Amar Sangbad
ঢাকা বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪,

ইসলামের দৃষ্টিতে বৃক্ষরোপণ ও বনায়ন

মুফতি মোহাম্মদ ইব্রাহিম খলিল

জুন ১০, ২০২১, ০৬:২৫ পিএম


ইসলামের দৃষ্টিতে বৃক্ষরোপণ ও বনায়ন

প্রকৃতি মহান আল্লাহর বিশেষ দান। পরিবেশ ও প্রতিবেশের অন্যতম নিয়ামক হলো উদ্ভিদ ও গাছপালা। গাছগাছালি, বৃক্ষতরু ও লতাগুল্ম থেকেই আসে আমাদের জীবনধারণ ও জীবন রক্ষার সব উপকরণ। রাসুল(সা.) নিজ হাতে গাছ লাগিয়েছেন, সাহাবাগণকে গাছ লাগাতে ও বাগান করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। ব্যক্তিগত ও সামাজিক বনায়নও করেছেন। রাসুল (সা.) বৃক্ষরোপণকে সদকায়ে জারিয়ার অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘মানুষ, পাখি বা পশু যখন তাদের আহার্য গ্রহণ করে, তখন তা তার (রোপণকারী) পক্ষে একটি সদকা (দান) হিসেবে পরিগণিত হয়’ (মুসলিম, ২৯০০)।

সদকায়ে জারিয়ার জন্য ছায়াদানকারী ফলবান বৃক্ষই তুলনামূলক বেশি উপকারী। তাই রাসুল (সা.) ঘোষণা করেছেন, যদি কোনো মুসলমান একটি বৃক্ষরোপণ করে অথবা কোনো শস্য উৎপাদন করে এবং তা থেকে কোনো মানুষ কিংবা পাখি অথবা পশু ভক্ষণ করে, তবে তা উৎপাদনকারীর জন্য সদকাহ (দান) স্বরূপ গণ্য হবে (বুখারি, ২৩২০)। বৃক্ষরোপণ ও পরিচর্যা করতে নির্দেশ দিয়ে মহানবী (সা.) আরো বলেন, যদি নিশ্চিতভাবে জানো যে কিয়ামত এসে গেছে, তখন হাতে যদি একটি গাছের চারা থাকে, যা রোপণ করা যায়, তবে সেই চারাটি রোপণ করবে।  একদা নবী করিম (সা.) হজরত সালমান ফারসিকে (রা.) মুক্তির জন্য তাঁর মালিকের কাছে গেলেন। মালিক মুক্তিপণ হিসেবে ১০০ খেজুর গাছ রোপণের শর্তারোপ করলে রাসুল (সা.) তাতে রাজি হলেন এবং নিজ হাতে ১০০ খেজুর গাছের চারা রোপণ করে তাঁকে মুক্ত করলেন।

ইসলামে হালাল জীবিকা উপার্জন ও জনকল্যাণমূলক বিষয় হিসেবে কৃষিকাজ তথা ফলবান বৃক্ষরোপণ ও শস্যবীজ বপনের প্রত্যক্ষ ইঙ্গিত রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা মানুষকে প্রকৃতির যতগুলো নিয়ামত দান করেছেন, তন্মধ্যে শ্রেষ্ঠতম হচ্ছে বৃক্ষরাজি। সৃষ্টিকুলের জীবন-জীবিকা ও বৃহৎ কল্যাণের জন্য গাছপালা, বৃক্ষলতা এবং মৌসুমি ফল-ফসলের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। পবিত্র কুরআনের একাধিক আয়াত থেকে তার প্রমাণ প্রতীয়মান। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন, তারা কি লক্ষ করে না, আমি উষর ভূমির ওপর পানি প্রবাহিত করে তার সাহায্যে উদগত করি শস্য, যা থেকে তাদের গবাদি পশু এবং তারা নিজেরা আহার গ্রহণ করে, (সূরা সিজদাহ, ২৭)।

আল্লাহ তায়ালা প্রাকৃতিক পরিবেশকে মানুষের সুস্থ, সুন্দর ও স্বাভাবিক বাসোপযোগী করে অত্যন্ত ভারসাম্যপূর্ণ করে সৃষ্টি করেছেন। তাই তো আমরা দেখি প্রচন্ড শীতপ্রধান অঞ্চলগুলোতে যেখানে বছরের প্রায় পুরোটা জুড়ে মাঠ, ঘাট, নদী-নালা সর্বত্রই বরফে ঢাকা থাকে, সেখানেও প্রাকৃতিক উদ্ভিদকুল সবুজের ডানা মেলে এবং বরফ আচ্ছাদিত মৎস্যকুল স্বাভাবিক জীবন পরিচালনের মাধ্যমে স্রষ্টার অপার মহিমার জানান দেয়। মূলত মহান আল্লাহ আমাদের অশেষ কল্যাণে ও উপকারের জন্য নানা প্রজাতির পশুপাখি ও জীবজন্তু সৃষ্টি করেছেন। মানুষ ও প্রাণিকুলের বেঁচে থাকার জন্য উদ্ভিদ ও গাছপালা সৃষ্টি করেছেন। আবার পানি ও বায়ুর প্রয়োজন উদ্ভিদ ও প্রাণিকুলের। অন্যদিকে পাহাড়-পর্বত রক্ষা করে প্রাকৃতিক ভারসাম্য। আর নদী-নালা, সাগর-মহাসাগর পরিবেশের অন্তর্নিহিত প্রাণপ্রবাহ অব্যাহত রাখে। তাই আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে পৃথিবীর মানুষকে প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার দিকনির্দেশনা দিয়ে ঘোষণা করেছেন- তিনিই আল্লাহ, যিনি বায়ু প্রেরণ করেন। অতঃপর তা (বায়ু) মেঘমালাকে সঞ্চালিত করে। অতঃপর তিনি (আল্লাহ) মেঘমালাকে যেভাবে ইচ্ছা আকাশে ছড়িয়ে দেন এবং তাকে (মেঘমালাকে) স্তরে স্তরে রাখেন। এরপর তুমি দেখতে পাও, তার মধ্য থেকে বারিধারা নির্গত হয়। তিনি তার বান্দাদের মধ্যে যাদের ইচ্ছা তা (বৃষ্টি) পৌঁছান, তখন তারা আনন্দিত হয়, (সুরা রোম, ৪৮)।

বৃক্ষলতা না থাকলে এ জগতে মানুষের বসবাস অসম্ভব হতো। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তিনি আসমান থেকে বারি বর্ষণ করেন, অতঃপর আমি তা দ্বারা সর্বপ্রকার উদ্ভিদের অঙ্কুর উদ্?গম করি, অনন্তর তা থেকে সবুজ পত্র উদ্?গত করি, তারপর তা থেকে ঘন সন্নিবিষ্ট শস্যদানা উৎপাদন করি এবং খর্জূরবৃক্ষে মাথি থেকে ঝুলন্ত কাঁদি বের করি আর আঙুর, জলপাই-জইতুন ও ডালিমের বাগান সৃষ্টি করি। এগুলো একটি অন্যটির সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ ও বৈসাদৃশ্যপূর্ণ। লক্ষ করো এর ফলের প্রতি, যখন তা ফলবান হয় এবং এর পরিপক্বতার প্রতিও লক্ষ করো। অবশ্যই বিশ্বাসী সমপ্রদায়ের জন্য এতে নিদর্শন রয়েছে’ (সুরা আনআম, ৯৯)। আরো ইরশাদ হয়েছে ‘তিনিই আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেন। তাতে তোমাদের জন্য রয়েছে পানীয় এবং তা থেকে জন্মায় উদ্ভিদ, যাতে তোমরা পশুচারণ করে থাকো। তিনি তোমাদের জন্য তা দিয়ে জন্মান শস্য, জইতুন, খেজুরগাছ, আঙুর ও বিভিন্ন ধরনের ফল। অবশ্যই এতে চিন্তাশীল সমপ্রদায়ের জন্য নিদর্শন রয়েছে’ (সুরা নাহল, ১০)।

প্রকৃতি মানুষ ছাড়া বাঁচতে পারে, মানুষ প্রকৃতি ছাড়া বাঁচতে পারে না। আবার প্রকৃতি মানুষ থেকে কিছুই না নিয়ে বাঁচতে পারে, মানুষ পারে না। এমনিভাবে প্রকৃতির মধ্যেও আছে রকমভেদ। প্রকৃতির প্রাণকেন্দ্র পৃথিবীর মূল সম্পদ হলো ভূমি, পানি ও পরিবেশগত বৈচিত্র্য। আর পরিবেশ বৈচিত্র্যের অন্যতম কারিগর উদ্ভিদ। পৃথিবীর মোট উদ্ভিদ প্রজাতির ভেতরকার ২৫ ভাগই বৃক্ষ। আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশ অমূল্য বৃক্ষ ছাড়া কল্পনা করা অবান্তর। তাই ইসলাম এই প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণ ও বৃক্ষরোপণে জনসচেতনতা তৈরিতে কালজয়ী নির্দেশনা প্রদান করেছে।

মানবসভ্যতার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গের নাম আগুন। আর আগুনের অন্যতম উৎস বৃক্ষ। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যিনি তোমাদের জন্য সবুজ বৃক্ষ থেকে অগ্নি উৎপাদন করে দিয়েছেন, সে মতে তোমরা তা থেকে আগুন জ্বালিয়ে নিতে পারো’ (সুরা ইয়াসিন, ৮০)। অন্য আয়াতে এসেছে- ‘তোমরা যে অগ্নি প্রজ্বলিত করো, তা লক্ষ করে দেখছ কি? তোমরাই কি অগ্নি উৎপাদন বৃক্ষ সৃষ্টি করো, না আমি? আমি একে করেছি নিদর্শন এবং মরুচারীদের প্রয়োজনীয় বস্ত্র’ (সুরা ওয়াকিয়া, ৭১)।

উদ্ভিদ ও বৃক্ষ থেকে আমরা খাদ্য পাই। আল্লহ তায়ালা বলেন, ‘মানুষ তার খাদ্যের প্রতি লক্ষ করুক। আমিই প্রচুর বারি বর্ষণ করি, অতঃপর আমি ভূমিকে প্রকৃষ্টরূপে বিচূর্ণ করি এবং আমি উৎপন্ন করি শস্য, আঙুর, শাকসবজি, জইতুন, খেজুর এবং বহু বৃক্ষবিশিষ্ট উদ্যান, ফল ও গবাদিপশুর খাদ্য, এটা তোমাদের এবং তোমাদের পশুগুলোর জীবনধারণের জন্য’ (সুরা আবাসা, ২৪-৩২)। অন্য আয়াতে এসেছে- ‘তারা কি লক্ষ করে না, আমি ঊষর ভূমিতে পানি প্রবাহিত করে তার সাহায্যে উদ্?গত করি শস্য, যা থেকে তাদের গবাদিপশু এবং তারা নিজেরা আহার করে। তারা কি দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হবে না?’ (সুরা সেজদা, ২৭)।

পরিবেশের স্বাভাবিক ভারসাম্য রক্ষায় ও দূষণমুক্ত পরিবেশ তৈরিতে বৃক্ষ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শুধু পরিবেশ রক্ষার জন্যই নয়; বরং ধর্মীয় কারণেও মানুষকে বৃক্ষরোপণ করতে হবে। মানবদরদি রাসুল হযরত মুহাম্মদ (সা.) পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বৃক্ষরোপণ ও তা পরিচর্যার কথা উল্লেখ করে গেছেন। আর পরিবেশ সংরক্ষণে মানুষের সর্বপ্রধান দায়িত্ব হলো, দূষণের যথার্থ কারণ চিহ্নিত করে তা রোধকল্পে কার্যকরী ও বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ করা। আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো বায়ু, পানি, বৃক্ষরাজি ও পাহাড়-পর্বত ইত্যাদি। প্রাকৃতিক পরিবেশের উল্লিখিত উপকরণগুলোর মধ্যে নির্মল বায়ু ও সুপেয় পানিপ্রাপ্তি সব সৃষ্টজীবেরই প্রত্যাশিত। বিশেষ করে মানুষের জন্যই এই পরিবেশের এত বিশাল আয়োজন। আর বিশ্বব্যাপী মানুষই শিল্পায়ন ও নগরায়ণের আড়ালে প্রাকৃতিক পরিবেশ তুলনামূলক নষ্ট করছে বেশি। শিল্পায়নের যুগে কল-কারখানার নির্গত কালো ধোঁয়া একদিকে যেমন বাতাসে অক্সিজেনের মাত্রা কমিয়ে কার্বন ডাই-অক্সাইডের মাত্রা বাড়িয়ে জীবনকে করে তুলছে দুর্বিষহ। অন্যদিকে কতেক কল-কারখানার নির্গত শিল্পবর্জ্য পানিতে মিশে পানিকে করছে দূষিত, যা মানুষের স্বাস্থ্য, পরিবেশ ও মৎস্য প্রজাতির জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। এ প্রসঙ্গে বিশ্ববিখ্যাত চিকিৎসাবিজ্ঞানী আবু আলী ইবন সিনার উক্তিটি প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, পৃথিবীর এত ধূলি, ধোঁয়া ও গ্যাস যদি মানুষের ফুসফুসে না ঢুকত, তাহলে মানুষ হাজার বছর ধরে সুস্থ অবস্থায় জীবিত থাকত। এমনিভাবে নগরায়ণ ও শিল্পায়নের প্রভাবে প্রকৃতির নৈসর্গিক সৌন্দর্য পাহাড়-পর্বত বিরান ভূমিতে এবং বনভূমি প্রতিনিয়ত উজাড় হচ্ছে। মূলত মানুষ অবিবেচকের মতো বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদের অপব্যবহার পরিবেশগত বিপর্যয়কে আরো বেশি ত্বরান্বিত করেছে। তা ছাড়া পরিবেশবাদীরা বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা চিহ্নিত করতে গিয়ে প্রথমেই প্রাকৃতিক পরিবেশের দূষণকেই দায়ী করছেন। এ ক্ষেত্রে পরিকল্পিত নগরায়ণ এবং পরিবেশবান্ধব শিল্পায়নই পারে আমাদের প্রাণসত্তার লীলাভূমি প্রাকৃতিক পরিবেশ সুরক্ষিত রাখতে। আর বাংলাদেশ ভৌগোলিকভাবে ছোট আয়তনের একটি দেশ হয়েও প্রাণবৈচিত্র্য এবং ভিন্ন রকম পরিবেশ ও জটিল বাস্তুসংস্থানে ভরপুর এক অনন্য পরিসর। কিন্তু দিন দিন দেশের এই বৈচিত্র্যময় প্রাণ ও পরিসর নিশ্চিহ্ন হয়ে এক সংকটময় পরিস্থিতি তৈরি করছে।

গাছবিহীন আমরা এক মুহূর্তও কল্পনা করতে পারি না। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শাস্ত্র-পুরাণ, নীতিকথা, বাণিজ্য, দর্শন, শিল্প-সংস্কৃতি, আশ্রয়-প্রশান্তি এবং যাপিত জীবনের সব কিছুই গাছকে ঘিরে ও গাছকে নিয়ে। গাছ নিধন হলে গাছ শুধু একাই মরে না। মানুষসহ সব প্রাণসত্তার জন্যই তা ঝুঁকি ও উৎকণ্ঠার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিনা প্রয়োজনে গাছ কাটার শাস্তি সম্পর্কে হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি বিনা প্রয়োজনে গাছ কাটবে আল্লাহ তায়ালা তার মাথা আগুনের মধ্যে নিক্ষেপ করবেন’ (বায়হাকি, ৬/১৪০)। একটি পূর্ণবয়স্ক বৃক্ষ বছরে যে পরিমাণ অক্সিজেন সরবরাহ করে, তা কমপক্ষে ১০ জন পূর্ণবয়স্ক মানুষের বার্ষিক অক্সিজেনের চাহিদা মেটায়।

লেখক : প্রভাষক (আরবি), চাটখিল কামিল মাদরাসা, নোয়াখালী, ibrahim010187@gmail.com

আমারসংবাদ/জেআই