ফারিহা হোসেন
মে ২৩, ২০২১, ০৯:০৫ পিএম
নারী ও কিশোরীদের নিয়ে দুটো তথ্য সম্প্রতি সংবাদ মাধ্যমে বেশি প্রকাশিত হয়েছে। এর একটি হচ্ছে মহামারি করোনা ভাইরাসের মধ্যে বাল্যবিয়ে বেড়েছে ৫৮ শতাংশ। অকাল গর্ভধারণ বেড়েছে ৩০ শতাংশ। আর ৪৯ শতাংশ নারী লকডাউনকে নিজেদের অনিরাপদ মনে করছে। তাছাড়া অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালু রাখা হলেও সে সুবিধা নিতে পেরেছে মাত্র ২ শতাংশ শিশু শিক্ষার্থী। অন্যটি হচ্ছে— করোনাকালে ইন্টারনেটে যৌননিপীড়নের শিকার হচ্ছে ৬৯ শতাংশ নারী, বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, তথা ইন্টারনেটে একান্ত ব্যক্তিগত মুহূর্তের ছবি-ভিডিও ছড়ানোর মাধ্যমে যৌন নিপীড়নে ভুক্তভোগীদের ৬৯ দশমিক ৪৮ শতাংশই আপনজনদের হাতে শিকার হন। এর মধ্যে ৩৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ ক্ষেত্রে ভুক্তভোগী ও অপরাধীর মধ্যে প্রেম ঘটিত সম্পর্কের তথ্য উঠে এসেছে। ৩৫ দশিমিক ৭১ শতাংশ ঘটনায় অপরাধী ভুক্তভোগীর পূর্বপরিচিত। অবশ্য সরকারি মহল থেকে এ দুটি বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে এর নিরসনে নেয়া হয়েছে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও এ ক্ষেত্রে কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে। তবে এ থেকে পরিত্রাণে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন জনসচেতনতা। তাহলেই নারীরা নিপীড়নের অভিশাপ থেকে পরিত্রাণ পাবে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের এক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। সম্প্রতি ভার্চুয়াল মাধ্যমে ‘সরকারের আর্থ-সামাজিক পুনরুদ্ধার ব্যবস্থা : নারীরা কতটা উপকৃত হয়েছে’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরে সিপিডি। গবেষণায় বলা হয়, মহামারি করোনা ভাইরাসের কারণে ২০২০ সালের মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গৃহে কাজ করা ৫৪ শতাংশ নারী এবং গার্মেন্টসের ১৯ শতাংশ নারী কাজ হারিয়েছে। করোনা মহামারি গরিব এবং নিম্ন আয়ের নারীদের ওপর বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। নারীরা বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। করোনার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সরকার প্রায় এক লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। দরিদ্রদের কষ্ট লাঘবে গত বছর পবিত্র ইদুল ফিতর এবং এ বছর পবিত্র ইদুল ফিতর উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাড়ে ৩৬ লাখ দরিদ্র পরিবারকে আড়াই হাজার টাকা করে নগদ সহায়তা দিয়েছেন। এতে দরিদ্র পরিবারগুলো অনেক খানি উপকৃত হয়েছে।
করোনাকালে বাল্যবিয়ে বৃদ্ধি পাশাপাশি নারী পোশাকশ্রমিকদের বেকার হওয়াসহ সাইবারক্রাইমও বেড়ে গেছে। করোনায় আর্থিক সংকটের পাশাপাশি সমাজে অপরাধ প্রবণতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। ২০২০ সালে করোনাকালীন সাত মাসে দেশের ২১ জেলার ৮৪ উপজেলায় ১৩ হাজার ৮৮৬টি বাল্যবিয়ে হয়েছে। করোনাকালে দারিদ্র্য বৃদ্ধি ও পরিবারের সদস্যদের মৌলিক প্রয়োজনের ব্যবস্থা করতে না পারার বিষয় বাল্যবিয়ের বড় কারণ হিসেবে কাজ করছে। করোনাকালে বাল্যবিয়ের অন্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে— আয় হারিয়ে দারিদ্র্য বৃদ্ধি, বিদ্যমান সামাজিক নিয়ম-বিশ্বাস, স্কুল বন্ধ প্রভৃতি। অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত এসব পরিবারের অভিভাবকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় মেয়েদের নিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। আবার করোনাকালে অনেক প্রবাসী অবিবাহিত যুবক দেশে ফিরে এসেছেন। তারাও অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোরীদের বিয়ে করছেন। ইউনিসেফের তথ্য মতে, দেশের ৫৯ শতাংশ কিশোরীর বিয়ে হয় ১৮ বছরের আগেই। আর ২২ শতাংশের বিয়ে হচ্ছে ১৫ বছরের আগে, যদিও সরকার বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে কঠোর অবস্থানে। বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি, শিক্ষক এবং সামাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা কাজ করছেন।
দেশে করোনায় লকডাউনের মধ্যেও ঘরে নারী ও শিশুরা সহিংসতার শিকার হচ্ছে। এমনকি মোবাইল ফোনে কথামতো তুচ্ছ ঘটনা থেকেও স্বামীর নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন তারা। লকডাউনে নতুন করে সমস্যা সৃষ্টি করছে নারী, শিশুর দৈনন্দিন জীবনযাত্রার ক্ষেত্রে। ঘরে নারী নির্যাতনে স্বামীরাই প্রধানত জড়িত। কারণ করোনাকালে তাদের অনেকেরই কোনো কাজ নেই, আয়ও নেই। তারা বাইরে যেতে পারছে না। এ সবকিছুর জন্য পুরুষ মানসিক সমস্যায় ভুগছে। মানসিক চাপ থেকেই তারা নির্যাতন করছে। এর বাইরে শ্বশুর-শাশুড়ি এবং পরিবারের অন্য সদস্যদেরও ভূমিকা আছে। করোনাকালে বাল্যবিয়েবিরোধী প্রচারণা কিছুটা কমে যাওয়ায় কেউ কেউ এর সুযোগ নিচ্ছে। তাই নারী, শিশুর প্রতি সহিংসতা রোধে আইনের কঠোর প্রয়োগের পাশাপশি সচেতনতামূলক কর্মসূচি প্রয়োজন। নারী নির্যাতন রোধ ও বাল্যবিয়ে বন্ধে প্রচলিত আইনে শাস্তির বিধান রয়েছে। এই বিধান বাস্তবায়নে জেলা, উপজেলা পর্যায়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিয়মিত কাজ করছেন। রয়েছে মাঠপর্যায়ে মনিটরিং ব্যবস্থা। যখনই কোনো এলাকায় নারী নির্যাতন, যৌন হয়রানিসহ বাল্যবিয়ের তথ্য প্রশাসনের কাছে আসছে তাৎক্ষণিক ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযুক্ত এবং দায়ীদের শাস্তি অর্থদণ্ড এবং ভিক্টিমকে উদ্ধার করে পুনর্বাসন কেন্দ্র নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে সমাজে গুজব ও অস্থিরতা সৃষ্টির পাশাপাশি যৌনহয়রানি, যৌন নিপীড়ন বাড়ছে। এ মর্মে স্বেচ্ছাসেবী একটি সংস্থার প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য উল্লেখ করেছে। সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশন ‘বাংলাদেশে প্রযুক্তির অপব্যবহারের মাধ্যমে যৌন নিপীড়ন’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি করেন সংগঠনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) চ্যাপ্টারের গবেষণা সেলের সদস্যরা। এ ছাড়া পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনকেও অনুসরণ করা হয়। অপরাধের মাত্রায় বছরের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পরিস্থিতির কারণে ভিন্নতা দেখা যায়। বর্তমানে কোভিড পরিস্থিতিতে লকডাউনের কারণে অনলাইন কার্যক্রম বেড়েছে। ফলে এ ধরনের অপরাধ করার জন্য সময় বেশি পাচ্ছে। অপরাধের শিকার হওয়ার পর ভুক্তভোগীরা বেশির ভাগই মান-সম্মানের ভয়ে যৌন হয়রানির তথ্য প্রকাশ করতে চায় না। এ কারণে এই করম অপরাধ সংগঠিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়। অথচ ঘটনার শুরুতেই জানানো হলে পরবর্তীতে প্রতিকার পাওয়ার উপায় থাকে। সাইবার স্পেসে যৌন নিপীড়নের ক্ষেত্রে ৯২ দশমিক ২০ শতাংশ ভুক্তভোগীই নারী। এর মধ্যে ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়স্ক ভুক্তভোগীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। যৌন নিপীড়নের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত ছবি-ভিডিও প্রচারের ভয় দেখিয়ে যৌন নিপীড়নমূলক অপরাধ প্রবণতার মধ্যে যৌন হয়রানি, ধর্ষণ, আত্মহত্যা, আত্মহত্যার চেষ্টা, যৌনপণ, হত্যা-চেষ্টার মতো ঘটনা উল্লেখযোগ্য। পাশাপাশি নিপীড়নকারী আশ্রয় নিচ্ছে নানা রকম কূটকৌশল ও প্রতারণার। সাইবার জগতে নারী হয়রানিকারীদের দিন শেষ হতে চলেছে। সাইবার স্পেস যেনো নারীদের জন্য নিরাপদ হয়, তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ পুলিশ ২০২০ সালে চালু করেছে ‘পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন’ নামের একটি সেবা। সাইবার হয়রানির শিকার নারীরা যেনো ভয়-ভীতির ঊর্ধ্বে উঠে নির্দ্বিধায় অভিযোগ করতে পারেন, সে জন্য এ সেবা চালু করা হয়েছে। এ সেবার সাথে জড়িত সেবাদানকারীদের সবাই নারী। এছাড়াও ৯৯৯ টোল ফ্রি নম্বরে ফোন করেও সমস্যার সমাধান ও প্রতিকার পাওয়া যাচ্ছে। বাল্যবিয়ে, সাইবার হয়রানিসহ যেকোনো ধরনের নির্যাতন, নিপীড়ন প্রতিহত করতে গণমাধ্যমে ব্যাপক সচেতনতামূলক প্রচার, প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা, ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আরো কঠোর অবস্থান, ভুক্তভোগী ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মধ্যে যথাযথ সমন্বয় নিশ্চিত করা আবশ্যক। আমাদের প্রত্যাশা বাল্যবিয়ে বন্ধ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে নারীদের যৌন হয়রানি ও সাইবার অপরাধ দমনে বিদ্যমান আইনের পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন। সেই সাথে সকলকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।
লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক (পিআইডি-ফিচার)
আমারসংবাদ/জেআই