Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪,

বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগ বাড়ছে

জুন ২, ২০২১, ০৬:০০ পিএম


বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগ বাড়ছে
  • অধিকাংশ মামলাই ডিজিটাল আইনের ২৫ ও ২৯ ধারায়
  • মামলা হলেই বিচার পেতে ঢাকা আসতে হচ্ছে
  • নেই আপিল ট্রাইব্যুনাল  সংক্ষুব্ধ হলেই যেতে হচ্ছে হাইকোর্টে
  • বিচারাধীন দেড় হাজারের বেশি উপাদান না থাকায় সরাসরি খারিজ  ৩২৯টি

বাড়ছে সাইবার অপরাধ। নানা উদ্যোগের পরও নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না সাইবার অপরাধীদের। সাম্প্রতিক সময়ে ফেসবুক, টিকটক, লাইকি, ইনস্টাগ্রাম, গুগলে ভুয়া আইডি খুলে বিভিন্ন ব্যক্তির নামে মিথ্যা ও মানহানিকর তথ্য প্রচার বেড়েছে উদ্বেগজনকহারে। জুয়া, পর্নোগ্রাফি ও মানবপাচার কিছুই বাদ যাচ্ছে না। নতুন ধরনের এই অপরাধ শঙ্কার মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে। সবচেয়ে বড় আশঙ্কার বিষয়, এতে জড়িয়ে পড়ছে তরুণ কিশোর-কিশোরীরা। তবে সাইবার অপরাধীদের বিরুদ্ধে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলাও হচ্ছে নিয়মিত। ফলে মামলার সংখ্যাও দিন দিন বেড়েই চলেছে।

রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে সাইবার অপরাধ বাড়ছে ব্যাপকভাবে। কিন্তু ঢাকার বাইরে ট্রাইব্যুনাল চালু না হওয়ায় বিচার প্রার্থীদের দুর্ভোগ কমছে না। অপরাধ বাড়ার সাথে বাড়ছে দুর্ভোগও। এদিকে গত ৪ এপ্রিল ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা মামলাসহ সাইবার অপরাধ সম্পর্কিত মামলার বিচারের জন্য আট বিভাগে একটি করে সাইবার ট্রাইব্যুনাল গঠন করে প্রজ্ঞাপন জারি করে আইন মন্ত্রণালয়। তবে কাগজে কলমে ট্রাইব্যুনাল সৃষ্টির কথা বলা হলেও করোনার প্রভাব বেড়ে যাওয়ায় এখনো ট্রাইব্যুনালগুলো চালু করা সম্ভব হয়নি। নিয়োগ দেয়া হয়নি বিচারক ও সহায়ক জনবলও। তাই মামলা হলেই বিচারপ্রার্থীদের আসতে হচ্ছে ঢাকায়। ফলে বাড়ছে হয়রানি ও দুর্ভোগ। পোহাতে হচ্ছে চরম ভোগান্তিও। অপরদিকে ২০১৩ সালে সাইবার ট্রাইব্যুনালের যাত্রা শুরু হয়। তবে, সাত বছর অতিবাহিত হলেও এখনো গঠিত হয়নি সাইবার আপিল ট্রাইব্যুনাল। ফলে, সাইবার ট্রাইব্যুনালের রায় বা আদেশে কেউ সংক্ষুব্ধ হলে তার বিরুদ্ধে আপিল করতে পারছেন না বিচারপ্রার্থীরা। নানা প্রয়োজনে গঠিত ট্রাইব্যুনালগুলোর ক্ষেত্রে আপিল ট্রাইব্যুনাল থাকলেও  সাইবার ট্রাইব্যুনালের মামলায় আপিল ট্রাইব্যুনালে যাওয়ার সুযোগ না থাকায় ভরসা করতে হয় হাইকোর্টের ওপর। সেখানেও রয়েছে বিপত্তি। কারণ ফৌজদারি অপরাধের এখতিয়ারভুক্ত হাইকোর্ট বেঞ্চ সাইবার মামলার বিষয়ে শুনানি করতে চান না। যদিও হাইকোর্টের যেকোনো ক্রিমিনাল কোর্টে সাইবার আইন সংক্রান্ত মামলার শুনানির এখতিয়ার রয়েছে।

আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সারা বিশ্বে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে এ সাইবার অপরাধ। এসব মামলা নিষ্পত্তির জন্য ঢাকার বাইরে বিভাগীয় শহরে ট্রাইব্যুনাল দ্রুত চালু করা দরকার। তারা বলছেন, গ্রাম বা প্রত্যান্ত অঞ্চলে অনেকে সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়েও মামলার ভোগান্তি এড়াতে মামলা করতে চান না। মূলত মামলা হলেই বিচারের জন্য ঢাকা আসতে হয় এটাই তাদের অনিহার একমাত্র কারণ। এ জন্য ন্যায়বিচারের স্বার্থে দ্রুত সময়ের মধ্যে আট বিভাগে ট্রাইব্যুনাল গঠন করা উচিত। সেই সাথে সময়ের প্রয়োজনে সাইবার আপিল ট্রাইব্যুনালও গঠন করা উচিত বলে মত দেন বিশেষজ্ঞরা।

আইন মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানিয়েছে, করোনা ভাইরাসের কারণে বিচারক নিয়োগে বিলম্ব হচ্ছে। তবে শিগগিরই নিয়োগ সম্পন্ন করা হবে। আইনে আছে, একজন জেলা জজ পদমর্যাদাসম্পন্ন বিচারক থাকবেন এই ট্রাইব্যুনালে। জানা গেছে, জানুয়ারিতে গঠিত সাতটি সাইবার ট্রাইব্যুনাল হলো— চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেট, রংপুর ও ময়মনসিংহ। জনবল নিয়োগে ইতোমধ্যে কিছু প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এই ট্রাইব্যুনালগুলোর কাজ শুরু হলে কাউকে মামলা করার জন্য ঢাকায় আসতে হবে না। দুর্ভোগ কমবে। আদালত-সংশ্লিষ্টরা জানান, সাইবার ক্রাইমের মামলাগুলো দায়ের করার সময় তা যথাযথভাবে যাচাই-বাছাই করা হয় না। এর অধিকাংশ মামলাই ভিত্তিহীন বা ভুয়া। পূর্বশত্রুতাবশত প্রতিপক্ষকে হেনস্তা করতে এসব মামলা করা হচ্ছে। অদক্ষ তদন্ত কর্মকর্তা দিয়ে মামলা তদন্ত করা হচ্ছে। ফলে দুর্বল মামলাগুলো খারিজ হয়ে যাচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস হওয়ার দুই বছরের মধ্যে এ আইনে মামলার সংখ্যা এক হাজার ছাড়িয়েছে। মামলার হার দিনদিন বাড়ছেই। ঢাকার দুই সাইবার ট্রাইব্যুনালে ৭৩৪টি মামলা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন থানায় করা আরও ৩৩০টি মামলা বিচারের জন্য এ ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়েছে। তবে এসব মামলার মধ্যে বেশির ভাগই হয়েছে আইনটির ২৫ ও ২৯ ধারায়। মূলত রাষ্ট্র বা ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন এবং মানহানির অভিযোগে এ দুটি ধারায় মামলাগুলো হয়েছে। সাইবার ট্রাইব্যুনালের সংশ্লিষ্ট সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাইবার ট্রাইব্যুনালে নালিশি মামলা হয়েছে ৪৬৮টি। আর চলতি বছরের গত আট মাসে মামলা হয়েছে ২২০টি। অবশ্য গত ২০ মাসে উপাদান না থাকায় ৩২৯টি মামলা সরাসরি খারিজ করে দেন আদালত। বর্তমানে এ ট্রাইব্যুনালে এক হাজার ৬৯২টি মামলা বিচারাধীন, যার মধ্যে ১২টির বিচারকাজ চলছে পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে। উচ্চ আদালতের আদেশে বিচার কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে ৩১টির।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো থেকে প্রাপ্ত তথ্য বলছে, এ দুই আইনে করা বেশির ভাগ মামলা টিকছে না। ঢাকা সাইবার ট্রাইব্যুনালে গত সাত বছরে ৯৯০টির মতো মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে সাড়ে চার শর বেশি মামলা চূড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে নিষ্পত্তি হয়। এ ছাড়া অনেক মামলায় অভিযোগ গঠনের উপাদান না থাকায় আসামিরা অব্যাহতি পেয়েছেন। তথ্য-উপাত্ত বলছে, কেবল ২৫টি মামলায় রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষ্য-প্রমাণে অভিযোগ প্রমাণ করতে পেরেছে। এর ২৪টি আইসিটি আইনের ও একটি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলা। জানা যায়, তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে সংঘটিত অপরাধের মামলা নিষ্পত্তির জন্য ২০১৩ সালে ঢাকায় একটি সাইবার ট্রাইব্যুনাল হয়। সাইবার অপরাধ বেড়ে যাওয়ায় চলতি বছর জানুয়ারি মাসে সাতটি বিভাগীয় শহরে আরও সাতটি সাইবার ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। তবে এসব ট্রাইব্যুনালে গত আট মাসেও কোনো বিচারক নিয়োগ হয়নি। ফলে একজন ব্যক্তিকে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে মামলা করতে হলে ঢাকায় আসতে হচ্ছে। বিচার প্রার্থীদের ভোগান্তিও বাড়ছে। এ জন্য শিগগির এখানে বিচারক নিয়োগ করা হবে বলে জানা গেছে। সমপ্রতি সংঘবদ্ধভাবে ধর্ষণ এক নারীকে ধর্ষণ ও নির্যাতনের ঘটনায় ভারতের ব্যাঙ্গালুরু পুলিশ পাঁচ বাংলাদেশিকে গ্রেপ্তার করে। তাদের একজন এ ভি হূদয়। তিনি ‘টিকটক হূদয়’ নামে পরিচিত বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ পুলিশ। তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, টিকটক অ্যাপে কাজ করার প্রলোভন দেখিয়ে নারী পাচারের অপরাধ করে আসছিল হূদয়। তিনিসহ ভারতে আটককৃতরা বাংলাদেশ থেকে এক তরুণীকে পাচারের উদ্দেশে নিয়ে নির্যাতন করে। সেই ভিডিওটি ভাইরাল হওয়ার পরেই ভারতের পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করে। তবে মেয়েটির খোঁজ এখনো পাওয়া যায়নি। মেয়েটির বাবা ঢাকার হাতিরঝিল থানায় মামলা করার পর বাংলাদেশের পুলিশও অভিযুক্তদের ব্যাপারে সক্রিয় হয়েছে। পুলিশের দাবি, তারা টিকটক ভিডিও করার আড়ালে একটি সংঘবদ্ধ নারী পাচারকারী চক্র হিসেবে কাজ করতো। ঢাকা সাইবার ট্রাইব্যুনালের স্পেশাল পিপি নজরুল ইসলাম শামীম জানান, ‘সাইবার মামলাগুলো বিচারেও বেশ জটিলতা লক্ষ করা যায়। ২০১৩ সাল থেকে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত ১২৪টি মামলার রায় ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ সাইবার ট্রাইব্যুনাল। এরমধ্যে অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় ৩৫টি মামলায় আসামির সাজা হয়েছে। অপরাধ প্রমাণিত না হওয়ায় বাকি ৮৯টি মামলায় আসামিরা খালাস পেয়েছেন। এছাড়া, অভিযোগ গঠনের শুনানির দিনে মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন ২০০ জনেরও বেশি মামলার আসামি। এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, ‘আইসিটি আইন ও ডিজিটাল আইনের অপপ্রয়োগ হয়ে আসছে। এ জন্য বিচারপ্রার্থীদের হয়রানি কমাতে আইনের বিধান অনুসরণ করে আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠন করা উচিত। তাহলে কেউ সংক্ষুব্ধ হলে সেখানে ন্যায় বিচারের আশায় যেতে পারবেন।’

আমারসংবাদ/জেআই