Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪,

ঘুরে দাঁড়ানোর বাজেট আজ

এম এ আহাদ শাহীন

জুন ২, ২০২১, ০৬:০০ পিএম


ঘুরে দাঁড়ানোর বাজেট আজ
  • ছয় লাখ তিন হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বাজেট
  • বাজটে বিনিয়োগ বাড়াতে থাকছে কর ছাড়
  • নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ
  • কমবে উৎপাদনমুখী শিল্পে কাঁচামাল আমদানির কর

মহামারি করোনার মধ্যে অর্থনীতি চাঙ্গা রাখতে আজ ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বাজেট ঘোষণা করবেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল। আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য ছয় লাখ তিন হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করবেন তিনি।

অর্থনীতি চাঙ্গা থাকলে দেশে কর্মসংস্থান বাড়বে। সংস্থান হবে মানুষের জীবিকার। সে লক্ষ্যেই আসন্ন বাজেটে ব্যবসায়ীদের সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা দিয়ে ব্যবসাসহায়ক বাজেট দিতে যাচ্ছে সরকার। ব্যবসায়ীদের সুবিধা দিতেই কমানো হচ্ছে ন্যূনতম করহার। দেশে একটি ব্যবসাসহায়ক পরিবেশ তৈরিতে কমানো হচ্ছে কর্পোরেট করহার। করোনায় বিপর্যস্ত স্থানীয় শিল্প খাতকে চাঙ্গা করতে দেয়া হচ্ছে কর প্রণোদনা। কর্মসংস্থান ধরে রাখতে উৎপাদনমুখী এসব শিল্পে বিদ্যমান কর প্রণোদনা আরও তিন বছর দেয়ার প্রস্তাব করা হচ্ছে। দেশের উদীয়মান ইলেক্ট্রনিক শিল্পসহ অন্য উৎপাদনমুখী শিল্পে প্রদেয় সুবিধা বহাল রাখা হচ্ছে এই বাজেটেও। কমানো হচ্ছে সব উৎপাদনমুখী শিল্পে কাঁচামাল আমদানির ওপর আগাম কর। এভাবে স্থানীয় শিল্প স্থাপনকে উৎসাহিত করতে বাজেটে দেয়া হচ্ছে নানা কর প্রণোদনা।

কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারের এবারের বাজেটের উদ্দেশ্য হলো স্থানীয় শিল্পকে সুরক্ষা দেয়া। পাশাপাশি নানা প্রণোদনা দিয়ে দেশীয় শিল্প চাঙ্গা রাখা। সে লক্ষ্যেই সরকার বাজেটে দেশীয় শিল্প বিকাশের জন্য সর্বোচ্চ সুবিধা দিতে যাচ্ছে। করোনা মহামারির মধ্যে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতেই সরকার ব্যবসাসহায়ক বাজেট প্রণয়ন করছে। এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, দেশে ব্যবসা ও বিনিয়োগের সার্বিক পরিবেশ উন্নতি করা। এ লক্ষ্যেই বাজেটে বিশেষভাবে কমানো হচ্ছে কর্পোরেট করহার। বিশ্বব্যাংকের ব্যবসা সহজীকরণ সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান এখনো অনেক বেশি। চলতি ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৯৯তম স্থানে নামিয়ে আনার ঘোষণা করেছে সরকার। গত বছর ১৯০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দুই ধাপ অগ্রগতি হয়ে ১৬৮তম অবস্থানে পৌঁছেছে। ফলে ৯৯ অবস্থানে নামাতে হলে বাংলাদেশকে অনেক সংস্কার করতে হবে। সে লক্ষ্যেই এগোচ্ছে সরকার। এই সূচকে উন্নতির অন্যতম হাতিয়ার হচ্ছে কর্পোরেট কর। বাংলাদেশে এই কর্পোরেট কর প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় এখনো অনেক বেশি। এ জন্যই সরকার আগামী বাজেটে কর্পোরেট করহার কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে। যাতে ধাপে ধাপে কমিয়ে প্রতিযোগী দেশগুলোর সমপর্যায়ে নিয়ে আসা যায়। বাংলাদেশে বর্তমানে পাঁচটি স্তরে কর্পোরেট কর আদায় করা হয়। সর্বোচ্চ করহার ৪৫ শতাংশ এবং সর্বনিম্ন ২৫ শতাংশ। এ বাজেটে দুটি স্তরে কর্পোরেট করহার কমছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে নন-লিস্টেড কোম্পানি যা শেয়ার বাজারের অন্তর্ভুক্ত নয়। অপরটি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি। নন-লিস্টেড কোম্পানির কর্পোরেট করহার বর্তমানে সাড়ে ৩২ শতাংশ। বাজেটে এই হার কমিয়ে ৩০ শতাংশ নির্ধারণের প্রস্তাব করা হচ্ছে। অপরদিকে, শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির কর্পোরেট করহার বর্তমানে সাড়ে ২৫ শতাংশ। নতুন বাজেটে তা কমিয়ে করা হচ্ছে সাড়ে ২২ শতাংশ। অর্থাৎ উভয়ক্ষেত্রে কর্পোরেট করহার আড়াই শতাংশ কমানো হচ্ছে নতুন বাজেটে।

অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, কর্পোরেট কর কমানো হলে স্থানীয় উদ্যোক্তাদের উৎপাদন খরচ কমবে এবং তারা পুনরায় বিনিয়োগ করতে উৎসাহী হবেন। প্রতিবেশীসহ অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশে কর্পোরেট করহার বেশি থাকার কারণে ব্যবসায় খরচ বেশি হচ্ছে, প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। দেশীয় শিল্পোদ্যোক্তারাও দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ করে আসছেন বাংলাদেশে কর্পোরেট করহার অনেক বেশি। তাদের যুক্তি করহার কমালে কোম্পানির মুনাফা বেশি থাকবে। ফলে মুনাফার কিছু অংশ পুনরায় বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে। বিনিয়োগ বাড়লে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে। এতে জিডিপির প্রবৃদ্ধির গতি বাড়বে। ভারতসহ পৃথিবীর অনেক দেশে কর্পোরেট করহার কম এবং কর কাঠামো সহজ। ভারতে কর্পোরেট করহার দুটি। বড় কোম্পানির জন্য ৩০ শতাংশ এবং স্থানীয় কোম্পানির ক্ষেত্রে ২৬ শতাংশ। শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানে কর্পোরেট করহার যথাক্রমে ২৮ ও ৩০ শতাংশ। সিঙ্গাপুরে একটিমাত্র কর্পোরেট করহার এবং তা মাত্র ১৩ শতাংশ। এটা বিবেচনা করেই সরকার এবারের বাজেটে ব্যবসায়ীদের সুযোগ-সুবিধা দিতে যাচ্ছে। এনবিআরের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারের উদ্দেশ্য হচ্ছে করোনাকালীন বিপর্যস্ত অর্থনীতিকে চাঙ্গা করা। সে লক্ষ্যকে সামনে রেখে বিনিয়োগবান্ধব বাজেট করা হচ্ছে। বর্তমানে দেশের উদীয়মান শিল্প হচ্ছে ইলেক্ট্রনিক শিল্প। এ শিল্প বর্তমানে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও পণ্য রপ্তানি করছে। ফলে এ শিল্পকে সরকার আরও প্রণোদনা দিয়ে চাঙ্গা রাখতে চায়। বর্তমানে ফ্রিজ, টেলিভিশন, এয়ারকন্ডিশনসহ এসব পণ্য দেশীয় ইলেক্ট্রনিক্স শিল্প মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা পাচ্ছে, যার মেয়াদ শেষ হচ্ছে ৩০ জুন ২০২১ সালে। এসব খাতে উৎপাদিত পণ্যের বিপরীতে ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হয় না। অর্থাৎ উৎপাদনপর্যায়ে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা পাচ্ছে। বাজেটেও এ সুবিধা আরও তিন বছরের জন্য বহাল রাখার প্রস্তাব করা হচ্ছে। অর্থাৎ উৎপাদনমুখী এসব শিল্পে ভ্যাট অব্যাহতির মেয়াদ ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বাড়ানো হচ্ছে। এছাড়া, আসন্ন বাজেটে ইলেক্ট্রনিক্স খাতের আরও বেশকিছু পণ্য ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা পাচ্ছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে— রাইস কুকার, ওয়াশিং মেশিন, ওভেন, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, ব্লেন্ডার মেশিন ইত্যাদি। এসব পণ্য উৎপাদন করলে ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হবে না। আবার যারা এসব কারখানা স্থানীয়ভাবে স্থাপন করবেন, তাদের জন্য ১০ শতাংশ কর অবকাশ সুবিধা (ট্যাক্স হলিডে) দেয়ার প্রস্তাব থাকছে বাজেটে। বর্তমানে যে নতুন ভ্যাট আইন চালু আছে, তাতে আগাম কর আদায়ের নিয়ম রয়েছে। একে অ্যাডভান্সড ট্রেড ভ্যাটও বলা হয়। আমদানিপর্যায়ে প্রত্যেক পণ্যের বিপরীতে ৫ শতাংশ হারে এই কর আহরণ বাধ্যতামূলক করা হয়। তবে মাসিক ভ্যাট রিটার্ন জমার সময় আগাম কর ফেরত দেয়ার কথা উল্লেখ আছে আইনে।

ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন করতে গিয়ে দেখা যায়, আগাম কর ফেরত দেয়ার প্রক্রিয়ায় জটিলতা তৈরি হয়। পরবর্তী সময়ে এটি প্রত্যাহারের দাবি উঠে এফবিসিসিআইসহ ব্যবসায়ী মহল থেকে। কিন্তু তা না করে সরকার চলতি অর্থবছরের বাজেটে শিল্পে ব্যবহূত কাঁচামালের ওপর আগাম কর ৫ থেকে কমিয়ে ৪ শতাংশ নির্ধারণ করে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের চেয়ারম্যান ও গবেষণা সংস্থা পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ‘করোনা ভাইরাস মহামারিতে আমাদের সবকিছুই লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। জীবন-জীবিকা থেমে গেছে। বহু মানুষ কাজ হারিয়েছে। প্রতিদিন প্রাণহানি ঘটছে। এতে দেশের অর্থনীতির যে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে সেটির স্বীকৃতি দিতে হবে। গত এক বছরে করোনার প্রভাবে অর্থনীতির কোন খাতে কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, তা সরকারকে নিজস্ব উদ্যোগে যাচাই-বাছাই করতে হবে। এর আলোকে আগামী অর্থবছরের বাজেটে অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধারের পরিকল্পনা নিতে হবে। যে পরিকল্পনা নেয়া হবে তা হতে হবে বাস্তবভিত্তিক। একই সঙ্গে তা বাস্তবায়ন করতে অত্যন্ত শক্তিশালী মনিটরিং ব্যবস্থাও থাকতে হবে। তিনি বলেন, প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সুরক্ষা দিয়ে মানুষকে কাজের সুযোগ করে দিতে হবে। অনেকেই কাজ হারিয়েছেন। আবার অনেকেই নতুন করে দরিদ্র হয়ে গেছেন। করোনার কারণে দুই ধরনের দরিদ্র তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে যারা আগে থেকে দরিদ্র ছিলো, তারা আরও দরিদ্র হয়েছে। যারা আগে দারিদ্র্যসীমার বাইরে ছিলো, তাদের আয় কমে যাওয়ায় নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে। গ্রামের তুলনায় শহর এলাকায় দারিদ্র্যের হার বেশি বেড়েছে। কাজহারা ও কর্মহীনদের কাজের ব্যবস্থা করতে হবে। বাজেটে এ সংক্রান্ত সুস্পষ্ট উদ্যোগ ও ঘোষণা থাকতে হবে এবং সে উদ্যোগ বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।’

এদিকে কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মেনে জাতীয় সংসদের ত্রয়োদশ (বাজেট) অধিবেশন শুরু হয়। গতকাল বুধবার বিকেল ৫টায় স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা উপস্থিত ছিলেন। তবে বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদ অধিবেশনে যোগ দেননি। অধিবেশনে ১০০-১২০ জন এমপিকে উপস্থিত রাখার পরিকল্পনা করেছে সংসদ। আর তালিকাভুক্ত ৪৬ জন সাংবাদিক এবার বাজেট অধিবেশনে উপস্থিত থেকে সংবাদ সংগ্রহের সুযোগ পেয়েছেন। তবে গণমাধ্যমকর্মীরা সাংবাদিক লাউঞ্জ ছাড়া অন্য কোথাও ঘোরাঘুরি করতে বা যেতে পারবেন না। ২ জুন বুধবার, ৩ জুন বৃহস্পতিবার, ৬ জুন রোববার, ৭ জুন সোমবার, এরপর বিরতি দিয়ে ১৪, ১৫, ১৬, ১৭ সোম থেকে বৃহস্পতিবার, ২৮, ২৯, ৩০ সোমবার থেকে বুধবার এবং ১ জুলাই বৃহস্পতিবার সংসদের বৈঠক বসবে। গতকাল বিকেল ৫টায় অধিবেশন শুরু হওয়ার পর শোকপ্রস্তাব গ্রহণ করা হয়।

অন্যদিকে ৬ জুন রোববার কমিটির বিল সম্পর্কিত রিপোর্ট উত্থাপন (যদি থাকে), চারটি বিল উত্থাপন এবং সম্পূরক বাজেটের ওপর আলোচনা হবে। ৭ জুন সোমবার সম্পূরক বাজেটের আলোচনা ও পাস এবং নির্দিষ্টকরণ সম্পূরক বিল পাস হবে। এরপর ১৪, ১৫, ১৬, ১৬ ও ২৮ জুন মূল বাজেটের ওপর আলোচনা হবে। ২৯ জুন মূল বাজেটের সমাপনী আলোচনা এবং অর্থবিল পাস, ৩০ জুন বুধবার মূল বাজেট পাস ও নির্দিষ্টকরণ বিল পাস, ১ জুলাই বৃহস্পতিবার প্রশ্নোত্তরপর্ব, বেসরকারি বিল উত্থাপন, সরকারি বিল পাস এবং অধিবেশন সমাপ্তি হবে। এদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বক্তৃতা করবেন। বিরোধী দলের শীর্ষ নেতারাও বক্তৃতা করবেন। করোনা বাস্তবতায় সংসদের এবারের বাজেট অধিবেশন হবে সংক্ষিপ্ত।

আমারসংবাদ/জেআই