Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪,

অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষায় জাকাত

সাইফুল ইসলাম তাওহিদ

মে ৭, ২০২১, ১০:০০ পিএম


অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষায় জাকাত
  • মহানবী সা. জাকাতকে ইসলামের সেতুবন্ধ বলে আখ্যায়িত করেছেন

জাকাত ইসলামের অন্যতম আর্থিক ফরজ ইবাদত। ইসলামী রাষ্ট্রের অন্যতম অর্থনৈতিক উৎস। জাকাত দরিদ্র, অভাবী ও অক্ষম জনগোষ্ঠীর জন্য যেমন সামাজিক নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেয়, অনুরূপ জাকাত সমাজের অর্থনৈতিক উন্নয়নের হাতিয়ার। জাকাত প্রদানে সম্পদ পবিত্র হয় এবং তাতে প্রাচুর্য আসে। আল্লাহর পক্ষ থেকে সম্পদের মাঝে বরকতের বারি বর্ষণ হয়। অধিকন্তু জাকাত প্রদানকারীর পরকালীন মুক্তির পথও সুগম হয়। ইসলামী অর্থব্যবস্থায় জাকাতের গুরুত্ব নিম্নে বর্ণনা করা হলো

১. বায়তুল মাল গঠন : ইসলামী রাষ্ট্রের কোষাগারগুলো কয়েক ভাগে বিভক্ত। এখানে আছে জাকাতসংক্রান্ত বায়তুল মাল, জিজিয়া, উশর ও খারাজ সংক্রান্ত বায়তুল মাল, গনিমত ও খনিজ সম্পদ সংক্রান্ত বায়তুল মাল।  জাকাত ইসলামী অর্থনীতির মেরুদন্ড ও চালিকাশক্তি। জাকাত ইসলামী রাষ্ট্রের জাতীয় আয়ের একটি অন্যতম উৎস। এই বায়তুল মালের কাজ হলো, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় রাষ্ট্রের অভাবী, কর্মক্ষম, গরিব, মিসকিন, এতিম, বিধবাসহ অসহায় ও পিছিয়ে পড়া মানুষের অর্থনৈতিক নিরাপত্তার বিধান নিশ্চিত করা। এ ছাড়া রাষ্ট্রের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে জনকল্যাণমূলক কাজের যাবতীয় খরচ সরবরাহ করা হবে এই বায়তুল মাল থেকে। তবে তা করতে হবে কোরআনে বর্ণিত খাতগুলোর মধ্যে থেকেই।

২. অর্থনৈতিক ভারসাম্য গঠন : প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থায় ধনী-গরিবের মধ্যে বিশাল দেয়াল রয়েছে। তাদের  মধ্যে রয়েছে বড় ধরনের অর্থনৈতিক ব্যবধান। আর জাকাতের মাধ্যমেই তা দূর করা সম্ভব। জাকাতের মাধ্যমে ধনী-গরিবের মধ্যে অর্থনৈতিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করা যায়। এ জন্য মহানবী সা. জাকাতকে ইসলামের সেতুবন্ধ বলে আখ্যায়িত করেছেন। ইমাম রাজি (রহ.) ধনীর সম্পদের সঙ্গে দরিদ্রের অধিকার সম্পর্কের ক্ষেত্রে কয়েকটি যৌক্তিকতা পেশ করেছেন।

ক. মানুষ যদি তার প্রয়োজন পরিমাণ সম্পদ অর্জন করে, তাহলে তাতে সে-ই বেশি হকদার। কারণ প্রয়োজনের বিচারে সে সব অভাবীর সঙ্গে অংশীদার। ওই সম্পদ অর্জনে প্রচেষ্টাকারী হিসেবে অন্যদের চেয়ে স্বতন্ত্র। সুতরাং ওই সম্পদে তার কর্তৃত্ব অন্যের কর্তৃত্বের চেয়ে বেশি।

খ. মানুষ যখন প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ নিজ ঘরে কুক্ষিগত করে রাখে, তখন সম্পদ সৃষ্টির উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়। আর তা আল্লাহর উদ্দেশ্যকে বানচাল করার অপপ্রয়াস। এটি অন্যায়ও বটে। তাই আল্লাহ তাআলা এ থেকে কিছু অংশ দরিদ্রের জন্য বরাদ্দ করার নির্দেশ দিয়েছেন। গ. দরিদ্র ব্যক্তি আল্লাহর পোষ্য। আর ধনীরা আল্লাহর ভান্ডার। কারণ তাদের হাতে যে অর্থ আছে, তা আল্লাহর সম্পদ, তারা এই সম্পদের রক্ষক মাত্র। ইসলাম সুষমভাবে অর্থ-সম্পদের জাকাত নির্ধারণ করেছে। এতে ধনীর প্রচেষ্টা এবং দরিদ্রের অধিকারের প্রতি লক্ষ রেখেছে। এ ক্ষেত্রে ইসলাম ধনীকে নির্মূল করেনি আবার দরিদ্রের অভাবও উপেক্ষা করেনি। (মুশকিলাতুল ওয়া কাইফা আলাজাহা ইসলাম, ড. ইউসুফ কারাজাভি)

৩. সর্বজনীন অর্থনৈতিক নিরাপত্তা : জাকাত মানুষের সর্বজনীন অর্থনৈতিক প্রয়োজন পূরণ করে। মানুষের অর্থনৈতিক নিরাপত্তার বিধান নিশ্চিত করে জাকাত। ইমলামী দর্শনে জাকাত ধনীর কাঁধে গরিবের হক। জাকাতের অর্থ ব্যয়ের আটটি খাত পর্যালোচনা করলে এই সর্বজনীন অর্থনৈতিক নিরাপত্তার দিকটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যেমন- ফকিরদের সাহায্য ও জীবিকার ব্যবস্থা, মিসকিনদের সাহায্য ও জীবিকার বন্দোবস্ত, দাসমুক্ত করা, ঋণগ্রস্তের পক্ষ থেকে ঋণ আদায়, মুআল্লাফাতুল কুলুব তথা যাদের ইসলাম গ্রহণের প্রতি আশা করা যায় বা ইসলামের প্রতি যাদের দুর্বলতা আছে, তাদের সাহায্য, মুসাফিরদের কল্যাণ এবং আল্লাহর পথে ব্যয় নির্বাহের জন্য জাকাতের অর্থ ব্যয় করা যায়। কোরআনে বর্ণিত এই আটটি খাতকে সমপ্রসারিত করে জাকাতের অর্থ আরো ব্যাপকায়তনে অর্থনৈতিক প্রয়োজন পূরণে কাজে লাগানো যায়। ৪. কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও বেকারত্ব দূর করা : জাকাতের অর্থ দিয়ে নতুন নতুন কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি করা যায়। জাকাতের অর্থ তা গ্রহণের উপযুক্ত ব্যক্তির মধ্যে বণ্টন করে তাদের পুঁজি সমবায়ের মাধ্যমে একত্র করে তা দিয়ে নানা ধরনের মিল, কলকারখানা ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা যেতে পারে। অথবা বেকাররা স্বাবলম্বী হতে পারে এ পরিমাণ জাকাতের অর্থ প্রদানেরও সুযোগ রয়েছে। ইসলামী রাষ্ট্রে জাকাত তোলার জন্য আলাদা কর্মচারী নিয়োগ দেওয়ার বিধান রয়েছে, যাকে শরিয়তের পরিভাষায় ‘আমিল’ বলা হয়। এর মাধ্যমেও অনেকের কর্মসংস্থান তৈরি হয়।

৫. সম্পদের বৃদ্ধি : জাকাত প্রদানের কারণে সম্পদ কোথাও জমা হয়ে থাকতে পারে না। অগণিত মানুষের হাতে পৌঁছে যায় জাকাতের অর্থ-সম্পদ। তারা তাদের চাহিদা পূরণে তা ব্যবহার করতে পারে এবং তারা প্রাপ্ত অর্থ-সম্পদকে বিভিন্ন জায়গায় বিনিয়োগ করতে পারে। বিনিয়োগের কারণে সম্পদ এক জায়গায় পুঞ্জীভূত হয়ে থাকে না, বরং এর মাধ্যমে সম্পদ বাড়ে। ফলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে। এতে বাজারে চাহিদা বাড়লে উৎপাদনও বাড়ে। আর উৎপাদন বাড়লে কর্মসংস্থানও বাড়ে। ফলে সমাজ থেকে বেকারত্ব ও অভাব দূর হয়। এভাবে জাকাত ইসলামী সমাজে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উন্নতি সাধন করে। ৬. উৎপাদন বৃদ্ধিতে জাকাতের ভূমিকা : সমাজের একটি অংশের হাতে সম্পদ কুক্ষিগত থাকলে উৎপাদনব্যবস্থায় তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। অসচ্ছলতার কারণে সাধারণ ভোক্তারা পণ্য ক্রয় করতে পারে না। ক্রয়ক্ষমতার অভাবে চাহিদা কমে আর চাহিদার অভাবে উৎপাদন হ্রাস পায়। আর জাকাত প্রদানের কারণে সম্পদের ব্যবহার বাড়ে। গরিব-মিসকিনদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে। ফলে বাজারে চাহিদা বাড়লে উৎপাদন ও জোগানও বাড়ে। এতে চাহিদা, উৎপাদন ও মুনাফা সব বেড়ে যায়। এভাবে জাকাত ইসলামী সমাজে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উন্নতি সাধন করে।

আমারসংবাদ/জেআই