মে ১১, ২০২১, ০৭:৪৫ পিএম
থেমে নেই বাড়ি ফেরা। স্বজনদের সঙ্গে ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করতে করোনার ভয় আর পথে পথে নানা দুর্ভোগ উপেক্ষা করেই সড়ক ও নৌপথে নেমেছে গ্রামমুখী মানুষের ঢল। সড়কে দূরপাল্লার গণপরিবহন না চলায় যেতে হচ্ছে কিছুটা হেঁটে, কিছুটা ভেঙে, লোকাল পরিবহন কিংবা প্রাইভেট গাড়ি রিজার্ভ করে। আর দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলায় যাতায়াতের ফেরি চলাচল বন্ধ করে দেয়া হলেও কমেনি যাত্রীর চাপ। বিজিবি ও আনসার মোতায়েন করেও কাজ হয়নি। শেষমেশ যাত্রীদের চাপে শনিবার বিকাল থেকে ফের ফেরি চলাচল স্বাভাবিক করে বিআইডব্লিউটিসি। গণপরিবহন বন্ধ থাকায় ভেঙে ভেঙে বিভিন্ন পরিবহনে যাওয়ার ফলে বেড়েছে যাতায়াত খরচও। স্বাস্থ্যবিধি না মেনে গাদাগাদি করে যাওয়ার কারণে বাড়ছে করোনার ঝুঁকিও।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাড়িতে যাওয়ার জন্য মানুষ কোনো স্বাস্থ্যবিধি মানছে না। দলবেঁধে গাদাগাদি করে গ্রামে ফেরার খেসারত ঈদের পরপরই দিতে হবে বলেও আশঙ্কা তাদের। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, মানুষের এই গাদাগাদি করে গ্রামে যাওয়ার কারণে ভাইরাসটি সারা দেশের গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে পড়বে। যার প্রকাশ ঘটবে ঈদের দুই সপ্তাহ পর। এ সময় দেশে আঘাত আনতে পারে করোনার তৃতীয় ঢেউ। আর সব ভয়কে বাস্তবে রূপ দিয়ে দ্রুত ছড়িয়ে বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ সৃষ্টি করা ভারতীয় করোনার ভ্যারিয়েন্টও (ধরন) এরই মধ্যে দেশে ধরা পড়েছে। ভাইরাসটি যদি পুরোপুরি ছড়িয়ে পড়ে তাহলে অবস্থা হবে ভয়াবহ।
এদিকে আজ বুধবার থেকে ঈদের ছুটি শুরুর সিদ্ধান্ত জানালেও পরে আগামীকাল বৃহস্পতিবার থেকেই ঈদের ছুটি শুরু হচ্ছে বলে জানিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। সে হিসেবে শনিবার পর্যন্ত তিনদিন থাকছে ঈদের ছুটি। ইসলামিক ফাউন্ডেশন জানিয়েছে, শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখতে আজ বুধবার বৈঠকে বসছে জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটি। চলতি বছর ঈদুল ফিতর কোন দিন হবে তা জানা যাবে ওই বৈঠকের পর। সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ইফা জানায়, ১৪৪২ হিজরি সনের পবিত্র শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখার সংবাদ পর্যালোচনা এবং এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের লক্ষ্যেই আজ সন্ধ্যা ৭টায় (বাদ মাগরিব) বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের পূর্ব সাহানে জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হবে।
এরই মধ্যে গতকাল রাজধানীর গাবতলী, কল্যাণপুর, টেকনিক্যাল, শ্যামলী বাসটার্মিনাল ঘুরে দেখা গেছে, হাতে ব্যাগ নিয়ে বাড়ির উদ্দেশে রওনা হয়েছে মানুষ। সিএনজি, ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেল ও মাইক্রোবাসে যে যেভাবে পারছেন ঢাকা ছাড়ছেন। আন্তঃজেলা পরিবহন বন্ধ থাকলেও গাবতলী পুলিশ বক্সের আগে কয়েকটি বাসকে মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া ফেরিঘাট পর্যন্ত যাত্রী নিতে দেখা যায়। সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী অর্ধেক আসন ফাঁকা রেখে পরিবহন চালানো কিংবা জেলার বাইরে না যাওয়ার নিয়মকে তোয়াক্কা না করেই চলছে এসব গাড়ি।
আবার সরকারি নির্দেশনা উপেক্ষা করে প্রশাসন ম্যানেজ করেও সড়কে চলছে দূরপাল্লার বাস। মনোহরদী পরিবহনের একটি বাসের চালক বলেন, বাস রাতে ছাড়ে। তবে পুলিশ আটকায়। কিন্তু ম্যানেজ করেই যেতে হয়। যাত্রীরা বলছেন, ভেঙে ভেঙে যেতে তাদের বেশি ভাড়া গুনতে হচ্ছে। পাবনাগামী এক যাত্রী বলেন, রাতে গাড়ি ছাড়বে আমিনবাজার থেকে এমন একটি গাড়ির লোকদের সঙ্গে দুই হাজার টাকা ভাড়ায় যাওয়ার কথা হয়েছে। বিআরটিএর ম্যাজিস্ট্রেট ফখরুল ইসলাম বলেন, সরকারের নির্দেশনা বলবৎ রাখতে আমরা কাজ করছি। বিভিন্ন গাড়ি জরিমানা করেছি। কিন্তু জনসাধারণের সহযোগিতা পাচ্ছি না। এ সময় যদি সবাই সহযোগিতা না করে তাহলে করোনা পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।
অথচ করোনাকালে গাদাগাদি করে বাড়ি ফিরতে নানাভাবে অনুৎসাহিত করা হলেও গত চার দিন ধরে দক্ষিণবঙ্গের ২১ জেলার প্রবেশদ্বার শিমুলিয়ায় ভিড় করছেন হাজার হাজার যাত্রী। দিনে ফেরি বন্ধ রেখে, রাতে পণ্যবাহী যান পারের নির্দেশনা থাকার পরও মানুষের ভিড় বাড়ছেই। বিভিন্ন জরুরি পরিবহন পারাপারের জন্য থাকা ফেরিতে করে পারাপারও হচ্ছেন তারা। অবশ্য ঘাট থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে সড়কে বিজিবির চেকপোস্টের কারণে কোনো যাত্রীবাহী যান ঘাটে প্রবেশ করতে পারছে না। তবে নানা পথ ঘুরে, হেঁটে, পাহারা গলে ঠিকই যাত্রীরা পৌঁছে যাচ্ছেন ঘাটে। ফলে ঘাটে বাড়ছে যাত্রীদের চাপ। গতকাল মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়া ফেরিঘাটে ছিলো যাত্রীদের গাদাগাদি।
শিমুলিয়া ঘাটের বিআইডব্লিউটিসির মেরিন অফিসার আহম্মেদ আলী বলেন, সকালে ঘাটে কয়েকটি লাশবাহী অ্যাম্বুল্যান্স এসে জড়ো হয়। অ্যাম্বুল্যান্সগুলো পার করতে যুমনা আইটি-৩৯৫ ফেরিটি ঘাটে ভেড়ানো হয়। সে সময় ঘাটে অপেক্ষমাণ যাত্রীরা হুমড়ি খেয়ে পড়ে। ফেরিতে গাদাগাদি করে ওঠে যাত্রীরা। ফেরিতে শুধু জরুরি পরিষেবার গাড়ি পার করা হচ্ছে। গতকাল সরেজমিন দেখা যায়, মুন্সীগঞ্জ জেলা প্রশাসনের সঙ্গে পুলিশ-বিজিবির রাস্তায় থাকলেও চেকপোস্টগুলোর দুই পাশেই গাড়ির জটলা। বাধা পাওয়া মাত্রই মানুষ গাড়ি ছেড়ে হেঁটেই চেকপোস্ট পেরিয়ে ওপাশের অপেক্ষমাণ গাড়িতে গিয়ে উঠছে। সকাল সাড়ে ৭টায় ইকুরিয়া এলাকায় দেখা যায় ব্যাগ নিয়ে হেঁটে চলা চার তরুণের একটি দল। তারা জানান, সোমবার সারা রাত ট্রাকে চেপে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসেছেন তারা, যাবেন মাদারীপুর।
এদিকে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌপথে জরুরি রোগী ও লাশবাহী অ্যাম্বুল্যান্স পারাপারের জন্য ছোট দুটি ফেরি চলাচল করছে। এসব জরুরি পরিষেবার যানবাহন পারাপারের প্রস্তুতির সময় যাত্রীরা হুমড়ি খেয়ে ফেরিতে উঠে পড়ে। এদিকে যাত্রীর ঢল ঠেকাতে বিজিবি মোতায়েন করা হলেও ঘাট এলাকায় তাদের তৎপরতা দেখা যায়নি।
বিআইডব্লিউটিসির আরিচা কার্যালয়ের ডিজিএম মো. জিল্লুর রহমান বলেন, পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌপথে জরুরি লাশবাহী ও রোগী পারাপারের জন্য ছোট দুটি ফেরি সচল রাখা হয়েছে। এসব ফেরিতে যাত্রীরা হুমড়ি খেয়ে উঠছে। যাত্রীদের সামাল দেয়া যাচ্ছে না।
সোমবার সকাল ৬টা থেকে গতকাল মঙ্গলবার সকাল ৬টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় বঙ্গবন্ধু সেতু দিয়ে রেকর্ড সংখ্যক যানবাহন পারাপার হয়েছে বলে জানিয়েছে সেতু কর্তৃপক্ষ। সেতু কর্তৃপক্ষ জানায়, ৪১ হাজার ৬২৫?টি গা?ড়ি সেতু দিয়ে পার হয়েছে। এসব যানবাহন থেকে টোল আদায় হয়েছে ২ কো?টি ৫৬ লাখ ১৮ হাজার ৫০০ টাকা। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপ?ক্ষের বঙ্গবন্ধু সেতুর সাইট অ?ফিসের নির্বাহী প্রকৌশলী আহসানুল কবীর পা?ভেল এ তথ্য জানান। এছাড়া গতকাল সকাল থেকেই ঢাকা-টাঙ্গাইল-বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়কে উত্তরবঙ্গমুখী যানবাহনের চাপ র?য়েছে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সড়কে যানবাহন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ট্রাক, মাইক্রোবাস, পিকআপভ্যানসহ বিভিন্ন ব্যক্তিগত গাড়িতে গাদাগাদি করে বাড়ি ফিরছেন মানুষ। ফলে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
প্রতি বছরের মতো এবারো ঠিক ঈদের আগে তীব্র যানজটের কবলে পড়েছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক। এতে চরম দুর্ভোগের মধ্যে পড়েছেন মানুষ। এদিকে সরকারি বিধিনিষেধের কারণে দূরপাল্লার যান বন্ধ। তাতে কি। যেভাবেই হোক ঈদে বাড়ি ফিরতে হবে। যানবাহন প্রাপ্তির অনিশ্চয়তা মাথায় নিয়েই এই রুটে সকাল থেকেই গ্রামের দিকে ছুটছেন ঘরমুখো হাজারো মানুষ। শত ভোগান্তির পরও ঝুঁকি নিয়ে যে যেভাবে পারছে ঢাকা ছাড়ছেন তারা। ট্রাক, মিনি ট্রাক, মাইক্রোবাস, মোটরসাইকেলে করে দ্বিগুণ-তিনগুণ ভাড়ায় অবর্ণনীয় ভোগান্তি সয়েই বাড়ি যাচ্ছেন। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের দাউদকান্দিতে ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ যানজট তৈরি হয়েছে গতকাল। মহাসড়কের দাউদকান্দির শহীদনগর থেকে পুটিয়া পর্যন্ত দীর্ঘ হয় এ যানজট।
আমারসংবাদ/জেআই