Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪,

বঙ্গবন্ধুর দর্শন অনুশীলনের বিকল্প নেই

প্রকৌশলী এ কে এম এ হামিদ

মে ১০, ২০২১, ০৮:৩০ পিএম


বঙ্গবন্ধুর দর্শন অনুশীলনের বিকল্প নেই

(গতকালের পর...) পাকিস্তানের স্বৈরশাসক আইয়ুব খান ভূমি সংস্কার আইনে মাথাপিছু জমির পরিমাণ ৩৭৫ বিঘা করে। এই আইনের প্রেক্ষিতে ঐ সময়ে কোনো গরিব বা অর্থহীন কৃষক একবিঘা জমিও পায়নি। ঐ সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের শতকরা ৩৫ জন কৃষক ভূমিহীন হয়ে যায়। ৫ থেকে ১৫ বিঘার নিচে ভূমির মালিকানা পায় ৭৮ ভাগ মানুষ। লক্ষ্য করা গেছে যাদের ব্যাপক জমি রয়েছে, তাদের অধিকাংশ কৃষিকাজ করে না। যারা কৃষিপণ্য ফলান তাদের অধিকাংশ ছিলো ভূমিহীন। এ বৈষম্যের কারণে কৃষি অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের শাসনভার গ্রহণ করে সংবিধানের ৯৮ ধারা বলে মাথাপিছু ভূমির পরিমাণ সর্বোচ্চ ১০০ বিঘা নির্ধারণ করে উদ্বৃত্ত জমি গরিব ও ভূমিহীনদের মাঝে বিতরণের উদ্যোগ নেন। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষিজীবীর অস্তিত্ব ও স্বার্থ সংরক্ষণে তিনি কৃষিকে আধুনিকায়নের পাশাপাশি সমবায় ব্যবস্থা গড়ে তোলার পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। কৃষি ও কৃষক যাতে উচ্চ শ্রেণীভুক্ত ব্যক্তিদের নিকট জিম্মি না হয়ে পড়ে, সে দিকে লক্ষ্য রেখে বঙ্গবন্ধু দেশ পরিচালনায় নীতিনির্ধারণী একাধিক বক্তব্যে বলেছেন, “আমার এই কৃষক শ্রমিক ভাইরা আমাদের খাদ্য যোগায়-বেতন দেয়। তাদেরকে সম্মান দিয়ে কথা বলবেন।” সময়ের বিবর্তনে আজও বঙ্গবন্ধুর সেই রাজনৈতিক দর্শনই আমাদের পাথেয় হওয়া উচিত। জনগণকে কোন উচ্চশ্রেণী বা সিন্ডিকেটের নিকট জিম্মি হতে দেয়া হলে তা হবে আত্মঘাতি। বর্তমানে কৃষি উৎপাদনব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে ও হচ্ছে।

কৃষি যান্ত্রিকীকরণ, উৎপাদন ব্যবস্থায় ব্যয় বৃদ্ধির ফলে প্রান্তিক দরিদ্র কৃষকদের পক্ষে কৃষি উৎপাদন প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। অসংগঠিত কৃষককূল কৃষি উৎপাদন ও বণ্টনব্যবস্থার প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কষ্টকর হয়ে পড়ছে। কৃষকের এই দুর্বলতার সুযোগ কাজে লাগিয়ে ব্যাংক, বিমা, শিল্প-কারখানার উৎপাদনের পাশাপাশি দেশের বড় বড় পুঁজিপতিগণ এখন কৃষি যান্ত্রিকীকরণের সুবিধা কাজে লাগিয়ে কৃষিতে ঝুঁকে পড়েছে। তারা কৃষি উৎপাদন ও বণ্টনব্যবস্থা সম্পূর্ণ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিচ্ছে। শত শত বিঘা জমির মালিকানা নিয়ে এখন প্রচলিত কৃষির পাশাপাশি অপ্রচলিত কৃষি ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলছে। বিশেষ করে মৎস্য খামার, পোল্ট্রি, সবজি, ফলমূলচাষ এবং এসবকেন্দ্রিক শিল্প কারখানা গড়ে তুলে কৃষি পণ্যের বাজার পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে গেছে। এই অসামঞ্জস্য উৎপাদন ও বণ্টনব্যবস্থায় প্রান্তিক কৃষকগণ ক্রমেই সংঘবদ্ধ পুঁজিপতি কৃষি বেনিয়াদের নিকট হারিয়ে যাচ্ছে। যা দেশের জন্য এক অশনি সংকেত। রাজনীতি, শিল্প-কারখানা, ব্যাংক, বিমা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা ও শিক্ষাক্ষেত্রে পুঁজিপতিদের একচ্ছত্র আধিপত্যে জাতি যে বিভৎস রূপ দেখতে পাচ্ছে, কৃষিক্ষেত্র নিয়ন্ত্রণের ফলে আগামীতে ভোগ্যপণ্যের ক্ষেত্রেও জাতিকে অরাজক পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে। কৃষি ভোগ্যপণ্যের অরাজক পরিস্থিতি মোকাবিলা এবং ভবিষ্যৎ খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখে বঙ্গবন্ধুর কৃষি দর্শনের আলোকে সমবায়ব্যবস্থা গড়ে তুলে ১০০ বিঘার উপর জমির মালিকানা রাষ্ট্রীয়ভাবে অধিগ্রহণ করে তা প্রকৃত কৃষকদের মাঝে বিতরণ এবং কৃষি উৎপাদনে কৃষকদের সকল ধরনের সহায়তা প্রদানে রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে। অন্যথায় জনগণের সার্বভৌমত্ব তথা রাষ্ট্রই উচ্চ শ্রেণির সুবিধাভোগীদের নিকট জিম্মি হয়ে পড়বে।

দেশের শাসনব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে উচ্চ সুবিধাভোগীদের একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারের ধারাবাহিকায় অতিসম্প্রতি প্রকাশিত বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি)-২০২০ এ একশ্রেণির কারিগরি ঊর্ধ্বতন আমলা তথা ডিগ্রি ইঞ্জিনিয়ারদের একচ্ছত্র আধিপত্য অব্যাহত রাখার ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। জনগণের ক্ষমতার সার্বভৌমত্বের প্রতীক প্রধানমন্ত্রী ২০১৮ সালের নির্দেশনা এবং সরকারি উচ্চপর্যায়ের আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটির সিদ্ধান্তকে উপেক্ষ করে দেশের জনগণকে জিম্মি করে কতিপয় উচ্চপর্যায়ের সুবিধাভোগী কারিগরি আমলাদের কোটারি স্বার্থ সংরক্ষণের চক্রান্ত করা হয়েছে।

দুর্বৃত্তায়নের ধারাবাহিকতায় দেশের নির্মাণ ক্ষেত্রেও দেশ ও জনগণকে জিম্মি করার অসৎ উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি) ২০২০-তে ‘ইঞ্জিনিয়ার’-এর সংজ্ঞায় শুধু ডিগ্রি ইঞ্জিনিয়ারদের ‘ইঞ্জিনিয়ার’ হিসেবে প্রতিষ্ঠার অপচেষ্টা করা হয়েছে। যদিও সরকারের গঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটির প্রতিবেদনে ইঞ্জিনিয়ার-এর সংজ্ঞায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে— ইঞ্জিনিয়ার ২ ধরনের, তা হলো ‘ডিগ্রি ইঞ্জিনিয়ার ও ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার’। সরকারের কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা প্রসারের কার্যক্রম বাস্তবায়নে জাতির বৃহত্তর স্বার্থে বিএনবিসির যেসব ধারা বা উপধারায় ‘ইঞ্জিনিয়ার’ এবং ‘আর্কিটেকট’ শব্দ আছে তার পূর্বে ডিগ্রি অর্থাৎ ‘ডিগ্রি ইঞ্জিনিয়ার’ ও ‘ডিগ্রি আর্কিটেকট’ উল্লেখ করা ন্যায়সঙ্গত। অন্যদিকে দেশের নির্মাণক্ষেত্রে জনগণকে সুবিধাভোগী মুষ্টিমেয় ডিগ্রি প্রকৌশলীর নিকট জিম্মি করার অসৎ উদ্দেশ্যে বিএনবিসিতে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের (সিভিল) স্ট্রাকচারাল ডিজাইন করার অধিকার থেকে সম্পূর্ণরূপে বঞ্চিত করা হয়েছে। যা অন্যায়, অযৌক্তিক ও অগ্রহণযোগ্য। গুটিকয়েক ডিগ্রি ইঞ্জিনিয়ার (সিভিল)-এর নিকট সমগ্র জনগণকে জিম্মি করার এই জনস্বার্থবিরোধী অপকৌশল কোনোভাবে রাষ্ট্রের জন্য গ্রহণযোগ্য হওয়া উচিত নয়। এখানে উল্লেখ্য, ইতোপূর্বে নির্মাণ ক্ষেত্রে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার (সিভিল) ৪/৫ তলা পর্যন্ত বিল্ডিংয়ের স্ট্রাকচারাল ডিজাইন অত্যন্ত সফলতার সাথে করে জনগণকে সেবা দিয়ে আসছিলেন এবং জনগণ অত্যন্ত স্বল্পমূল্যে সেই সেবা গ্রহণ করতে পারতেন। তাই, জনস্বার্থ বিবেচনায় বিএনবিসি ২০২০-এ বর্ণিত ক্যাটাগরি-২ অর্থাৎ ৫তলা পর্যন্ত বিল্ডিংয়ের স্ট্রাকচারাল ডিজাইন করার সুযোগ যৌক্তিক কারণে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের (সিভিল) অন্তর্ভুক্ত করে সংশোধন করা যুক্তিযুক্ত। কনস্ট্রাকশন সুপারভিশনে ১০তলা ভবনের জন্য ডিগ্রি ও ডিপ্লোমা উভয়ের জন্য ৪ বছরের অভিজ্ঞতা রাখা হয়েছে। কিন্তু ১০ তলার ওপর অর্থাৎ বহুতল ভবন সুপারভিশনের জন্য ডিগ্রি ইঞ্জিনিয়ারদের অভিজ্ঞতা ৮ বছর এবং ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের জন্য অভিজ্ঞতা রাখা হয়েছে ২০ বছর। যা অযৌক্তিত, অগ্রহণযোগ্য ও নির্মাণকাজে সুপারভিশনের ক্ষেত্রে অনাকাঙ্ক্ষিত এক জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে। এই ক্ষেত্রে বহুতল ভবন সুপারভিশনের জন্য ডিগ্রি ইঞ্জিনিয়ারদের জন্য অভিজ্ঞতা ৫ বছর এবং ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের জন্য অভিজ্ঞতা ৭ বছর করে সংশোধন আনা প্রয়োজন। সার্টিফিকেশন অব ওয়ার্ক-এর ক্ষেত্রে ডিগ্রি ইঞ্জিনিয়ার, ডিগ্রি আর্কিটেক্ট ও প্ল্যানারদের রাখা হয়েছে। কিন্তু ডিপ্লোমা আর্কিটেক্ট ও ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের রাখা হয়নি। একটি নির্দিষ্ট উচ্চতার ভবনের কনস্ট্রাকশন সার্টিফিকেশনের ক্ষেত্রে সার্টিফাইড ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের রাখা বাঞ্ছনীয়। এছাড়া কস্ট্রাকশন অব অথরিটিতে ডিগ্রি প্রকৌশলীদের সংগঠন ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশ (আইইবি) এবং ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ (আইডিইবি)র প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত করা যুক্তিযুক্ত। প্রসঙ্গত উল্লেখিত ২-৩টি সংজ্ঞা ও উপধারা সংশোধন করা হলে বিএনবিসি-২০২০-এর মৌলিক কোনো পরিবর্তন ঘটবে না এবং জাতীয় নির্মাণ ও উন্নয়ন কার্যক্রমের কোনো ক্ষতিই হবে না। বরং নির্মাণ কার্যক্রমে সার্বজনীনতা বৃদ্ধি পাবে এবং জনগণ কোনো গোষ্ঠীর নিকট জিম্মি হবে না।

দেশের সামগ্রিক ইঞ্জিনিয়ারিং কর্মকাণ্ডের ৮৫ ভাগ কার্যক্রম পরিচালনা করেন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়াররা। কেননা, ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষাব্যবস্থায় ডিগ্রি ও ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়াররা উভয় গ্রুপই ৪ বছর ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াশোনা করে। তারপরও এই সীমাহীন বৈষম্যমূলক আচরণের মাধ্যমে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের রাস্তায় ঠেলে দিয়ে সরকারের মুখোমুখি দাঁড় করানোর অপপ্রয়াস চলছে কেন? এটা কি কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত? দেশে চলমান শ্রেণিবিভক্ত সমাজব্যবস্থায় ও ধনিক-বণিকদের উত্থান প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন সেক্টরে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেটের বিদ্যমান অপকৌশল থেকে জনগণকে রক্ষা নিঃসন্দেহে চ্যালেঞ্জিং কাজ। তারপরও ব্যবসা, বাণিজ্য, ব্যবস্থাপনা, প্রশাসন, সমাজব্যবস্থায় একশ্রেণির সুবিধাভোগী সংঘবদ্ধ অপশক্তির নানা অপকৌশল থেকে জনগণকে রক্ষা করে জনসার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রকেই বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে হবে। জনগণকে জিম্মি করে একটি সুবিধাবাদীগোষ্ঠীর একের পর এক জনস্বার্থবিরোধী কার্যক্রম পরিচালনার ফলে দেশে উগ্রবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন সমৃদ্ধির ধারাবাহিকতা অব্যাহত রেখে টেকসই উন্নয়নের পথে জাতিকে এগিয়ে নিতে হলে অবশ্যই সার্বজনীন সুশাসন, পণ্য উৎপাদন ও বণ্টনব্যবস্থা, সম্পদের সুসমবণ্টন, কর্মনিশ্চয়তা, শ্রমশোষণ রোধ, উৎপাদন ব্যবস্থায় জনগণের অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করার পাশাপাশি জনকল্যাণকর ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিকচর্চা জোরদার করার বিকল্প নেই। আর তা করতে হলে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর দর্শন ও পথনির্দেশনায় দেশের সকল ধর্ম, বর্ণ, জাতিনির্বিশেষে সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের কর্মের অধিকার ও মর্যাদা অকক্ষুণ্ন রেখে জনকল্যাণকর রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রবর্তনে সরকারকে সুদৃঢ় পদভারে এগিয়ে যেতে হবে এবং প্রতিষ্ঠা করতে হবে সার্বভৌমত্ব বা রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব।

লেখক : উন্নয়ন গবেষক, সভাপতি আইডিইবি

আমারসংবাদ/জেআই