Amar Sangbad
ঢাকা বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪,

পদ্মায় ঝরলো ২৭ প্রাণ

মে ৩, ২০২১, ০৮:১৫ পিএম


পদ্মায় ঝরলো ২৭ প্রাণ
  • একই রুটে চলতি বছর সাত স্পিডবোট দুর্ঘটনা
  • ঘটনা তদন্তে ছয় সদস্যের কমিটি গঠন
  • স্পিডবোটচালক আটক
  • আটজনের লাশ নিলেন স্বজনরা
  • প্রশাসনকে ম্যানেজ না করে লকডাউনে স্পিডবোট চালানো কঠিন, সিন্ডিকেটও বিশাল, জড়িত ক্ষমতাসীন দলের লোকজনও —বলছেন স্থানীয়রা

পদ্মায় একের পর এক নৌ-দুর্ঘটনা ঘটলেও তদন্ত কমিটিতেই আটকে আছে ফল। ঢাকার সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলে যাতায়াতের অন্যতম শিমুলিয়া-বাংলাবাজার নৌরুটে বড়-ছোট দুর্ঘটনা ঘটলেও সমাধানে আসতে পারছে না কর্তৃপক্ষ। এরই মধ্যে গতকাল সোমবারও কঠোর নজরদারি না থাকায় লকডাউন অমান্য করেই অতিরিক্ত যাত্রী বহন করা স্পিডবোট ও নোঙ্গর করা বালুবাহী বাল্কহেডের সংঘর্ষে ২৭ জন নিহতের ঘটনা ঘটেছে।

এ ঘটনাতেও গঠিত হয়েছে তদন্ত কমিটি। পুলিশের দাবি, ঘাট থেকে নয়, স্পিডবোট ছেড়ে গেছে পাশের কোনো একটি চর থেকে। প্রমত্তা পদ্মা নদী চলাচলের জন্য এমনিতেই বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। এরই মধ্যে নিরাপত্তা সরঞ্জাম ছাড়াই ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করে বিভিন্ন নৌযান। গতকালের দুর্ঘটনাকবলিত স্পিডবোটটিও ছিলো নিরাপত্তা সরঞ্জাম বিহীন। 

স্থানীয়রা বলছেন, পদ্মায় মাঝেমধ্যেই দুর্ঘটনা ঘটছে। কখনো ফেরি, কখনো লঞ্চ। তবে বেশি দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে স্পিডবোট। কিন্তু স্পিডবোট উল্টে আগে কখনো এত মানুষের মৃত্যু হয়নি। তারা বলছেন, বেপরোয়া গতি ও অতিরিক্ত যাত্রী বহনের কারণে স্পিডবোটে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে। পদ্মায় স্পিডবোটে যাত্রী বহনে কোনো বৈধতা না থাকলেও এত চোখ এড়িয়ে কীভাবে এটি চলে, সাংবাদিকদের সে উত্তর দিতে পারেনি বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) ও নৌপুলিশ। 

জানা গেছে, মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার বাংলাবাজার ফেরিঘাটে গতকাল সকালে বালুবাহী বাল্কহেডের সঙ্গে ৩১ যাত্রীবাহী স্পিডবোটের সংঘর্ষের ঘটনায় ঘটনাস্থল থেকে ২৬ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। দুর্ঘটনায় আহত পাঁচজনকে শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়, সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরেক জনের (নারী) মৃত্যু হয়। এছাড়া চিকিৎসাধীন চারজনের মধ্যে একজন ওই স্পিডবোটের চালক শাহ আলমও রয়েছেন। তাকে আটক করেছে পুলিশ। এদিকে নিহত ২৬ জনের মধ্যে গতকাল বেলা আড়াইটা পর্যন্ত আটজনের পরিচয় শনাক্ত করেছে পুলিশ। তারা হলেন— ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা উপজেলার মাইগ্রো এলাকার আরজু সরদার (৪০) ও তার দেড় বছর বয়সি ছেলে ইয়ামিন, মাদারীপুরের রাজৈর শঙ্কারদি এলাকার তাহের মীর (৩০), কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার মাইথারদিয়া এলাকার কাওসার হোসেন (৪০) ও রুহুল আমিন (৩৫), তিতাস উপজেলার ইসুবপুর এলাকার জিয়াউর রহমান (২৮), মুন্সিগঞ্জের সাতপাড় এলাকার সাগর শেখ (৩৭), পিরোজপুরের ভাণ্ডারিয়া উপজেলার পসারিয়াবুনিয়া এলাকার জনি অধিকারী (২৬)। তাদের লাশও স্বজনদের কাজে হস্তান্তর করা হয়েছে।  

এর আগে ২০১৪ সালের ৪ আগস্ট এই রুটেরই মাওয়া অংশে ডুবে যায় পিনাক-৬ নামের একটি লঞ্চ। ৪৯ যাত্রীর লাশ উদ্ধার হলেও নিখোঁজ হন ৫৩ যাত্রী। উদ্ধার হয়নি লঞ্চটিও। এরপর এ দুর্ঘটনায় হওয়া দুটি মামলায় আসামিরা জামিনে মুক্ত রয়েছেন। হাইকোর্টের আদেশে মেরিন কোর্টে হওয়া মামলাটির কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। তবে থানায় করা মামলাটি চলছে। ২০১৯ সালে এই মামলায় চার্জশিট হয়েছে। মুন্সীগঞ্জের ৬ নম্বর আমলি আদালতে মামলাটি বিচারের প্রক্রিয়ায় রয়েছে। চার্জশিটভুক্ত ছয় আসামি হলেন— লঞ্চমালিক আবু বক্কর সিদ্দিক কালু ও তার ছেলে ওমর ফারুক লিমন, গ্রিজার সাত্তার মোল্লা, লঞ্চমালিক সমিতির সুপারভাইজার (টাইমকিপার) কাসেম হালদার, মো. মিনিস্টার ও লঞ্চচালক গোলাম নবী। তবে এর মধ্যে গোলাম নবী পলাতক রয়েছেন। 

অভিযোগ রয়েছে, মামলার আরও দুই আসামি মাদারীপুরের শিবচরের কাওরাকান্দি ঘাটের ইজারাদার আব্দুল হাই শিকদার ও শিবচরের বাংলাবাজার ঘাটের ইজারাদার ইয়াকুব বেপারিকে চার্জশিট থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। অথচ এই দুই ইজারাদারই দুই ঘাট থেকে যাত্রী তুলে দিয়েছেন। পিনাক-৬ লঞ্চডুবির মতো বড় দুর্ঘটনার পাশাপাশি এই রুটে ছোট দুর্ঘটনাও কম নয়। মাওয়া-কাওরাকান্দি রুট এখন বাংলাবাজার-শিমুলিয়া রুট নামে পরিচিত। এর আগে এই রুটের নাম ছিল শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়িয়া। নদীভাঙনসহ নানা কারণে রুটের ঘাট পরিবর্তন হয়েছে একাধিকবার। উত্তাল এই নৌরুটে ২০১৩ সালে স্পিডবোট দুর্ঘটনায় একজন নিহত এবং ২০১৪ সালে পিনাক-৬ ডুবিতে নিহত হয় শতাধিক যাত্রী। একই রুটে দুর্ঘটনায় আট যাত্রী আহত হওয়ার খবর পাওয়া যায় ২০২০ সালেও। স্থানীয় লোকজন জানান, চলতি বছরের ২৫ জানুয়ারি, ১২ ও ১৯ ফেব্রুয়ারি এবং মার্চ মাসে তিনটি ছোট স্পিডবোট দুর্ঘটনাও ঘটে। তেমন হতাহতের ঘটনা না থাকায় বিষয়গুলো প্রকাশ্যে আসেনি।

সর্বশেষ দুর্ঘটনা ঘটলো গতকাল সোমবার, যে ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ২৭ জন। তবে অসচেতন হওয়া ও নিরাপত্তা সরঞ্জাম যাত্রীদের না দেয়ায় নৌযান ডুবলেই প্রাণহানির সংখ্যা বেড়ে যায় বহুগুণ। বাংলাবাজার ঘাটের সঙ্গে জড়িতরা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, পুলিশকে ম্যানেজ না করে লকডাউনের মধ্যে স্পিডবোট চালানো কঠিন। লঞ্চ বন্ধ থাকায় স্পিডবোট মালিক-চালকরা অতিরিক্ত যাত্রী বহন করেন। নেয়া হয় অতিরিক্ত ভাড়াও। এদের সিন্ডিকেটও বিশাল। এর সঙ্গে জড়িত ক্ষমতাসীন দলের লোকজনও। বিআইডব্লিউটিএর এক কর্মকর্তা বলছেন, ‘স্পিডবোটের কোনো নিবন্ধন নেই। তাই তারা ইচ্ছেমতো চলছে। তবে এই স্পিডবোটগুলো মানুষের সুবিধার্থে চলছে। এগুলো চলাচলে আমাদের কঠোর নির্দেশনা দেয়া আছে। কিন্তু নৌপুলিশ ও কোস্টগার্ড এগুলো নিয়ন্ত্রণ করবে। তারা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে আমাদের পক্ষে কী আর করা!’ তিনি আরও বলেন, দুর্ঘটনার শিকার স্পিডবোটটি ২০০ সিসির। এটি ৩২-৩৪ জন যাত্রী বহন করতে পারে। এই নৌপথে চলাচলরত এটাই সবচেয়ে বড় স্পিডবোট। এই স্পিডবোটের মালিকের নাম চান্দু মিয়া ও চালকের নাম শাহ আলম। মালিকের বাড়ি শিমুলিয়ার মাওয়া এলাকায়। তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য আমরা পুলিশের কাছে সুপারিশ করবো।  মাওয়া নৌ ফাঁড়ির পরিদর্শক সিরাজুল কবির বলেন, লকডাউনের কারণে লঞ্চ এবং স্পিডবোট চলাচল বন্ধ রয়েছে। শিমুলিয়া ঘাট থেকে কোনো নৌযান ছেড়ে যায়নি। পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে স্পিডবোডটি পাশের একটি চর থেকে অবৈধভাবে ছাড়া হয়। পুলিশ সব ধরনের চেষ্টা করে। তবে অনেক সময় অসাধু এই চক্রকে থামানো যায় না। 

নৌপুলিশ ফরিদপুর অঞ্চলের পুলিশ সুপার আব্দুল্লাহ আরিফ বলেন, আমার এই অঞ্চলে অবৈধ কোনো নৌ-যান চলে না। লকডাউনে স্পিডবোটও চলে না। তবে কীভাবে চলাচল করছে, সে বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

ঘাট কর্তৃপক্ষ, উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশ সূত্র জানায়, সকাল ৭টার দিকে মুন্সিগঞ্জের শিমুলিয়া ঘাট থেকে ৩১ জন যাত্রী নিয়ে স্পিডবোটটি মাদারীপুরের শিবচরের বাংলাবাজারের দিকে যাচ্ছিল। বাংলাবাজার ফেরিঘাটের কাছাকাছি এলে নোঙর করা বালুবোঝাই বাল্কহেডের সঙ্গে সেটির সংঘর্ষ হয়। এতে স্পিডবোটটি সজোরে ধাক্কা খেয়ে উল্টে যায়। খবর পেয়ে উদ্ধার অভিযান শুরু করে ফায়ার সার্ভিস ও নৌপুলিশ। ঘটনাস্থল থেকে ২৬ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। সাঁতরে তীরে উঠছেন পাঁচজন। তাদের উদ্ধার করে শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হলে সেখানে এক নারীর মৃত্যু হয়।

ঘটনায় মাদারীপুর স্থানীয় সরকার অধিদপ্তরের উপপরিচালক আজাহারুল ইসলামকে প্রধান করে ছয় সদস্যদের তদন্ত কমিটি করেছে জেলা প্রশাসক রহিমা খাতুন। এ ছাড়া নিহত প্রত্যেকের পরিবারকে ২০ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তার ঘোষণা দেয়া হয়। জেলা প্রশাসক রহিমা খাতুন বলেন, তদন্ত কমিটিকে আগামী তিন কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। লকডাউনে স্পিডবোট বন্ধ থাকার পরও কেন এমন দুর্ঘটনা এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, স্পিডবোটটি মুন্সিগঞ্জ থেকে ছেড়ে বাংলাবাজার আসে। তারা নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে স্পিডবোট ছাড়ে। এসব বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। এছাড়া লকডাউন অমান্য করে ঘাটের নজরদারি এড়াতে চেয়েছিলেন স্পিডবোট চালক। তাই কাঁঠালবাড়ি ঘাটে না নেমে কাছের অন্য কোনো স্থানে যাত্রী নামাতে চেয়েছিলেন তিনি। সে সময় নিয়ন্ত্রণ হারালে স্পিডবোটটি দাঁড়িয়ে থাকা বাল্কহেডে গিয়ে ধাক্কা দেয়। অতিরিক্ত যাত্রী থাকায় এটি উল্টে যায় পদ্মায়।

শিবচর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মিরাজ হোসেন বলেন, স্পিডবোটের চালক গুরুতর আহত। তাকে পুলিশের নজরদারিতে রেখে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। তার অবস্থা গুরুতর হওয়ায় তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ফরিদপুরের বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। তিনি আরও বলেন, স্পিডবোটের চালক মাথায় গুরুতর আঘাত পেয়েছেন। তার পুরো মাথায় ব্যান্ডেজ। তিনি কিছুই বলতে পারছেন না। মুমূর্ষু অবস্থায় আছেন।

আমারসংবাদ/জেআই