Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪,

কোভিডে জোর জনস্বাস্থ্য উপেক্ষিত

মাহমুদুল হাসান

জুন ৩, ২০২১, ০৮:০০ পিএম


কোভিডে জোর জনস্বাস্থ্য উপেক্ষিত
  • জনস্বাস্থ্য কাঠামো গড়তে অর্থ ব্যয় করতে হবে —ডা. মো. মুশতাক হোসেন, সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, আইইডিসিআর
  • বরাদ্দ বাস্তবায়নে যেনো জনআকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটে —অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই-মাহবুব  সভাপতি, স্বাস্থ্য অধিকার বাংলাদেশ
  • স্বাস্থ্যের সামগ্রিক পরিবর্তনের উদ্যোগ চোখে পড়ছে না —অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ  সাবেক পরিচালক, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট

দেশের ৫০তম বাজেট উত্থাপন করা হয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে মহামারি মোকাবিলায় বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। বাজেটের অগ্রাধিকার প্রকল্পে কোভিড-১৯ মোকাবিলায় টিকাদান কর্মসূচিকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। চলতি অর্থবছরে টিকা সংগ্রহে বিশ্বব্যাংক তিন হাজার কোটি টাকা এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ৭০০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। তার সব অর্থ এখনো শেষ হয়নি। সেই সাথে টিকা ক্রয়ে বাজেটের বাইরে বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগীর কাছেও সহায়তা চাওয়া হয়েছে। তবুও নতুন বাজেটে করোনা মোকাবিলায় জরুরি চাহিদা মেটানোর জন্য আরও ১০ হাজার কোটি টাকা থোক বরাদ্দ রাখা হয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরেও কোভিড-১৯ মোকাবিলায় ১০ হাজার কোটি টাকা থোক বরাদ্দ রাখা হয়েছিল।

এদিকে দেশের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ খাতের সামগ্রিক কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা বেশি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে যেখানে ২৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল সেখানে এবার ৩২ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। নতুন বাজেটে তিন হাজার ৪৮৬ কোটি টাকা বেশি বরাদ্দ হয়েছে। সামগ্রিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার পরিবর্তনে তেমন কোনো বরাদ্দ বাড়েনি বলে অভিমত জনস্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্য অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের। তাদের ভাষ্য, প্রতিবছর বাজেটের মতো এ বছরও জনস্বাস্থ্য এবং সামগ্রিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা উপেক্ষিত রয়েছে। করোনা মোকাবিলায় বিশেষ নজর দিলেও জনস্বাস্থ্যে নজর না দিলে মহামারি মোকাবিলা আরও কঠিন হতে পারে। তবে ভিন্ন সুরও রয়েছে। কারো কারো মতে, করোনার প্রকোপে দীর্ঘদিন ধরেই দেশের অর্থনীতি ভঙ্গু পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে। তার মধ্যে যা বরাদ্দ বৃদ্ধি পেয়েছে এটাও কম নয়। তবে উচ্চাকাঙ্ক্ষার এই বাজেট বাস্তবায়নে বিশেষ নজর দিতে হবে। সীমিত সম্পদের অপচয় কিংবা দুর্নীতি যেনো সব শেষ না করে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

সরকারি তথ্যমতে, জীবন ও জীবিকার প্রাধান্য, আগামীর বাংলাদেশ প্রতিপাদ্যে ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত ছয় লাখ তিন হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বাজেটে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ খাতে ৩২ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরের সংখ্যাটি ছিলো ২৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা। নতুন বাজেটে তিন হাজার ৪৮৬ কোটি টাকা বেশি বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। স্বাস্থ্য খাতে মোট বাজেটের ৫ দশমিক চার শতাংশ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এছাড়া শুধু করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে প্রস্তাবিত বাজেটে থোক বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১০ হাজার কোটি টাকা। গত অর্থবছরও এ বরাদ্দ রাখা হয়েছিল। এছাড়াও নতুন বাজেটে সমন্বিত স্বাস্থ্য-বিজ্ঞান গবেষণা ও উন্নয়ন তহবিল থেকে করোনা ভাইরাস, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়াসহ বিভিন্ন ভাইরাসের পাশাপাশি স্বাস্থ্যসেবা ও চিকিৎসা শিক্ষার বিষয়ে গবেষণায় আগ্রহীদের জন্য স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা গবেষণা খাতে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মো. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘বাজেটে স্বাস্থ্যের জন্য বরাদ্দ বাড়ানো তো অবশ্যই দরকার। কিন্তু কথা হলো বরাদ্দের টাকাটা কোথায় খরচ হবে সেটা তো জানতে হবে। যন্ত্রপাতি কেনাকাটার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলে তো হবে না। করোনা মহামারি মোকাবিলায় জোর দিলে রোগী শনাক্ত করা, রোগীকে আইসোলেশন করা, আইসোলেশনে থাকা রোগীকে খাওয়ানো। শনাক্ত রোগীর পরিবারকে কোয়ারেন্টাইন করা ও তাদের খাওয়ানো এবং মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে উদ্বুদ্ধ করতে বেশি টাকা খরচ করতে হবে। দক্ষ ভলানটিয়ার তৈরিতে খরচ করতে হবে। যাতে করে তারা মানুষকে কোভিড বিষয়ে সচেতন করতে পারে। আইসোলেশনে সহযোগিতা করতে পারে। টিকাদান কর্মসূচিতেও যেনো তারা দক্ষতার সঙ্গে কাজ করতে পারে। এসব খাতে টাকা বরাদ্দ না দিলে করোনা সংক্রমণ কমানো যাবে না। বাংলাদেশে জনসংখ্যা অনুপাতে হাসপাতাল, তার শয্যা ও আইসিইউ শয্যায় ঘাটতি অবশ্যই আছে। সেখানে বিনিয়োগ করুক। কিন্তু রোগ প্রতিরোধে যদি একেবারেই গুরুত্ব না দেয়া হয় তাহলে মহামারি কিভাবে মোকাবিলা করা হবে। জনস্বাস্থ্য কাঠামো গড়ে তোলার জন্য শহরাঞ্চলে কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। গ্রামাঞ্চলে কমিউনিটি ক্লিনিক, স্বাস্থ্যকর্মী আছে কিন্তু বড় বড় শহরে, সিটি কর্পোরেশনে নেই। গত বাজেটেও এ বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। এই বাজেটেও তার গুরুত্ব নেই। হাসপাতালের যন্ত্রপাতি কেনাকাটা, ওষুধপত্র কেনার কোনো শেষ নেই। এগুলো লাগবে না বলছি না, অবশ্যই লাগবে। স্বাস্থ্যে যদি ১০০ টাকা খরচ হয় তাহলে জনস্বাস্থ্যে কম করে হলেও এক টাকা খরচ করতে হবে। তাহলে রোগব্যাধি মোকাবিলা করা সম্ভব হবে।’

স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের সভাপতি ও জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই-মাহবুব বলেন, ‘রিভাইস বাজেটের চেয়ে এবার কিন্তু বরাদ্দ কম রাখা হয়েছে। বাজেট জিডিপির ১ শতাংশের ওপরে। আগের মতোই ৫ দশমিক চারের ঘরে রয়েছে। সেই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। কোভিডের বিষয়ে ১০ হাজার কোটি টাকা স্পেশাল বরাদ্দ রাখা হয়েছে। ওই টাকা খরচ করে যদি সামাজিক সচেতনতা, অবকাঠামো উন্নয়ন, দক্ষ জনবল তৈরি ও নিয়োগ প্রদান করা যায় তাহলে ভবিষ্যতে আমরা মহামারি মোকাবিলায় আরও দক্ষতার পরিচয় দিতে পারবো। তিনি বলেন, বর্তমান কোভিড পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনীতি যে পরিমাণ ভঙ্গুর তাতে এর চেয়ে বেশি আশা করা যায় না। সমালোচনা করতেই পারি কিন্তু এর চেয়ে বেশি বরাদ্দ দিতে গেলে আমাদের রেভিনিউ কমে যাবে। অন্যদিকে যদি বলি, চিকিৎসা খাতে রিফর্ম করা ছাড়া উপায় নেই। যে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে এখানে যেনো জনআকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটে। এ মুহূর্তে আমরা অনেক কিছু প্রত্যাশা করতে পারি। কিন্তু বাস্তবতা খুবই কঠিন। বিপ্লবী কথা বলা যায় কিন্তু বাস্তবায়ন তো কঠিন।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেন, ‘এই বাজেটে দুইটা দিক রয়েছে। একটা হলো কোভিড সংক্রান্ত, আরেকটা হলো সাধারণ স্বাস্থ্যসেবা সংক্রান্ত। কোভিড সংক্রান্ত বিষয়ে সরকার কিছুটা গুরুত্ব দিয়েছে। থোক বরাদ্দ দিয়েছে গত বছরের মতো আরও ১০ হাজার কোটি টাকা। আর ওয়ার্ল্ড ব্যাংকসহ দুইটা সংস্থার ৮০০ মিলিয়ন ডলারের যে ঋণটা আছে, সেটা গতবছর কিছু টাকা খরচ হলেও বেশকিছু টাকা আছে। সেটাও অব্যাহত থাকবে। সামগ্রিকভাবে আমি বলবো, কোভিড ম্যানেজমেন্টের জন্য বাজেটে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। তবে বরাদ্দের টাকা যদি সঠিকভাবে খরচ করা হয় তাহলে হয়তো কোভিডের টিকাসহ সামগ্রিকভাবে কোভিড মোকাবিলায় একটা গতি আসতে পারে। অন্যদিকে আমাদের সামগ্রিক যে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সেখানে যে পরিবর্তনের কথা আমরা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছি সেখানে কিন্তু কোনো পরিবর্তনের উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। সেই পরিবর্তন কিভাবে করা যায় সেটা নিয়েও কোনো ভাবনা নেই। বরাদ্দও নেই। বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে যে সংখ্যাটা বাড়ানো হয়েছে এটা বাজেটের আকার বৃদ্ধির সাথে সাথে স্বাস্থ্যে ইনক্রিমেন্ট মাত্র। তিনি বলেন, আমাদের সামগ্রিক যে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার পরিবর্তন বা উন্নতি সেই জায়গাটাতে কিন্তু কোনো বরাদ্দ নেই। যতটুকু বেড়েছে সেটা হলো রেগুলার বাড়াটা। রেগুলার কিছু বাড়ে না। এই যে আমি বললাম ইনক্রিমেন্ট। কেউ আগে ধরুন বেতন পেতো ১০ হাজার টাকা, সে এখন এক হাজার টাকা বেশি পাবে। এই রকমই একটু স্বাস্থ্যে বরাদ্দ বেড়েছে।’

আমারসংবাদ/জেআই