মোতাহার হোসেন
মে ২৪, ২০২১, ০৯:৪৫ পিএম
স্বাধীনতা অর্জনের ৫০ বছরে বাংলাদেশের সামগ্রিকভাবে বিস্মকর উন্নয়ন এখন বিশ্বের কাছে ‘রোল মডেল’। একইসঙ্গে নিম্নআয়ের দেশ থেকে উত্তরন বাংলাদেশের জন্য বড় সম্মান বয়ে আনছে। পাশাপাশি করোনার এই বৈশ্বিক বিপর্যয়ের মধ্যেও অর্থনীতির সকল সূচকে ইতিবাচক অবস্থান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে গুরুত্ব বহন করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি একাধিক অনুষ্ঠানে আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেছেন, ‘সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পালা বাংলাদেশের। বাংলাদেশের উন্নয়ন অর্জন কেউ থামিয়ে দিতে পারবে না— বলেও অভিমত তার।’ বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী এক দেশ। কথিত ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ সম্পদে উপচেপড়া দেশে রূপান্তর হয়ে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশ এখন মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো এক দেশ। সরকারি বিভিন্ন সংস্থার তথ্য-উপাত্ত এবং দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার প্রদত্ত তথ্যেও এমন চিত্রই ফুটে উঠেছে। কিন্তু সরকারের সামনে অন্যতম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে উন্নয়নের এই ধারাকে এগিয়ে নেয়ার পাশাপাশি টেকসই ও পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন লক্ষ্য বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা।
স্বাধীনতার বছর ১৯৭১ সাল থেকে ২০২১— এই ৫০ বছরকে অর্থনীতির নানা সূচকে অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ প্রত্যাশা অনুযায়ী সমৃদ্ধি, অগ্রগতি, উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। বিশেষ করে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি, মাথাপিছু আয়, জাতীয় বাজেট, রপ্তানি আয়, স্বাক্ষরতার হার, দারিদ্র্যের হার, মানুষের গড় আয়ু, গড় আয়ু, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, রেমিটেন্স ইতিবাচক অবস্থান বিশ্বের কাছেও বিস্মকর অর্জন হিসেবে স্বীকৃতি এসেছে। স্বাধীনতার সময় বাংলাদেশের জিডিপি ছিলো প্রায় ৯ বিলিয়ন ডলার। আর এখন তা দাঁড়িয়েছে ৩০২ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারে। স্বাধীনতার সময় মাথাপিছু আয় ছিলো মাত্র ১৪০ ডলার। এখন তা ২ হাজার ৫০০ ডলারে ঠেকেছে।
অনুরূপভাবে ১৯৭২-৭৩ সালে বাংলাদেশের বাজেটের পরিমাণ ছিলো ৭৮৬ কোটি টাকা আর চলতি ২০২০-২১ সালের বাজেট ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। ১৯৭২-৭৩ সালের তুলনায় বাজেটের আকার বেড়েছে প্রায় ৭২২ গুণ। এর প্রতিফলন দেখা যায় বিদ্যুৎ, গ্রামীণ সড়কের ঘনত্ব, শিল্পায়ন, গৃহায়ণ, নগরায়ণ, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ও দারিদ্র্যবিমোচন প্রভৃতি ক্ষেত্রে। সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রেও দেশে ৫০ বছরে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। একইভাবে শিক্ষা, স্বাস্থ্য তথা শিশুমৃত্যু, মাতৃমৃত্যু, ইপিআই, নারীর ক্ষমতায়ন, জন্ম ও মৃত্যুহার হ্রাসে ঈর্ষণীয় অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। মানবসম্পদ উন্নয়নে অনেক দূর অগ্রসর হয়েছে দেশ। বিশ্বব্যাংকের ‘মানব উন্নয়ন সূচকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে ১৭৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৪৬ পয়েন্ট নিয়ে ৫২তম অবস্থানে। এ বিষয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমানের মন্তব্য— ‘স্বাধীনতার সময় তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। আমার বিশ্বাস সেই কিসিঞ্জার যদি আজ বেঁচে থাকতেন তা হলে তিনিই এখন বাংলাদেশের উন্নয়ন দেখে বিস্ময় প্রকাশ করতেন। এখন আমরা বাংলাদেশকে নিয়ে গর্ব করে বলতে পারি সেই তলাবিহীন ঝুড়ি আজ বিশ্বের বিস্ময়, উন্নয়নের এক রোল মডেল। তিনি বলেন, স্বাধীনতার সময়ে অর্থনীতির প্রতিটি সূচকের যে অবস্থা তা পাকিস্তানের চেয়ে শতগুণ বেশি এগিয়েছে। আজ ৫০ বছর পর অর্থনীতিসহ সামাজিক সকল সূচকেই তারা বাংলাদেশ থেকে বহুগুণ পিছিয়ে আছে। এটাই স্বাধীনতার বড় অর্জন। যেকোনো দেশের উন্নয়নে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ধরা হয় মানবসম্পদ। এতে শুধু পাকিস্তান নয়, অনেক ক্ষেত্রে ভারত থেকেও অনেক এগিয়ে আছে। বিশেষ করে নারী শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, নারীর ক্ষমতায়ন, মা ও শিশুমৃত্যুর হার হ্রাসে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে গেছে।
আর্থিক ও সামাজিক সূচকের তুলনা করলে দেখা যায়— আসলেই বাংলাদেশ অনেকটা এগিয়েছে সমৃদ্ধির পথে। শিশুমৃত্যুহার রোধের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অবাক করার মতো উন্নতি করেছে। একটা সময় ছিলো যখন দেশে চিকিৎসার অভাবে কিংবা জনসচেতনতার অভাবে শিশুমৃত্যুহার ছিলো অত্যাধিক। আর এখন বাংলাদেশে শিশু মৃত্যুহার ২২। শিক্ষার হারের ক্ষেত্রেও অনেক এগিয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশে এখন শিক্ষার হার ৭৩.৯ শতাংশ। বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার এখন ১ দশমিক ৩ শতাংশে নেমে গেছে। জন্মনিয়ন্ত্রণ হারে বাংলাদেশ ভালো অগ্রগতি অর্জন করেছে। এ ক্ষেত্রে সূচক এখন ২ শতাংশের নিচে। মানুষের গড় আয়ু এখন ৭২.৫। স্বাধীনতার সময় যা ছিলো মাত্র ৪০ বছরের কাছে। দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা নাগরিকের হার এখন ২৪.৩ শতাংশ। ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ সংযোগের হার ৮৫.২ শতাংশ। করোনা মহামারি আঘাত হানার আগে ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশের রপ্তানি আয় হয়েছিল ৪০ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৪৪ বিলিয়ন ডলারে। এসবই হচ্ছে গত ৫০ বছরে স্বাধীন বাংলাদেশের অসামান্য অর্জন। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণে জাতিসংঘের চূড়ান্ত স্বীকৃতি পায় বাংলাদেশ। পরদিন সংবাদ সম্মেলনে দেশবাসীকে সেই সুখবর জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
গত এক দশকে রপ্তানি আয়ের ওপর ভর করে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় ‘চাঙ্গা অর্থনীতির উদাহরণ’ সৃষ্টি করেছে বলে বর্ণনা করা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের একটি নিবন্ধে। এই সাফল্যের প্রসঙ্গ টেনে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের নিবন্ধে বলা হয়েছে, গত এক দশকে প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তানের তুলনায় রপ্তানি আয়ে অভাবনীয় সাফল্য দেখিয়েছে বাংলাদেশ। বিকাশমান তৈরি পোশাকশিল্প খাতের ওপর ভর করে এই সময় বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ডলারের হিসাবে ৮০ শতাংশ বেড়েছে। জাতিসংঘের নিয়ম অনুযায়ী, কোনো দেশ পর পর দুটি ত্রিবার্ষিক পর্যালোচনায় উত্তরণের মানদণ্ড পূরণে সক্ষম হলে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের চূড়ান্ত সুপারিশ পায়। বাংলাদেশ দ্বিতীয়বারের মতো মানদণ্ডগুলো অর্জন করেছে। ১৯৭৫ সাল থেকে স্বল্পোন্নত দেশের কাতারে থাকা বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণে সিডিপির সব শর্ত পূরণ করেছে ২০১৮ সালে। সিডিপি তিনটি সূচকের ভিত্তিতে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের বিষয়টি পর্যালোচনা করে। তিনটি সূচকেই বাংলাদেশ শর্ত পূরণ করে অনেক এগিয়ে গেছে।
উন্নয়নশীল দেশ থেকে একটি দেশের মাথাপিছু আয় হতে হয় কমপক্ষে ১২৩০ মার্কিন ডলার। ২০২০ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিলো ১৮২৭ ডলার। মানবসম্পদ সূচকে উন্নয়নশীল দেশ থেকে ৬৬ পয়েন্টের প্রয়োজন; বাংলাদেশের পয়েন্ট এখন ৭৫.৩। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন বাংলাদেশের এসব অর্জন একদিনে আসেনি। গত ৫০ বছরে পরিশ্রম ও ত্যাগের বিনিময়ে এসব অর্জনে সহায়তা করেছে বাংলাদেশের মানুষ। এ বিষয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুরের উদ্ধৃতি দিয়ে সংবাদ মাধ্যমে বলা হয়, গত ৫০ বছরে বাংলাদেশের অর্জনকে কোনোভাবেই খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। আমাদের দেশে উন্নত অনেক দেশের মতো সমৃদ্ধ খনিজসম্পদ নেই। আমাদের আছে বিশাল জনশক্তি, সমৃদ্ধ কৃষি এবং মানুষের ইচ্ছা শক্তি। এগুলোর সমন্বয়েই আজকের সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। এদিকে, ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের হংকংভিত্তিক আর্থিক বাজার বিশ্লেষক মাইক বার্ডের লেখা এক নিবন্ধে ‘বাংলাদেশ ইজ বিকামিং সাউথ এশিয়াস ইকোনমিক বুল কেইস’ হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক শক্তি হয়ে উঠছে বাংলাদেশ। এতে বলা হয়, গত এক দশকে রপ্তানি আয়ের ওপর ভর করে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় ‘চাঙ্গা অর্থনীতির উদাহরণ’ সৃষ্টি করেছে। আমাদের প্রত্যাশা বাংলাদেশের এই উন্নয়ন, অর্জন, সম্ভাবনা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এগিয়ে যাবে বিগত সময়ের মতো। একই সঙ্গে উন্নয়ন, খাদ্য নিরাপত্তা, নারী শিশুর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় প্রয়োজন টেকসই ব্যবস্থাপনা।
লেখক : সাংবাদিক ও আবহাওয়া গবেষক
আমারসংবাদ/জেআই