Amar Sangbad
ঢাকা মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪,

সৃষ্টির সেবায় স্রষ্টার নৈকট্য লাভ

মুফতি মোহাম্মদ ইব্রাহিম খলিল

মে ২৭, ২০২১, ০৯:০০ পিএম


সৃষ্টির সেবায় স্রষ্টার নৈকট্য লাভ

মানুষ আল্লাহ তায়ালার সেরা সৃষ্টি। পৃথিবীতে তারা আল্লাহ তায়ালার খলিফা। পৃথিবীর সব কিছু মানুষের ব্যবহারের জন্যে সৃষ্টি করা হয়েছে। সৃষ্টির সেরা হিসেবে মানুষ এ সব সৃষ্টির সুবিধা-অসুবিধা লক্ষ করবে। সাহায্য-সহযোগিতা, সহানুভূতি ও পরিচর্যা দিয়ে তাদের অসুবিধা দূর করবে। খিদমতে খালক মূলত মানুষের এমন সহমর্মী আচরণের নাম। অন্যভাবে বলা যায়, মানুষের উপর হাক্কুল্লাহ বা আল্লাহর হক এবং হাক্কুল ইবাদ বা বান্দার হক বলে দুই রকম হক আদায়ের দায়িত্ব রয়েছে। মহানবী (সা.) খিদমাতে খালক এর গুরুত্ব বর্ণনা করে বলেন- তোমরা পৃথিবীবাসীর উপর দয়া প্রদর্শণ করো, তাহলে আকাশে যিনি আছেন তিনি তোমাদের উপর রহমত করবেন, (তিরমিযী ১৮৪৭)।

মানুষ সামাজিক জীব। সমাজ জীবনে মানুষ যেমন পরস্পর নির্ভরশীল, তেমনি সে সমাজের অন্যান্য প্রাণী ও জড় জগতের উপরও নির্ভরশীল। একমাত্র মানুষের প্রয়োজনেই আল্লাহ তায়ালা সবকিছু সৃষ্টি করেছেন। তাই এসবের উপর খিদমাত বা সেবা যেত্নের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। যেমন- ১. আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন: মানুষকে যেমন আল্লাহ তায়ালা ভালোবেসে সৃষ্টি করেছেন তেমনি পৃথিবীর অন্যান্য সৃষ্টিও তার ভালবাসার ফসল। যে জন্য সৃষ্টির প্রতি সদয় ব্যবহার করলে আল্লাহ সন্তুষ্ট হন। আর সৃষ্টির প্রতি নির্দয় আচরণে তিনি অসন্তুষ্ট হন। এ প্রসঙ্গে মহানবী (সা.) বলেন- সমগ্র সৃষ্টি আল্লাহর পরিজন। আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় সেই ব্যক্তি যে তার পরিজনের প্রতি বেশি অনুগ্রশীল। ২. আল্লাহর সাহায্য লাভের মাধ্যম: মহাপরাক্রমশালী আল্লাহর সাহায্য ব্যতিত পৃথিবীতে কারো পক্ষে মুহূর্তকালও বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। আর আল্লাহ ততক্ষণই বান্দাকে সাহায্য করেন যতক্ষণ সে অপরের সাহায্যে নিয়োজিত থাকে। এ সম্পর্কে মহানবী সা. বলেন- ক্ষুধার্তকে খাদ্য দাও, রুগ্ন ব্যক্তির সেবা কর ও বন্দি বা ঋণগ্রস্তকে মুক্ত কর। তাহলেই আল্লাহর সাহায্য আসবে। এ সম্পর্কে মহানবী (সা.) আরও বলেন, বান্দা যতক্ষণ তার ভাইয়ের সাহায্যে নিয়োজিত থাকে ততক্ষণ আল্লাহ তাকে সাহায্যে করেন, (মুসলিম, ৪৮৬৭)। ৩. জান্নাত লাভের মাধ্যম: খিদমাতে খালক জান্নাত লাথের পথ প্রশস্ত করে। খিদমাতে খালক সম্পন্নকারী জান্নাতে বিপুল নিয়ামাত লাভে ধন্য হবেন। মহানবী সা. বলেন- কোন মুসলিম কোন মুসলিমকে পরিধেয় দিলে, আল্লাহ তাকে জান্নাতের পোশাক পরাবেন, কেউ যদি অপর মুসলিম ভাইকে ক্ষুধার্থ অবস্থায় খাদ্য দান করে আল্লাহ তাকে জান্নাতের ফল খাওয়াবেন। আর কোন মুসলিম যদি অন্যকে তৃষ্ণার্ত অবস্থায় পানি পান করায় কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে সীলমোহরকৃত সরাব পান করাবেন, (আবু দাউদ)। ৪. সদকার সমতুল্য: খিদমাতে খালকের মাধ্যমে দান সদকার পরিমাণ সওয়াব পাওয়া যায়। মহানবী সা. বলেন- কোন মুসলিম যদি বৃক্ষ রোপণ করে বা শস্য বপন করে আর সেখান থেকে যদি কোন মানুষ বা কোন বা পাখি বা কোন জীবজন্তু কিছু ভক্ষণ করে তাহলে সে তা সে ব্যক্তির জন্য সদকায় পরিণত হবে। ৫. ক্ষমা লাভের মাধ্যম: জীবজন্তুর সেবা করলে আল্লাহ অনেক কঠিন গুণাহ মাফ করে দেন। মহানবী (সা.) বলেন- ইসরাফীল বংশের একজন পাপী রমণী একটি পিপাসার্ত কুকুরকে পানি পান করানোর ফলে আল্লাহ খুশি হয়ে তার সমস্ত অপরাধ ক্ষমা করে দেন এবং তাকে জান্নাত দান করেন। ৬. পরিবেশ ও জীবজন্তু রক্ষায়: জীবের জীবিকা ও কল্যাণের জন্যে গাছপালা, বৃক্ষলতা এবং ফল ফসলের প্রয়োজনীয়তা সীমাহীন। পরিবেশ রক্ষায় গাছপালা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ জন্যে ইসলামে গাছপালা ও ফসল জন্মানোর প্রতি গুরুত্ব দেওেয়ার পাশাপাশি তা সংরক্ষণ করতে বলা হয়েছে। এমনকি যুদ্ধাবস্থায় পর্যন্ত বৃক্ষনিধন ও শস্য বিনষ্ট করার ওপর নিষেধাজ্ঞা আছে। ৭. ঈমানের অঙ্গ: খিদমাতে খালক ঈমানের একটি অঙ্গ। মহানবী (সা.) এ সম্পর্কে বলেন- সে ব্যক্তি প্রকৃত ঈমানদার নয় যে নিজের জন্যে যা ভালবাসে তা তার ভাইয়ের জন্য পছন্দ করে না, (বুখারী, ১২)। ৮. পশু-পাখির প্রতি সদয় আচরণ: একবার এক সাহাবা (রা.) একটি পাখির ছানা নিয়ে রাসূলের (সা.) নিকট আসলে তিনি নির্দেশ দিলেন- যাও ছানাটি যেখানে ছিল সেখানে রেখে আস। এর মাধ্যমে রাসূল (সা.) পশুপাখির প্রতি সদয় আচরণের নির্দেশ দিয়েছেন। তাই খিদমাতে খালকের মাধ্যমে আল্লাহর রাসূলের নির্দেশ প্রতিপালিত হয়েছে। ৯. অর্থনৈতিক গুরুত্ব:  মহান আল্লাহ কাউকে ধনী করেছেন আবার কাউকে করেছেন নিঃস্ব। তাই ধনী ও বিত্তশালীদের দায়িত্ব হলো দরিদ্র, অসহায় ও নিঃস্বদের অর্থ দান করে খিদমাত করা। এতে অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীভূত হয়। অন্যান্য জীবজন্তুর কল্যাণ এবং সংরক্ষণেও অর্থব্যয় বিত্তশালীদের কর্তব্য। ৯. আন্তর্জাতিক গুরুত্ব: যেহেতু আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীর সবকিছু সৃষ্টি করেছেন, সেহেতু এক দেশের মানুষের সুখ, দুঃখ, বিপদ, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, মহামারি ইত্যাদিতে অন্যদেশের মানুষের সাহায্য করা উচিত। এতে একদিকে যেমন ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়, অন্য দিকে যুদ্ধ, বিগ্রহ, কূটনৈতিক জটিলতা, অর্থনৈতিক বিধি-নিষেধ ইত্যাদিরও আশঙ্কা থাকে না।

সৃষ্টির সেবায় মানুষের দায়িত্ব ও কর্তব্য: মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। সৃষ্টি জগতে অন্য সব কিছুকে মানুষের সুখ, সুবিধা ও ভোগের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। সৃষ্টির সেরা বলেই সৃষ্টি সেবার জন্যে মানুষ বিশেষভাবে দায়িত্বশীল। যেমন- ১. সবার প্রতি সদয় আচারণ করা: জড় জীব নির্বিশেষে বিশ্বের প্রতিটি বস্তু ও পদার্থ আল্লাহর সৃষ্টি। মানুষের দায়িত্ব হলো আল্লাহ তায়ালার প্রতিটি সৃষ্টির সাথে সুন্দর ও সদয় আচরণ করা। মহানবী সা. এ প্রসঙ্গে বলেছেন- সমগ্র সৃষ্টি আল্লাহর পরিজন। আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় সেই ব্যক্তি যে তার পরিজনের প্রতি বেশি অনুগ্রশীল। ২. মানুষের সেবা ও মানুষের সাহায্য করা: মানুষের দায়িত্ব হলো খিদমাতে খালকের অংশ হিসেবে তারা অপরের সেবা করবেন। প্রয়োজনে সাহায্য করবেন। রাসূল (সা.) বলেন- মুসলিম মুসলিমের ভাই। সে তার ওপর যুলম করবে না। তাকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেবে না। যে ব্যক্তি ভাইয়ের অভাবে সাহায্য করবে আল্লাহ তায়ালা তার অভাবে সাহায্য করবেন। যে ব্যক্তি কোন মুসলিমের দুঃখ কষ্ট দূর করবে আল্লাহ তায়ালা কিয়ামতের দিন তার বিপদসমূহের একটি বড় বিপদ দূর করবেন। আর যে ব্যক্তি কোন মুসলিমের দোষত্রুটি ঢেকে রাখবে কিয়ামাতের দিন আল্লাহ তায়ালা তার দোষ ত্রুটি ঢেকে রাখবেন, (বুখারী, ২২৬২)।  ৩. আত্মীয় স্বজনদের প্রতি দায়িত্ব: মাতা-পিতা, ভাই-বোন, সন্তান-সন্তুটি, স্বামী-স্ত্রী, চাচা, ফুফু, মামা, খালা প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ মানুষের আত্মীয়। খিদমাতে খালকের অংশ হিসেবে মানুষের দায়িত্ব হলো আত্মীয়দের সাথে ইহসান করা। সুন্দর, শোভন ও মমতাপূর্ণ আচরণ করা। তাদের অধিকার বুঝিয়ে দেওয়া এবং বিপদে আপদে পাশে দাঁড়ানো। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন- আর মাতাপিতার সাথে সদাচারণ কর এবং সদাচারণ কর নিকটাত্মীয়দের সাথে, (সূরা নিসা, ৩৬)। মহান আল্লাহ তায়ালা আরও বলেন- আর আত্মীয়-স্বজনকে তাদের অধিকার দিয়ে দাও, (সূরা বনী ইসরাঈল, ২৬)।  ৪. প্রতিবেশীদের প্রতি দায়িত্ব: প্রতিবেশীদের সাথে সদাচারণ মানুষের অনিবার্য দায়িত্ব। খিদমাতে খালকের আওতায় মানুষকে তার প্রতিবেশীর প্রয়োজনে এগিয়ে আসতে হবে। তার অসুস্থতা, বিপদ ও অভাবে সাহায্য ও সেবার হাত বাড়াতে হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন- আর নিকট প্রতিবেশীর সাথে সদাচারণ কর। দূর প্রতিবেশী এবং সহকর্মী প্রতিবেশীর সাথেও সদাচারণ কর, (সূরা নিসা, ৩৬) রাসূল (সা.) বলেছেন- সে ব্যক্তি মুমিন নয়- যে পেট পুরে খায়, আর তার প্রতিবেশি থাকে অনাহারে, (বায়হাকি, ৩২৩৮)। ৫. ইয়াতিমদের প্রতি দায়িত্ব: শৈশবে মাতাপিতা হারা অসহায় শিশুরা ইয়াতিম হিসেবে পরিচিত। সাধারণত তারা অসহায় ও অভিভাবকত্বহীন হয় বলে তাদের সেবার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ইয়াতিমদের সাথে সদাচারণ কর, (সূরা নিসা, ৩৬)।  ৬. অভাবগ্রস্তের প্রতি দায়িত্ব : তাদের অভাব দূর করার কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। রাসূল (সা.) বলেন- যে ব্যক্তি আমার উম্মতের কারো অভাব পূরণ করবে আল্লাহ তায়ালা তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন, (মিশকাত)।  ৭. ক্ষুধার্তকে খাদ্য দান: খাদ্য গ্রহণের অধিকার মানুষের মৌলিক অধিকার। কোন মানুষ খাবারের অভাবে পড়লে অন্য মানুষের দায়িত্ব হলো তার খাদ্য সংস্থান করা। খিদমাতে খালকের মধ্যে এটি সর্বশ্রেষ্ট ইবাদাত। আল্লাহ তায়ালা একে মুমিনদের বৈশিষ্ট্য বলে ব্যাখ্যা করেছেন। বলেছেন- আর তারা আল্লাহর ভালোবাসায় দরিদ্র ইয়াতিম ও বন্দিকে খাবার দেয়, (সূরা দাহর, ৮)।  ৮. অসুস্থের প্রতি দায়িত্ব: মুসলিমদের মানবিক, ধর্মীয় ও নৈতিক দায়িত্ব হলো অসুস্থ মানুষের সেবা করা। তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। চিকিৎসার সামর্থ্য না থাকলে এ জন্য সাহায্য করা। অসুস্থ ব্যক্তি মারা গেলে তার পরিবারকে সার্বিক সাহায্য সহযোগীতা করা।

রাসূল (সা.) বলেন- তোমরা ক্ষুধার্তকে খাদ্য দাও, অসুস্থের সেবা কর এবং বন্দিকে মুক্ত কর, (সহীহ বুখারী, ৪৯৫৪)।  ৯. বস্ত্রহীনকে বস্ত্র দান: যাদের কাপড় কেনার সামার্থ নেই তাদের কাপড় কিনে দেয়া খিদমাতে খালকের অন্তুর্ভূক্ত। নবী (সা.) বলেন- কোন মুসলিম অপর কোন মুসলিমকে কাপড়হীন অবস্থায় কাপড় দিলে আল্লাহ তাকে বেহেশতে সবুজ বর্ণের কাপড় পড়াবেন, (আবু দাউদ, ১৪৩২)।  ১০. সার্বজনীন সেবা : খিদমাতে খালকের আওতায় মানুষের দায়িত্ব হলো সেবার ক্ষেত্রে বিভেদ সৃষ্টি না রাখা। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, অঞ্চল, ধনী-নির্ধন, দুর্বল-সবল, নির্বিশেষে সেবা করতে হবে সবার। সেবার সার্বজনীন এই দৃষ্টিটি আরো ব্যাপক করে তুলতে রাসূল (সা.) নির্দেশ দিয়েছেন- তোমরা পৃথিবীবাসীর উপর দয়া প্রদর্শণ করো, তাহলে আকাশে যিনি আছেন তিনি তোমাদের উপর রহমত করবেন, (তিরমিযী ১৮৪৭)।

মহান আল্লাহ সৃষ্টিজীবের প্রতি কর্তব্যের কথা ঘোষণা করে বলেন- তোমাদের প্রতি আল্লাহ যেমন সদয় হয়েছেন, তুমি তেমনি সৃষ্টির প্রতি সদয় হও, (আল কাসাস, ৭৭)।

লেখক : প্রভাষক (আরবি), চাটখিল কামিল মাদরাসা, নোয়াখালী,

ibrahim010187@gmail.com

আমারসংবাদ/জেআই