Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪,

যানজটে নাকাল রাজধানী

আসাদুজ্জামান আজম

মে ৬, ২০২১, ০৭:৩০ পিএম


যানজটে নাকাল রাজধানী
  • ঈদ আসন্ন, সপ্তাহের শেষ দিন এবং ২২ দিন পর বাস চলাচল করায় সড়কে ছিলো বাড়তি চাপ। দিনভর রাজধানীর প্রতিটি সড়কেই যানজট ছিলো লক্ষ্যণীয়

চলমান লকডাউনের মধ্য গতকাল গণপরিবহন চালু হয়েছে। সড়কে গণপরিবহন বা যাত্রাবাহী বাস নামার সঙ্গে সঙ্গে যানজটের চিরচেনা রূপে ফিরেছে রাজধানী ঢাকা। ঈদ আসন্ন, সপ্তাহের শেষ দিন এবং ২২ দিন পর বাস চলাচল করায় সড়কে ছিলো বাড়তি চাপ। দিনভর রাজধানীর প্রতিটি সড়কেই যানজট ছিলো লক্ষ্যণীয়। গন্তব্যে যেতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটের কারণে বিলম্ব হয় যাত্রীদের। মাহে রমজান, গ্রীষ্মের তাপদহ এবং যানজট মিলিয়ে বাইরে বের হওয়া নাগরিকের অসহ্য কস্টের মধ্যে পড়তে হয়।

কোভিড-১৯ সংক্রমণের দ্বিতীয় ধাপে ৫ এপ্রিল থেকে আগামী ১৬ মে পর্যন্ত পাঁচ দফায় লকডাউন বর্ধিত করা হয়েছে। লকডাউনে স্বাস্থ্যবিধি মেনে দোকান ও শপিংমল সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত খোলা রাখা হচ্ছে। ২২ দিন বন্ধ থাকার পর মালিক শ্রমিকদের দাবির মুখে গতকাল শুরু হয়েছে বাস চলাচল। ১৬ মে মধ্যরাত পর্যন্ত বিধিনিষেধের মেয়াদ বাড়িয়ে বুধবার জারি করা প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, শুধু জেলার গাড়ি জেলার মধ্যেই চলাচল করতে পারবে। আন্তঃজেলা বাসের পাশাপাশি বন্ধ রয়েছে যাত্রীবাহী ট্রেন ও নৌযানও।

পরে পাঁচটি নির্দেশনা দিয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার থেকে মহানগর ও জেলায় গণপরিবহন চলাচলের অনুমোদন দিয়ে প্রজ্ঞাপন দেয় বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ-বিআরটিএ। নির্দেশনায় বলা হয়, আন্তঃজেলা গণপরিবহন বন্ধ থাকবে। কোনোভাবেই মোট আসনের অর্ধেকের বেশি যাত্রী নেয়া যাবে না। সমন্বয় করে ৬০ শতাংশ বাড়ানো ভাড়ার বেশি আদায় করা যাবে না। যাত্রার শুরু ও শেষে জীবাণুনাশক দিয়ে গাড়ি জীবাণুমুক্ত করতে হবে। চালক, অন্যান্য শ্রমিক, কর্মচারী ও যাত্রীদের মাস্ক পরা এবং হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার নিশ্চিত করার নির্দেশও দেয়া হয় প্রজ্ঞাপনে। দফায় দফায় লকডাউন বাড়লেও মানুষের মধ্যে বাড়েনি সচেতনতা। গতকাল  গণপরিবহন চালু হওয়ার পর লকডাউন ভেঙে পড়ে। গণপরিবহন সবই চলছিল এতদিন।

স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার শর্তে গণপরিবহন চালুর প্রথম দিনে রাজধানীর সড়কে বাসের সংখ্যা খুব বেশি না থাকলেও ব্যক্তিগত পরিবহনসহ অন্যান্য যানবাহনের সঙ্গে বাস যোগ হওয়ায় দেখা মিলেছে নিত্যকার যানজটের। গণপরিবহন চালু করায় চালক, যাত্রী, মালিক সবাই সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে দেখা গেছে তীব  যানজট। দুপুরে রাজধানীর বনানী, মহাখালী, তেজগাঁও, ফার্মগেট, মগবাজার, কাকরাইল, গুলিস্তান এলাকা ঘুরে এই চিত্র দেখা গেছে। গত প্রায় এক মাস রাজধানীতে যানজটের মাত্রা এতটা তীব্র ছিলো না। এদিন কারওয়ান বাজার থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত রাস্তার উভয় পাশেই যানজটে গাড়ি আটকে থাকতে দেখা গেছে। মহাখালীর আমতলী থেকে তেজগাঁও সাতরাস্তা মোড়ের দূরত্ব মাত্র দেড় কিলোমিটার। যানজটের কারণে বাসে যেতে সময় লেগেছে প্রায় ৩০ মিনিট। একইভাবে সাতরাস্তা থেকে বনানী পর্যন্ত সড়কেও বেশ যানজট দেখা গেছে। তবে সরেজমিন রাজধানী ঘুরে দেখা যায়, সরকারের দেয়া শর্ত বেশির ভাগ পরিবহনই তা মেনে চলেনি। অর্ধেক আসন খালি রাখার যে বাধ্যবাধকতা দেয়া হয়েছিল, সেটিও ছিলো অনুপস্থিত। বাসের চালক, কন্ডাক্টর, হেলপার তো বটেই যাত্রীদের অনেককেই মাস্ক পরতে দেখা যায়নি।  আর হ্যান্ড স্যানিটাইজারও ব্যবহার করতে দেখা যায়নি কোনো পরিবহনেই।

পল্টন মোড়ে দাঁড়িয়ে দেখা যায়, বিহঙ্গ পরিবহনে নির্দিষ্ট আসন সংখ্যার চেয়েও অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন করতে দেখা গেছে। একই চিত্র ছিলো ট্রান্স লিভা, ভিক্টর ক্ল্যাসিক, আকাশ, মনজিল পরিবহনেও। সেই সঙ্গে সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে বেশি আদায় করারও অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে বৃহস্পতিবার দিনভর যাত্রীদের সঙ্গে বাসের কন্ডাক্টরদের বচসার ঘটনা ঘটেছে। ভিক্টর পরিবহনের কন্ডাক্টর আলিফ বলেন, ‘আমরা নিয়ম মেনেই গাড়ি চালানোর চেষ্টা করছি। তবে যাত্রীরা জোর করে উঠে যাচ্ছেন। তখন তাদেরকে নামানো যাচ্ছে না।’ আকাশ পরিবহনের যাত্রী শামীম বলেন, বিজয়নগর থেকে বিশ্ব রোড পর্যন্ত ভাড়া ২০ টাকা। নতুন ভাড়ায় সেটি পড়ে ৩০ টাকা। কিন্তু এখন ভাড়া নেয়া হচ্ছে ৩৫ টাকা। দিশারী পরিবহনের যাত্রী রফিক বলেন, ‘মিরপুর থেকে গুলিস্তানের ভাড়া ছিলো ২৫ টাকা। এখন ৪০-৫০ টাকা নিচ্ছে। অর্থাৎ অন্য সময়ের চেয়ে দ্বিগুণ ভাড়া রাখছে। হাতে গোনা কয়েকটি বাসের হেলপারের হাতে হ্যান্ড স্যানিটাইজারের দেখা গেছে। মাস্ক থাকলেও সেগুলো থুতনিতে রেখেই যাত্রীদের ডাকতে দেখা গেছে। গণপরিবহনে বিধিনিষেধ অমান্য করার বিষয়ে বাংলাদেশ বাস মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বলেন, আমরা আমাদের মতো করে পরিবহন মালিকদের নির্দেশনা দিয়েছি। তবে এটা সঠিকভাবে পালন করা হচ্ছে কি-না সেটি দেখার দায়িত্ব কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ও সরকারের দায়িত্বশীল সংস্থার।

শাহবাগ থেকে ফার্মগেট, কাকরাইল থেকে মালিবাগ, রামপুরা থেকে উত্তর বাড্ডা, মহাখালী থেকে বনানী এলাকায় ছিলো তীব্র যানজট। এর পাশাপাশি বিপণিবিতানগুলোর সামনের সড়কে যানজটের মাত্রা ছিলো আরো বেশি। লক্ষ্মীবাজারের বাসিন্দা ওয়ালিদ খান বলেন, ‘ভিক্টোরিয়া পার্ক থেকে বিশ্বরোড পর্যন্ত স্বাভাবিক নিয়মে দুই ঘণ্টার কম সময় লাগতো। লকডাউনের সময়ে সিএনজি বা রিকশাতেও পৌনে এক ঘণ্টার মধ্যে চলে এসেছি। কিন্তু আজকে পৌনে তিন ঘণ্টা লেগেছে।’ কাকরাইল মোড়ে কথা হয় সদরঘাটগামী স্কাইলাইন পরিবহনের চালক মাসুদের সঙ্গে। তিনি জানান, স্বাস্থ্যবিধি মেনে বাসের অর্ধেক আসন ফাঁকা রেখেই তারা যাত্রী পরিবহন করছেন। তবে সড়কে আগের মতোই যানজট। সকাল ১০টার দিকে সাতরাস্তা মোড়ে পল্টনগামী বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী সিরাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘অফিসের কাজে প্রায়ই তেজগাঁও যাতায়াত করতে হয়। এতদিন বাস না চলায় ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। এখন বাস চালু হওয়ায় যাতায়াতে সুবিধা হয়েছে।’ শিয়া মসজিদ-বনশ্রী রুটের আলিফ পরিবহন বাসের চালক আবদুল্লাহ বলেন, ‘যাত্রী অহনও কম। আমাগো মাস্ক ছাড়া মানুষ উডাইতে মানা করছে। আমরা উডাইতেছি না। সেনিটাইজারও রাখছি।’

দীপন পরিবহনের চালক মোশারফ বলেন, ‘লকডাউনের কারণে আমাদের পরিবার নিয়ে চলতে অনেক সমস্যা হচ্ছিল। এখন আমরা বাস চালানোর সুযোগ পেয়েছি। স্বাস্থ্যবিধি মেনে আমরা যাত্রী পরিবহন করছি এবং করবো।’ মোহাম্মদপুরে আলিফ পরিবহনের যাত্রী আনিকা মিসকাত বলেন, ‘ভাড়া বেশি নিলেও বাস চলাচল শুরু হওয়ায় আমাদের জন্য ভালোই হয়েছে। কিন্তু সামাজিক দূরত্ব বিধি কতক্ষণ এরা মানবে সেটা নিয়ে আমার সন্দেহ রয়েছে।’

যাত্রী কম থাকায় আসন সংখ্যার অর্ধেক যাত্রী দেখা যাচ্ছে বলে মনে করেন মতিঝিলগামী কাজল মিয়া। তিনি বলেন, ‘এখন মানুষ কম সে জন্যই হয়তো বাসে ফাঁকা ফাঁকা বসানো হচ্ছে। যাত্রী বাড়লে বাসের লোক নিয়ম মানবে বলে মনে হয় না।’ মিরপুর দুয়ারিপাড়া বাসস্ট্যান্ড থেকে নিউ মার্কেট, আজিমপুর ও গুলিস্তানের উদ্দেশে আশীর্বাদ ও বিহঙ্গ বাস সার্ভিস ছেড়ে যেতে দেখা যায়। সকালে যাত্রী সংখ্যা কম থাকলে বেলা বাড়ার সঙ্গে সেটাও বেড়েছে। বাসে দুই সিটে একজন যাত্রী নিতে দেখা গেছে। কয়েকটি বাসের হেলপারের হাতে স্যানিটাইজার দেখা গেলেও বেশির ভাগের মাস্ক দেখা যায়নি। বেশির ভাগ তবে চালকদের মুখে মাস্ক দেখা গেছে। গণপরিবহন চালু হওয়ায় অন্যদিনের চেয়ে বাস, প্রাইভেটকার, ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান ও রিকশার সংখ্যা বেড়ে সকাল ৯টার দিকে রাজধানীর কাকরাইল, মালিবাগ, মৌচাক, রামপুরা, গুলশান সড়কে যানজট সৃষ্টি হয়। করোনা ভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ ঠেকাতে গত ৫ এপ্রিল থেকে ‘লকডাউন’ ঘোষণা করে বিধিনিষেধ জারি করা হয়। ১৪ এপ্রিল থেকে শুরু হয় ‘সর্বাত্মক লকডাউন’। বন্ধ করা হয় সড়ক, নৌ ও রেলপথে যাত্রী পরিবহন।

আমারসংবাদ/জেআই