Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪,

সেবায় অনন্য জাতীয় হূদরোগ ইনস্টিটিউট

মোতাহার হোসেন

মে ৪, ২০২১, ০৭:৫০ পিএম


সেবায় অনন্য জাতীয় হূদরোগ ইনস্টিটিউট
  • ঢাকার শেরে বাংলানগরে ১৯৭৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় জাতীয় হূদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল। এ হাসপাতালে হার্টের প্রায় সব ধরনের সর্বাধুনিক চিকিৎসা দেয়া হয়। এ ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা ও বাংলাদেশে হার্টের চিকিৎসায় ডা. আব্দুল মালিক ছিলেন মহীরুহের মতো। এ ইনস্টিটিউট গড়ে ওঠার পেছনে তার অবদান অনেক। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সময়কে ‘এ জার্নি বাই হূদরোগ হাসপাতাল’ হিসেবে আখ্যায়িত করা যেতে পারে

বৈশ্বিক মহামারি করোনাকালে বিশ্বের উন্নত, উন্নয়নশীল, অনুন্নত প্রায় সকল দেশের স্বাস্থ্য, চিকিৎসার ভঙ্গুর ও দৈন্যদশা বিশ্ববাসীর সামনে ফুটে উঠেছে। অপর্যাপ্ত হাসপাতাল, অপর্যাপ্ত শয্যা, অপর্যাপ্ত আইসিইউ, অক্সিজেনের সংকট সর্বত্র কমবেশী লক্ষ্য করা গেছে। করোনায় আক্রান্ত এবং তাদের স্বজনরা এই দৈন্যতা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। বাংলাদেশেও এই সময়ের স্বাস্থ্যসেবা ও চিকিৎসা নিয়ে নানান মত রয়েছে। তবুও উন্নত বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশের চিকিৎসাব্যবস্থায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। এ ক্ষেত্রে রাজধানীর কয়েকটি বিশেষায়িত হাসপাতালের পরিবেশ, রোগীদের চিকিৎসা-সেবায় অনন্য উজ্বল দৃষ্টান্ত রয়েছে। এসব হাসপাতাল এবং হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্সসহ চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিতদের ওপর রোগীদের আস্থা ও ভরসা বেড়েছে। অবশ্য হাসপাতালের চিকিৎসা, পরিবেশসহ নানা রকম অব্যবস্থার খবর প্রায়শই পত্রিকার শিরোনাম হতে দেখা গেলেও তার সব টুকুই যে সত্য তা হলফ করে বলা যাবে না। কারণ কোনো একটি হাসপাতালে রোগীর স্বাস্থ্যসেবা বাস্তবে কতটুকু রোগীবান্ধব তা একমাত্র চিকিৎসা নিতে আসা রোগী এবং তাদের স্বজনারা অনুধাবন করতে পারেন। নিজে যখন হূদরোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিতে গিয়ে হাসপাতাল. চিকিৎসক, নার্স তথা ঐ হাসপাতালের পুরো স্বাস্থ্যসেবাকে ভিন্ন আঙ্গিকে, ভিন্ন মাত্রায় উপলব্ধি করার সুযোগ হয়েছে। গত ২১ জানুয়ারি রাজধানীর জাতীয় হূদরোগ ইনস্টিটিটিউট ও হাসপাতালে ভর্তি হয়ে একটানা ৭ ফ্রেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১৮ দিনের চিকিৎসায় এ সম্পর্কে বিগত দিনের নেতিবাচক ধারণার অনেকটাই উল্টো চিত্র ফুটে উঠেছে। কারণ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা যেকোনো রোগী রোগ নিরাময়ের প্রত্যাশা নিয়েই ভর্তি হয়। এ ক্ষেত্রে মুমূর্ষু রোগী হলেও আশা করে সুস্থ হয়ে ফিরবে বাড়ি। কিন্তু এ অবস্থায় কোনো মুমূর্ষু রোগীও যদি মৃত্যুবরণ করে তাহলে তার স্বজনদের কাছে সেটা প্রত্যাশিত থাকে না, তারা বিক্ষুব্ধ, মর্মাহত হন এবং তাদের এরকম প্রতিক্রিয়া হওয়া স্বাভাবিক।

ঢাকার শেরে বাংলানগরে ১৯৭৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় জাতীয় হূদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল। এ হাসপাতালে হার্টের প্রায় সব ধরনের সর্বাধুনিক চিকিৎসা দেয়া হয়। এ ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা ও বাংলাদেশে হার্টের চিকিৎসায় ডা. আব্দুল মালিক ছিলেন মহীরুহের মতো। এ ইনস্টিটিউট গড়ে ওঠার পেছনে তার অবদান অনেক। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সময়কে ‘এ জার্নি বাই হূদরোগ হাসপাতাল’ হিসেবে আখ্যায়িত করা যেতে পারে। দীর্ঘ এই জার্নিতে আমার চিকিৎসাসেবা চলে হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীর জামাল উদ্দীনের অধীনে। তিনি শুধু একজন বিশিষ্ট হূদরোগ বিশেষজ্ঞই নন, একই সাথে সুদক্ষ প্রশাসক, একজন মানবিক, উদার, রোগীবান্ধব, সেবায় অনন্য একজন ডাক্তারও। ক্যাথল্যাবে রোগীকে আন্তরিক ব্যবহার দিয়ে রোগীর মনে যাতে ভীতিকর, শঙ্কা না আসে সে জন্য গল্প করতে করতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে হার্টের রিং পরানোসহ সংশ্লিষ্ট কাজ সম্পন করার কৌশল সত্যিই ডাক্তার জামালের মানবিকতা, সেবার ও আন্তরিকতার বহিঃপ্রকাশ। তার সুদক্ষ নেতৃত্ব, সার্বক্ষণিক চিকিৎসাসেবা, প্রশাসনিকসহ যাবতীয় কার্যক্রম মনিটরিং, রোগীদের স্বাস্থ্যের হালনাগাদ খোঁজখবর চলে। এখানে স্থান সংকুলান না হলেও বারান্দায় বেড দিয়ে আগত রোগীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। বর্তমানে কেবিন, পেইং বেডসহ প্রতিদিন গড়ে এগারোশত থেকে বারোশত এবং বহির্বিভাগে প্রায় হাজার রোগীকে স্বাস্থ্যসেবা দেয়া হচ্ছে। আসছে জুন নাগাদ নব নির্মিত সম্প্রসারিত ভবনের কাজ সম্পন্ন হলে কেবিন, পেইং বেড, নন পেইং বেডসহ শয্যা সংখ্যা দাঁড়াবে ১২৫০-এ। বর্তমানে এখানে ৪৫০ ডাক্তার, প্রায় এক হাজার নার্স চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত রয়েছে।

হাসপাতালে খাবারের মান নিয়ে বিভিন্ন সময় পত্রিকায় নেতিবাচক সংবাদ চোখে পড়ে। কিন্তু এ হাসপাতালে খাবারের তালিকায় সকালে পাওয়া রুটি, জেলি, কলা, ডিম; দুপরে ভাতের সাথে ডাল, সব্জি, মাছ অথবা মুরগির মাংস, রাতে ডায়বেটিস রোগীর জন্য রুটি, ডাল, সব্জি ও মুরগির মাংস অথবা মাছ সঙ্গে ল্যাক্সাস বিস্কুট এক প্যাকেট। সাধারণ রোগীর জন্য রুটি ছাড়া ভাতের সঙ্গে উপরোক্ত ম্যানু সমানভাবে পরিবেশন করা হয়। সাধারণত বাসা বাড়িতে যেরকম তেল-মসল্লা দিয়ে মাছ-মাংস রান্না হয় হাসপাতালে রোগীর জন্য সে রকম হয় না। কাজেই হাসপাতালের খাবারের স্বাদে কিছুটা কমতি হবে— এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাই বলে এ খাবারকে নিম্ন মানের বলা যাবে না।

২০১৯ সালের ২৫ জুলাই তিনি পরিচালক পদে দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে এ হাসপাতালকে রোগীদের আস্থা, বিশ্বাস ও অন্যতম ভরসার স্থলে পরিণত করতে নিত্য নতুন পরিকল্পনা, আধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জাম সংগ্রহ এবং অধিক রোগীর সেবা দিতে পরিচালনা করছেন নতুন ভবন নির্মাণ কাজ। এ হাসপাতালে হূদরোগের চিকিৎসা সেবায় নিবেদিত রয়েছেন একঝাঁক মেধাবী, দক্ষ, মানবিক, চিকিৎসক, নার্স, পরীক্ষা-নিরীক্ষায় নিয়োজিত টেকনেশিয়ান, প্যাথলজিস্ট। রাত-দিন পালাক্রমে তারা নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করে আসছেন। এ পর্যায়ে পরিচালক ডা. মীর জামাল উদ্দীনের প্রতি আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা। তার সহজ সরল, আন্তরিক, মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি সেবাসুলভ মানসিকতা, শত কাজের ব্যস্ততার মধ্যেও রোগীর সেবা পরম ধর্ম, পবিত্রতম দায়িত্ব হিসেবে প্রতিটি কাজ অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সূচারুরূপে সম্পন্ন করার গৌরবও তার। ঠিক একই মানসিকতা, মানবিকতা ও সেবার ব্রত পালনে তিনি উজ্জীবিত করেছেন তার টিমের অন্য চিকিৎসক, নার্সসহ সকল পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে।

হাসপাতালের ৭ নং ওয়ার্ডের ৩১ নম্বর বেড়ে ১৮ দিবস রজনী চিকিৎসা গ্রহণকালে মনে হয়েছে পারিবারিক পরিবেশে বন্ধু স্বজনবেষ্টিত হয়েছিলাম। রোগীর অ্যাটেনডেন্টস হিসেবে রোগীর সাথে তাদের নিকটজন থেকেছেন অথবা প্রায়শই দেখা করতে এসেছেন। আমার স্ত্রী, ছেলে-মেয়েসহ বন্ধু, সতীর্থ, আত্মীয় স্বজনের অনেকেই এসেছেন, কেউ কেউ থেকেছেন। এসময় এক রোগীর সাথে অন্য রোগী ও তাদের স্বজনদের মধ্যে আলাপচারিতা, নিজেদের সুখ-দু:খ শেয়ার করা, রোগীর জন্য বাসা থেকে আনা ভালো খাবার, ফল-ফলারি অন্য রোগীদের মধ্যে ভাগাভাগি করে দেয়ার এক মহতী উদ্যোগে নিজেকে ধন্য মনে হয়েছে। হাসপাতালের বাইরে কোনো রোগী বা তার স্বজন কিছু কিনতে গেলে বেডের অন্য রোগীদের কিছু আনতে হবে কি না— জিজ্ঞেস করে তার ব্যবস্থা করা সত্যি পারিবারিক পরিবেশের কথা মনে করিয়ে দেয়। এ পর্যায়ে ৩৪ নম্বর বেডের শ্রী স্বপন চন্দ্র দেবনাথ, ৩৬ নম্বরের মো: রিপন, ৩২ নম্বরের চিরকুমার মামুন কবীর হীরা, ৩৩ নম্বরের গিয়াস উদ্দিন (তিনি নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা বন্ধুবর জাহাঙ্গীর আলমের ভগ্নিপতি।

হাসপাতাল থেকে রিলিজের কয়েকদিন পর নিজ বাসায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন)। এদের মধ্যে হাসপাতাল থেকে বিদায় বেলায় একে অন্যকে বুকে জড়িয়ে ধরে বিদায়ের আবেগঘন দৃশ্য আপনজনকে বিদায় জানানোর কথা মনে করিয়ে দেয়। মনে হয় যেন এরা একে অন্যের কত আপনজন, কতটা কাছের মানুষ। হাসপাতালে একইসঙ্গে সজ্জন পরিবেষ্টিত পরিবেশ সৃষ্টির অনন্য নজির এটি। এরকম সজ্জন, অত্যন্ত আপনজনের ভূমিকায় এখানে ভর্তি, চিকিৎসা, বেড পাওয়া, ক্যাথল্যাবে নেয়া, সেখানে এনজিওগ্রাম ও হার্টের রিং পরানো শেষে সিসিইউতে স্থানান্তর, পরবর্তীতে এখান থেকে রিলিজ হওয়া পর্যন্ত কর্মরত সিনিয়র টেকনোলজিস্ট সর্বদা পরোপকারী সেলিম মোল্লার নিরন্তর শ্রম ও আন্তরিক উদ্যোগ আমাকে বিমোহিত করেছে। আমাদের প্রত্যাশা থাকবে বর্তমান পরিচালকের নেতৃত্বে স্বাস্থ্যসম্মত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশ নিশ্চিত করতে আরো বেশি দৃষ্টি দেবেন। তাহলেই জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেয়া অঙ্গীকার বাস্তবায়ন হবে একইসঙ্গে দেশের হূদরোগীদের আস্থা এবং ভরসার জায়গায় পরিণত হবে এই হাসপাতাল।

আমারসংবাদ/জেআই