্শ্ববর্তী দেশ হয়েও বাংলাদেশে সরকার-প্রশাসনের সঙ্গে ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে জনসাধারণসহ লকডাউন নিয়ে বিভিন্ন মহলের মধ্যে চলছে যেনো চোর-পুলিশ খেলা। আবার একের পর এক লকডাউনের ঘোষণা দিলেও যেনো কার্যকর হচ্ছে না। মানতে চাইছে না কেউই।

লকডাউন বাস্তবায়নে সম্মুখযোদ্ধা পুলিশের সঙ্গেও দেশের বিভিন্ন স্থানে ইতোমধ্যে ঘটে গেছে একাধিক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। বর্তমান সময়ে করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা যেমন তেমন, সরকার ঘোষিত চলমান লকডাউনের মধ্যেও অবাধ চলাফেরায় কয়েকগুণ বেড়ে যেতে পারে করোনা সংক্রমণ— এমনটা আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এমতাবস্থায় ভারতের বর্তমান সংকটের চিত্র একটুও প্রভাব ফেলেনি দেশের মানুষের মধ্যে, বরং সংকটের তোয়াক্কা না করেই হরদমই চলছে জনজীবন। সড়কে যানজট আর শপিংমলে জনজটে যেনো সরকার ঘোষিত লকডাউনও সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে প্রজ্ঞাপনেই। 

এদিকে করোনার প্রথম ঢেউ মোকাবিলায় সরকার ঘোষিত লকডাউন যতটা না কার্যকর ভূমিকা রেখেছিল দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় প্রথম দফার লকডাউনে ততটা তো দূরের কথা বরং মানেইনি মানুষ। সাধারণ মানুষের ভাষ্য, জীবন ও জীবিকার তাগিদেই রাস্তায় নামতে হচ্ছে। এদিকে রাস্তার তীব্র যানজট লকডাউনকে রীতিমত তামাশায় পরিণত করেছিল। এরকম বাস্তবতায় করোনার ঊর্ধ্বগতি ঠেকাতে দ্বিতীয় দফায় আটদিনের জন্য সর্বাত্মক লকডাউনের সিদ্ধান্ত নেয়। সেসময় শঙ্কা ছিলো— শেষ পর্যন্ত সর্বাত্মক লকডাউন সফল হবে কি-না। দিন শেষে সে লকডাউন কার্যকরেও পুলিশের ভূমিকাসহ বহুবিধ জটিলতায় অনেকটাই অকার্যকর হয়ে পড়ে। তবুও একই ধারাবহিকতায় সরকার ঘোষিত সেসব বিধিনিষেধের দুদফা শেষে এখন আবার তৃতীয় দফায় পড়েছে (আগামী ৫ মে পর্যন্ত)। কিন্তু বিধিনিষেধের শুরুর দিকে জনসমাগম ও গাড়ি চলাচল নিয়ন্ত্রণে পুলিশের বিতর্কিত দু’-একটি ঘটনা ছাড়াও সরব যে ভূমিকা ছিলো, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাও নিষ্প্রভ হয়ে গেছে। চেকপোস্টগুলোতেও শুরুর দিকে পুলিশের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো হলেও এখন আর তেমনটি দেখা যাচ্ছে না। আবার কোথাও কোথাও চেকপোস্টই গায়েব হয়ে গেছে। মুভমেন্ট পাস নিয়ে বিধিনিষেধের শুরুতে যে কড়াকড়ি ছিলো তাও এখন আলোচনা থেকে বহু দূরে। এখন আর মুভমেন্ট পাস চেক করতে দেখা যাচ্ছে না পুলিশকে। তবে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এখনো চলছে মুভমেন্ট পাস চেকিং। কিন্তু পিক-আওয়ারে সব গাড়িকে একসঙ্গে ধরে চেক করা সম্ভব হচ্ছে না।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম বলেন, লকডাউন আসলে লকডাউনই হওয়া উচিত। তাছাড়া সরকারকে কোনো কিছু কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে, সে আলামত আমরা দেখিনি। আর সবচেয়ে বড় কথা, লকডাউন কোনো সমাধান নয়। কার্যত লকডাউন মানে কতগুলো বিধিনিষেধ।

তিনি বলেন, আমাদের কতগুলো কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। যার মাধ্যমে মানুষের আচরণ বদলাবে এবং এর মাধ্যমে মানুষ এলাকাভিত্তিক দায়িত্বও নেবে, তবেই এটা থেকে উত্তরণ ঘটবে। শুধু লকডাউন দিয়ে হবে না। কিছু কর্মসূচি হাতে নেবে, কিন্তু কি কর্মসূচি হাতে নিচ্ছে সরকার এটা আমি নিশ্চিত নই। সরকার তো একলা চলো..., আর এক্ষেত্রে একলা চললে তো হবে না। 

গতকাল বুধবার সরেজমিন রাজধানীর মাতুয়াইল, রায়েরবাগ, শনির আখড়া, কাজলা হয়ে বকশিবাজার মোড়, সাত মসজিদ রোড, মিরপুর রোড, এলিফ্যান্ট রোড ঘুরে দেখা যায়, প্রায় প্রতিটি চেকপোস্টেই নীরব ভূমিকায় রয়েছে পুলিশ। ধানমন্ডির বিভিন্ন মোড় ও রোডের মাথায় চেকপোস্টে পুলিশ সদস্যদের উপস্থিতিই চোখে পড়েনি। আবাহনী মাঠের সামনে চেকপোস্টে পুলিশ সদস্যরা থাকলেও রয়েছেন নীরব ভূমিকায়। সিটি কলেজের সামনের চেকপোস্টে শুধু দুজন পুলিশ সদস্যকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। রাসেল স্কয়ারের চেকপোস্ট আর নেই। শুরুর দিকে আলোচনায় থাকা এলিফ্যান্ট রোডের চেকপোস্টটিও যেনো ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। বকশিবাজার মোড়েও দেখা গেছে একই চিত্র। পক্ষান্তরে কোথাও কোথাও দেখা মিলেছে যানজটের। মিলেছে স্টাফ বাসে করে যাত্রী পরিবহনের দৃশ্যও। 

পথচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শুরুর দিকে পুলিশ ব্যাপক চেকিং করত, যেনো তাদের অতিক্রম করাই ছিলো দুঃসাধ্য কাজ। কিন্তু কয়েকদিন ধরে রাস্তায় পুলিশ আর কিছু বলছে না। রাস্তায় দিন দিন মানুষের সংখ্যা বাড়ছে আর পুলিশে যেনো নীরব হয়ে গেছে।  

পুলিশ সদস্যরা বলছেন, কারণ থাক বা না থাক, মানুষ রাস্তায় বের হবেই। অনেকে বুঝেনই না মুভমেন্ট পাস কী। আবার যারা বুঝেন, তাদের অনেকে নেন না। উল্টো পুলিশের সঙ্গে তর্ক করেন। জনগণের সহযোগিতা করার মনোভাব নেই বললেই চলে। এমন একটা দুঃসময় কাটিয়ে উঠতে তো আমরা সবাই চেষ্টা করছি। যদি সহযোগিতা না করে, তাহলে কথা বলে কতক্ষণ?

একাধিক অফিসগামী ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অফিসের প্রয়োজনেই বাসা থেকে বের হতে হয়। শুরুর দিকে মুভমেন্ট পাস নিয়েই বাসা থেকে বের হলেও বেশ কয়েকদিন মুভমেন্ট পাস নিয়েই বের হতে হয়েছে। পুলিশ রাস্তায় চেকও করেছে। কিন্তু কয়েকদিন ধরে পুলিশ আর কিছু বলছে না। এখন আর আগের মতো সব জায়গায় দাঁড়াতে হয় না। সবাই স্বাভাবিকভাবেই চলাচল করছে।

ট্রাফিক বিভাগের ধানমন্ডি জোনের এসি জাহিদ আহসান বলেন, যেহেতু সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী এখনো লকডাউন চলমান, সেহেতু আমাদের চেকপোস্ট এখনো কার্যকর আছে। রাস্তায় গাড়ির চাপ এখন অতিরিক্ত। পিক আওয়ারে যদি সবগুলো গাড়ি একসঙ্গে চেক করতে যাই, তাহলে রাস্তায় মানুষের ভোগান্তি বেড়ে যাবে। যার ফলে ওই সময় যাদেরকে দেখে মনে হচ্ছে যে জরুরি প্রয়োজনে বের হননি, তাদেরকে আমরা শুধু চেক করছি।’ ট্রাফিক বিভাগের রমনা জোনের এসি মো. রেফাতুল ইসলাম বলেন, ‘রোববার থেকে রাস্তায় গাড়ির তীব্র চাপ। চেকপোস্টগুলোতে চেক করে কুলিয়ে উঠতে পারছি না। সব গাড়ি যদি চেক করতে যাই, তাহলে রাস্তায় চলাচল অসম্ভব হয়ে পড়বে। সব গাড়ি চেক করতে গিয়ে হয়তো ৪০ থেকে ৫০টা মামলা হবে, তাতে কিছুই হবে না। উল্টো লোকজন ভোগান্তিতে পড়বে। মোটামুটি অনেক গাড়ি রাস্তায় বের হয়েছে। যারা বের হচ্ছেন, প্রত্যেকেরই কোনো না কোনো কারণ আছেই।

সড়ক ছাড়াও রাজধানীর বিভিন্ন শপিংমলগুলোতেও সন্ধ্যার পর জনজটের দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমেও উঠে আসছে সে চিত্রসহ তথ্য। সবচেয়ে বেশি ভিড় লক্ষ করা যাচ্ছে রাজধানীর নিউমার্কেট, গাউছিয়া, চাঁদনীচকে। তবে গতকাল দুপুরে শনির আখড়ার আয়েশা সুপার মার্কেট ও আর এস টাওয়ারে সরেজমিন ঘুরে ক্রেতাশূন্য দেখা গেছে। তবে সন্ধ্যার পর ক্রেতাদেও চাপ কিছুটা বাড়লেও নিউমার্কেটের মতো হয় না বলে জানিয়েছেন দোকানিরা।

আমারসংবাদ/জেআই