মে ৭, ২০২১, ০৯:১০ পিএম
অবস্থার পরিবর্তন নেই খালেদা জিয়ার। এখনো শ্বাসকষ্ট ও বুকে ব্যথা অবনতির পর্যায়ে। আগে দুই লিটার অক্সিজেন লাগত, এখন তা চার-পাঁচ লিটারে পৌঁছে গেছে। ফুসফুসে ইনফেকশনের ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে, ডায়াবেটিস বেড়ে গেছে। এ পরিস্থিতে দাবি উঠেছে মানবিক রাজনীতির। খালেদা জিয়াকে বিদেশে নেয়ার। সবুজ সংকেত পাওয়ার পরই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে লিখিত আবেদন করা হয়েছে। সরকারও ইতিবাচকও। এখন শুধু আনুষ্ঠানিকতা বাকি। বিদেশে নিতে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে রেখেছে পরিবার। বিমান ভাড়াসহ আনুষঙ্গিক সব সম্পন্ন। কিন্তু বিএনপির বড় অংশ আজো কী চায় খালেদা জিয়া দেশের বাইরে যাক তা নিয়ে দলে সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে। দলের সিনিয়র নেতাদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। শুরু থেকেই তারা খালেদা জিয়ার বিষয়ে তথ্য গোপন করছেন।
১১ এপ্রিল যেদিন খালেদা জিয়ার করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট ভাইরাল হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। তখন বিএনপির দায়িত্বশীল শীর্ষ নেতারা গুজব বলে উড়িয়ে দেন। আবার কেউ কেউ বলেন, করোনা পরীক্ষাই করা হয়নি নেত্রীর। তবে সর্বশেষ পর্যায়ে মুখ খুলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, ‘খালেদা জিয়া ভালো আছেন, সুস্থ আছেন, তার কোনো সমস্যা নেই। করোনার প্রভাব খালেদা জিয়ার মধ্যে নেই।’ তার ব্যক্তিগত চিকিৎসকরা জানান, হাসপাতালে নেয়ার প্রয়োজন নেই। তিনি বাসাতে থাকবেন। সেখানে মিনি হসপিটালে তার চিকিৎসা হবে। ২৭ এপ্রিল হঠাৎ করেই খালেদা জিয়াকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তখনো তারা তথ্য গোপন করে জানান, শুধু খালেদা জিয়ার কিছু শারীরিক পরীক্ষা করাতে হবে। আসা-যাওয়ার সমস্যার জন্যই দুদিন তিনি হাসপাতালে থাকবেন। এরপরই তিনি বাসায় চলে যাবেন। ঠিক তখনো ভয়ঙ্কর তথ্য আড়াল করে দলটির হাইকমান্ড। চলতি মাসে সিসিইউতে স্থানান্তরের পরও ধোঁয়াশা সৃষ্টি করে বিএনপির বড় অংশ ও তার চিকিৎসকরা। তারা জানান, খালেদা জিয়ার ফুসফুস খুব সুন্দর ও ক্লিয়ার আছে। তবে তখন খালেদা জিয়ার বোন সেলিমা ইসলাম জানান, লান্স থেকে পানি বের করেছে এখনো পানি আরো রয়ে গেছে, ডাক্তার নজর রাখছেন। সবশেষ বিদেশে চিকিৎসা চেয়ে আবেদন করার পরও মুখে কুলুপ দেয় দলটির হাইকমান্ড। এ বিষয়ে তখনো কোনো তথ্য নেই বলে জানান হাইকমান্ড। খালেদা জিয়ার মুক্তির আবেদন বাড়ানো হয় পরিবারের আবেদনে। সর্বশেষ বিদেশ নেয়ার আবেদনও করেন পরিবার। সর্বশেষ গতকাল শুক্রবার রাত ৮টায় খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন জানান, শুক্রবার জুমার নামাজের পর খালেদা জিয়ার পরীক্ষাগুলো ডাক্তাররা দেখেছেন, এতে বোঝা যাচ্ছে— খালেদা জিয়ার অবস্থা স্থিতিশীল রয়েছে। আমরা দেশবাসীর কাছে তার রোগমুক্তি কামনা করছি।’ খালেদা জিয়া এই মুহূর্তে দেশের বাইরে যেতে পারবেন কি-না, তার শারীরিক সক্ষমতা রয়েছে কি-না এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডাক্তার জাহিদ হোসেন এড়িয়ে যান। তিনি বলেন, বিষয়টি সরকারের সঙ্গে জড়িত। সরকার যখন অনুমতি দেবে দেশের বাইরে যাওয়ার তখন সেটা চিন্তাভাবনা করা হবে। তিনি এখনো স্বনামধন্য একটি হসপিটালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। ডাক্তারদের সমন্বয়ে চিকিৎসা গ্রহণ করছেন। খালেদা জিয়া অবস্থা গতকাল যেরূপ ছিলো আজও সে অবস্থায় রয়েছে, কোনো অবস্থার পরিবর্তন হয়নি।’
এ নিয়ে দলের নেতাকর্মীরা বলছেন, খালেদা জিয়ার জন্য হাইকমান্ড কী করছে তথ্য গোপনের পেছনে রহস্য কী? তারা মনে করছেন— বিএনপির ব্যর্থতা ঢাকতেই এমন লুকোচুরি করছেন। কারণ তারা খালেদা জিয়াকে আটক থেকে এই পর্যন্ত কিছুই করতে পারেনি। খালেদা জিয়াকে মুক্তির জন্য কোনো ভূমিকা পালন করতে পারেনি। মুক্তি নিশ্চিতে কোনো ভূমিকা পালন করতে পারেনি। খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখেই নির্বাচনে যায় দলটি। খালেদা জিয়াকে জেলে রেখেই দলটি সরকারের সঙ্গে বৈঠকে বসে। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে ক্ষমতাসীন সরকারকে বৈধতার পেছনেও নাটের গুরু ছিলো বিএনপির হাইকমান্ডের বড় অংশ। পাঁচ-ছয়জন সংসদ সদস্যকেও সংসদে পাঠানো হয়। নতুন স্থায়ী কমিটির সদস্য অনুমোদনসহ আরো বেশ কিছু ইস্যুই বাস্তবায়ন করছেন খালেদাকে আঁড়াল করে। সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো আদৌ খালেদা জিয়ার অনুমতিক্রমে হয়েছে কি-না দলটির নেতাকর্মীদের মধ্যে সন্দেহ রয়েছে। বর্তমান সময়ে খালেদা জিয়ার বিদেশ যাত্রা ও চিকিৎসার তথ্য গোপন নিয়ে বড় নাটকীয়তা চলছে। দলটির নির্ভরযোগ্য একটি সূত্রের ভাষ্য— সরকার খালেদা জিয়াকে দেশের বাইরে পাঠাতে ইতিবাচক। পরিবারও তাকে দেশের বাইরে নিয়ে যেতে চায়। কিন্তু দলটি এখনো রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ করছে। খালেদা জিয়ার এ পরিস্থিতে সুস্থতা এবং দুর্ঘটনার সঙ্গে রাজনৈতিক হিসাব জড়িয়ে গেছে। তাই দলটির একটি অংশ চাচ্ছে দেশের বাইরে না নিতে। বন্দি অবস্থায়ই খালেদাকে নিয়ে রাজনীতে করতে। যা হবে দেশেই হবে। খালেদার দুর্ঘটনার কাদা সরকারের গায়ে লাগাতেই তৎপর বিএনপি।
গত বুধবার রাত সাড়ে ৮টায় খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিতে আবেদন নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ধানমন্ডির বাসায় যান শামীম এস্কান্দার। এরপর থেকেই শুরু হয় নানামুখী তৎপরতা। আবেদন করার ২০ ঘণ্টা পর বৃহস্পতিবার ৪টায় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক খোলাসা করেন যে, এদিন আর কোনো অগ্রগতি হবে না। তিনি জানান, আইন মন্ত্রণালয় দ্রুতই মতামত দেবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানিয়েছেন, ‘খালেদা জিয়ার বিদেশ যাত্রার আবেদনের বিষয়ে সরকার ইতিবাচক।’ জানা যায়, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে দেয়া লিখিত আবেদনে উন্নত চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়াকে বিদেশে নেয়া প্রয়োজন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে জানানো হয়েছে চিঠিতে। কোন্? দেশে খালেদা জিয়াকে তার পরিবার নিতে চায়, সে সম্পর্কে চিঠিতে কিছু লেখা নেই বলে জানা গেছে। তবে সরকার সম্পূর্ণ ইতিবাচক। সরকারের নীতি নির্ধারণী একটি সূত্রের দাবি, সরকারও কোনোভাবে চায় না খালেদা জিয়ার দুর্ঘটনার দায় বহন করতে। কারণ খালেদা জিয়া সাবেক তিনবারের প্রধানমন্ত্রী। রাজনীতিতে ভবিষ্যতে এটির বড় প্রভাব পড়বে। তাই সরকারও চায় খালেদা জিয়া দেশের বাইরে চলে যাক।
বিশ্বস্ত সূত্র থেকে আসা খালেদা জিয়ার কিছু মেডিকেল রিপোর্টের তথ্যে দেখা যায়, High Sensitive Troponin-1 রিপোর্ট ভালো আসেনি। এ ক্ষেত্রে একজন নারীর স্বাভাবিক রেফারেন্স মাত্রা ধরা হয় ১৫.৬-এর কম। বেগম খালেদা জিয়ার সেই মাত্রা ২১.২। এই রিপোর্টের মাধ্যমে তার হার্টের অবস্থা নির্ণয় করা হয়। রক্ত জমাট বাঁধছে কি-না জানতে D-Dimer পরীক্ষা করা হয়। এর স্বাভাবিক রেফারেন্স মাত্রা ৫০০-এর নিচে। বেগম জিয়ার তা ২১৩৪.৩। স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হলে তা রক্ত জমাট বাঁধার ইঙ্গিত দেয়। তার হিমোগ্লোবিন মাত্র ৭.৭। স্বাভাবিক অবস্থায় তা ১১.৫-১৬.৫-এর মধ্যে থাকার কথা। NT-pro BNP পরীক্ষাও স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি। স্বাভাবিকভাবে ১২৫-এর কম থাকতে হয়। বেগম খালেদা জিয়ার রক্ত পরীক্ষায় তা ২২৩৮ এসেছে। এই পরীক্ষার রিপোর্ট তার হার্ট ও ফুসফুসের অস্বাভাবিক অবস্থা বোঝাচ্ছে। এ ছাড়া CA ১২৫ পরীক্ষার উচ্চমাত্রা একটি জটিল রোগের ঝুঁকি নির্ণয় করে। ওই পরীক্ষার স্বাভাবিক মাত্রা ১২৫-এর নিচে হলেও বেগম জিয়ার তা ৯৬২। এ দ্বারা শুধু ওই জটিল রোগের ঝুঁকির মাত্রা বোঝায়। করোনা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণে এ সমস্যাগুলো যেকোনো সময় তীব্র থেকে তীব্রতর হতে পারে। তাছাড়া তার ডায়াবেটিক বেশ উঠানামা করছে। এ পরিস্থিতি ৮-১০ ঘণ্টা জার্নিতে খালেদা জিয়াকে দেশের বাইরে নেয়া সম্ভব হবে কি-না তাও শঙ্কা দেখছেন ডাক্তাররা।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাসিম বলেছেন, ‘খালেদা জিয়ার চিকিৎসার নামে বিএনপি, তার চিকিৎসক এবং খালেদা জিয়ার পরিবার যে ধুম্রজাল সৃষ্টি করেছে তার অবসান দরকার। এ জন্য তাদের দলের পক্ষ থেকে খালেদা জিয়ার প্রকৃত শারীরিক অবস্থা মানুষের কাছে তুলে ধরা দরকার।’ বাহাউদ্দিন নাসিম বলেন, ‘আমরা খালেদা জিয়ার চিকিৎসা নিয়ে কোনো রাজনীতি চাই না। তার শারীরিক অবস্থা অনুযায়ী যেখানে নেয়ার প্রয়োজন হবে তাকে সেখানেই চিকিৎসা করাতে পারবেন অফিসিয়াল ফর্মালিটি মেইনটেইন করে। তবে বিএনপি খালেদা জিয়ার চিকিৎসা, অসুস্থতা, করোনা এবং বর্তমান অবস্থা নিয়ে নানামুখী লুকোচুরি করে যাচ্ছে। বেগম জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসরকা বলছেন, তিনি ভালো আছেন, সুস্থ আছেন। আবার বেগম জিয়ার পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে— তিনি অনেক অসুস্থ এবং তারা নানা ধরনের শারীরিক জটিলতা রয়েছে। তাহলে মানুষ কোনটা বিশ্বাস করবে। এই মুহূর্তে দেশের সাধারণ মানুষ খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা নিয়ে এক ধরনের ধোঁয়াশার মধ্যে রয়েছে; কাজেই খালদা জিয়ার আসলে শারীরিক অবস্থা কী সেটা সাধারণের কাছে প্রকৃত চিত্র তুলে ধরা বিএনপির দায়িত্ব।
খালেদা জিয়ার সাবেক প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান সোহেল বলেন, ‘ম্যাডাম জিয়া বিতর্কিত মামলার রায়ে বন্দি। তাকে জামিন দেয়ার সাধ্য আদালত প্রদর্শন করতে পারেনি। নির্বাহী বা প্রশাসনিক আদেশে তাকে কারাগারের বাইরে নিজ বাসস্থানে শর্তাধীন বাসের ব্যবস্থা করেছে সরকার। এটা এক ধরনের প্রশাসনিক জামিন বা প্যারোল। অর্থাৎ তিনি পুরোই সরকারের জিম্মায় রয়েছেন। জেলে থাকতেও তার উপযুক্ত চিকিৎসা বা স্বাস্থ্যপরীক্ষা হয়নি। পরীক্ষা হলেও তার ফল গোপন রাখা হয়েছে। বাসভবনে ফেরার পরও করোনা পরিস্থিতির কারণে উনার স্বাস্থ্যপরীক্ষা ও চিকিৎসা শুরু হতে পারেনি। এর মধ্যে তিনি কোভিড আক্রান্ত হন। এখন চিকিৎসার জন্য বিদেশযাত্রা নিয়েও কেমন যেনো একটা ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছে। এগুলো ভালো নয়। বিষয়টি খুব স্পর্শকাতর।’
গণস্বাস্থ্যকেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেছেন, ‘খালেদা জিয়ার চিকিৎসা হচ্ছে না। তার শারীরিক অবস্থা খুবই খারাপ। ওনার চিকিৎসা হলো মুক্তি। মুক্তি দিলে উনি কোথায় চিকিৎসা করবেন সেটা ওনার স্বাধীনতা।’ খালেদা জিয়ার চিকিৎসার বিষয়ে সময়োপযোগী চিকিৎসা নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের অতীতের প্রতিহিংসা, ভুল স্মরণ না রেখে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে হবে। মানসিক শক্তি না থাকলে সুস্থ হওয়া যায় না।’ বেগম খালেদা জিয়ার আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ‘সময়ক্ষেপণ করে তার জীবনের ঝুঁকি না বাড়িয়ে সরকারের অবিলম্বে তাকে মুক্তি দেয়া উচিত। তার সুচিকিৎসা করতে দেয়া উচিত। এখন পর্যন্ত খালেদা জিয়া দেশের বাইরে যেতে কোনো বাধা নেই।’
আমারসংবাদ/জেআই