Amar Sangbad
ঢাকা বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪,

চরম খেসারতের পথে দেশ

জুন ১২, ২০২১, ০৬:০০ পিএম


চরম খেসারতের পথে দেশ
  • প্রয়োজনীয় সময়ে টিকা নেই
  • এখনো সীমান্ত দিয়ে ঢুকছে মানুষ
  • ভয়ঙ্কর ঝুঁকির সময়ে দেশে নির্বাচন নিয়ে চিন্তিত স্বাস্থ্যবিদরা
  • জেলায় জেলায় অক্সিজেন ও শয্যা সংকট চরমে
  • ২২ জেলায় সংক্রমণ ও শনাক্তের হার ২০ শতাংশের বেশি
  • ১৫টি লক্ষ্যে ঘনবসতির রোহিঙ্গাদেরও জরুরি টিকা দেয়া প্রয়োজন
  • শিক্ষাব্যবস্থা রক্ষায় শিক্ষার্থীদেরও টিকা আবশ্যক

চরম খেসারত দেয়ার পথে বাংলাদেশ! প্রয়োজনীয় সময়ে টিকা নেই। এখনো সীমান্ত দিয়ে ঢুকছে মানুষ। পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। সীমান্তবর্তী এলাকাতে সংক্রমণের উচ্চহার। ভয়ঙ্কর ঝুঁকির সময়ে দেশে নির্বাচনও দিচ্ছে সরকার। চিন্তিত স্বাস্থ্যবিদরা।

জেলা শহরগুলোতে অক্সিজেন ও শয্যা সংকট চরমে। স্থানীয়ভাবে সীমিত জনবলে চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসক ও নার্সরা। পরামর্শ ও প্রস্তাবনার আলোকেও সীমান্ত সম্পূর্ণভাবে সিলগালা করা হচ্ছে না।  সীমান্ত এলাকার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে র‌্যাপিড অ্যান্টিজেন পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হচ্ছে না। অক্সিজেন সিলিন্ডার, অক্সিজেন মাস্ক ও হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা নিশ্চিত করতে জরুরি পদক্ষেপেরও ঘাটতির অভিযোগ উঠেছে। সরকারের পরিকল্পনার আলোকে এখনো ১২ কোটি লোক টিকার বাইরে। সীমান্ত এলাকায় চোরাপথে যাওয়া-আসা কঠোরভাবে বন্ধ করা যাচ্ছে না। অন্যদিকে সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে জরুরি টিকাদান কার্যক্রম চালানোর মত দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। এ ছাড়া প্রায় ১৫টি লক্ষ্যে ঘনবসতিপূর্ণ রোহিঙ্গাদেরও জরুরি টিকা দেয়া প্রয়োজন। বিপর্যস্ত শিক্ষাব্যবস্থা থেকে জাতিকে আলোর পথে আনতে শিক্ষার্থীদেরও টিকা দেয়া আবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২২টি জেলায় সংক্রমণ ও শনাক্তের হার ২০ শতাংশের বেশি। শুধু নড়াইলেই শনাক্তের হার ৬০ দশমিক ৯৬ শতাংশ। রাজশাহীতে দু’সপ্তাহে ১১২ জনের মৃত্যু; শনাক্তের হার ৩৯.৭ শতাংশ। হটস্পটের পথে খুলনা। ফুলবাড়ী দিয়ে ঢুকছে ভারতীয় নাগরিকরা। যশোরে উদ্বেগজনক রোগী-ভর্তিশয্যার দ্বিগুণ। সিলেটে আক্রান্ত ছাড়ালো সাড়ে ২৩ হাজার। সাতক্ষীরায় শনাক্তে হার ৫৩ শতাংশ, ২১১ জনের পরীক্ষায় আক্রান্ত ১১১। বাগেরহাটে কেউ মানছেন না লকডাউন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত এক সপ্তাহে ২২টি জেলায় করোনার সংক্রমণ শনাক্তের হার ২০ শতাংশের বেশি। এসব জেলা হচ্ছে— নড়াইল, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, যশোর, ঠাকুরগাঁও, চুয়াডাঙ্গা, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, খুলনা, পিরোজপুর, মেহেরপুর, টাঙ্গাইল, ঝিনাইদহ, জয়পুরহাট, পঞ্চগড়, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নোয়াখালী, নাটোর, ফরিদপুর, কুষ্টিয়া ও দিনাজপুর। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি শনাক্তের হার নড়াইলে— ৬০ দশমিক ৯৬ শতাংশ। এই জেলা সীমান্তবর্তী নয়। সংক্রমণ শনাক্তের হারে দ্বিতীয় সীমান্তবর্তী সাতক্ষীরা জেলা। সেখানে শনাক্তের হার ৫৩ দশমিক ১৮ শতাংশ। গত এক সপ্তাহে তিন শতাধিক রোগী শনাক্ত হয়েছে ১৪ জেলায়। সেগুলোর মধ্যে আটটি জেলা— রাজশাহী, যশোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, সাতক্ষীরা, নওগাঁ, সিলেট, জয়পুরহাট ও সীমান্তবর্তী কুষ্টিয়া। রাজশাহী ও খুলনা বিভাগের অধিকাংশ সীমান্তবর্তী জেলায় সংক্রমণের হার ২৪ থেকে ৬০ শতাংশের মধ্যে। এর মধ্যে বাগেরহাটে ৪২, যশোরে ৩৯, ঠাকুরগাঁও ৩৭, চুয়াডাঙ্গা ৩৪ ও কুড়িগ্রামে ৩৩ শতাংশ ছিলো শনাক্তের হার।

দেশে করোনা ভাইরাসে মৃত্যু ১৩ হাজার ছাড়িয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা থেকে গতকাল শুক্রবার সকাল ৮টা পর্যন্ত করোনায় আরও ৪৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে দেশে করোনায় মৃত্যু হয়েছে ১৩ হাজার ৩২ জনের। সর্বশেষ এক হাজার জনের মৃত্যু হয়েছে ৩১ দিনে। গত ২৪ ঘণ্টায় দুই হাজার ৪৫৪ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে। সব মিলিয়ে দেশে এ পর্যন্ত শনাক্ত রোগীর সংখ্যা মোট আট লাখ ২২ হাজার ৮৪৯ জনে দাঁড়িয়েছে। আর এ পর্যন্ত সুস্থ হয়েছেন সাত লাখ ৬১ হাজার ৯১৬ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় ১৮ হাজার ৫৩৫ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার ১৩ দশমিক ২৪ শতাংশ।

এদিকে ভারতীয় ধরনের সংক্রমণ বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকার জেলাগুলোয় ছড়িয়ে পড়েছে। যশোর, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে এ পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। সীমান্তের কোথাও কোথাও দৈনিক শনাক্তের হার ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত উঠে যাচ্ছে। অর্ধেকের বেশি জেলা শহরে করোনা ভাইরাস ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। সম্প্রতি আইইডিসিআরের এক তথ্যে বলা হচ্ছে, সংক্রমণের ৮০ শতাংশই ভারতীয়  ভ্যারিয়েন্ট। সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে নানা বিধি-নিষেধ ও লকডাউন আরোপ করছে স্থানীয় প্রশাসন। হাসপাতালগুলোয় অক্সিজেনের সংকটের সঙ্গে শয্যা সংকট রয়েই গেছে। অন্যদিকে দেশে মৃত্যুও বেড়েছে। দুই সপ্তাহ ধরে দৈনিক মৃত্যু ৩০-৪০ জনের ওপরেই চলে গেছে। সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির এ বাস্তবতায় প্রায় দেড় মাস ধরে গণটিকা কার্যক্রমও বন্ধ রয়েছে। সাড়ে ১৪ লাখ মানুষের জন্য অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার দ্বিতীয় ডোজ নিশ্চিত করতে হিমশিম খাচ্ছে সরকার। রাজধানীতে ৪৭টি কেন্দ্রের ২৮টি এবং ৪২টি জেলায় বন্ধ রয়েছে টিকাদান কার্যক্রম। সরকারিভাবে জানা যাচ্ছে— চীন, রাশিয়ার কাছ থেকে টিকা কেনা এবং কোভ্যাক্স থেকে টিকা পাওয়ার অপেক্ষায় আছে বাংলাদেশ। এ অবস্থায় গণটিকা কার্যক্রম আবার কবে শুরু করা যাবে এখনো নিশ্চিত করে বলতে পারছে না স্বাস্থ্য বিভাগ। জেলায় ইতোমধ্যে কমিউনিটি পর্যায়ে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতি রয়েছে। গত বছরের অক্টোবরে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট প্রথম শনাক্ত হয়। এটি ভাইরাসের আগের স্ট্রেইনের চেয়ে অনেক বেশি সংক্রামক। গবেষকরা জানান, ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট একজনের মাধ্যমে ৪০০ জনকে আক্রান্ত করার ক্ষমতা রাখে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই ভ্যারিয়েন্টটিকে ‘উদ্বেগের ভ্যারিয়েন্ট’ বলে অভিহিত করেছেন।

রাজশাহীতে দু’সপ্তাহে ১১২ জনের মৃত্যু; শনাক্তের হার ৩৯ .৭ শতাংশ : রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিটে গত ২৪ ঘণ্টায় আরও চারজনের মৃত্যু হয়েছে। গতকাল বেলা ১১টায় হাসপাতালের পরিচালক বিগ্রেডিয়ার শামীম ইয়াজদানী এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানান, মৃত চারজনের মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জের একজন রোগী করোনা ভাইরাস পজেটিভ ছিলেন। বাকিদের উপসর্গ ছিলো। তাদের বাড়ি রাজশাহী। এ নিয়ে গত ১২ দিনে (১ জুন সকাল ৬টা থেকে ১২ জুন সকাল ৬টা পর্যন্ত) রাজশাহী হাসপাতালের করোনা ইউনিটে ১১২ জন মারা গেলেন। এর মধ্যে ৬৪ জনের করোনা ভাইরাস শনাক্ত হয়েছিল, বাকিদের উপসর্গ ছিলো। পরিচালক বলেন, ‘গত ২৪ ঘণ্টায় তাদের হাসপাতালে নতুন রোগী ভর্তি হয়েছেন ২৫ জন। ২৭১ বেডের বিপরীতে রোগী ভর্তি আছেন ২৮৯ জন। অতিরিক্ত রোগীদের বিকল্পভাবে বেড বাড়িয়ে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। নতুন ভর্তি রোগীদের মধ্যে রাজশাহীর ১৪ জন, চাঁপাইয়ের আটজন, নাটোরের দুইজন ও পাবনার একজন রয়েছেন। ভর্তি ২৮৯ জনের মধ্যে রাজশাহীর ১২২, চাঁপাইয়ের ১২০, নাটোরের ১৪, নওগাঁর ২৪, পাবনার পাঁচ ও কুষ্টিয়ার একজন। আর হাসপাতালের আইসিইউতে আছেন ১৮ জন।’ এদিকে রাজশাহীতে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের বেড়েছে বলে জানিয়ে শামীম ইয়াজদানী বলেন, ‘গত ২৪ ঘণ্টায় (শুক্রবার রাতে) রাজশাহীর দুটি পিসিআর ল্যাবে ৩৬৬ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এতে শনাক্ত হয়েছে ১৪৩ জনের। শনাক্তের হার ৩৯ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ। এর আগে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছিল শনাক্ত রোগীর সংখ্যায় ঢাকাকে ছাড়িয়েছে রাজশাহী। 

হটস্পটের পথে  খুলনা : খুলনা বিভাগের ছয়টি জেলার সঙ্গে ভারতের ২৮৪ কিলোমিটার সীমান্ত থাকায় এই বিভাগের বাসিন্দারা করোনা ভাইরাসের ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত হওয়ার বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। যথাযথভাবে নিয়ম না মেনেই অনেকে অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে যাচ্ছে এবং ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইন এড়াতে অবৈধভাবে দেশে ফিরছে। এ ছাড়াও, ভারতে আটকা পড়া বেশির ভাগ মানুষ যশোরের বেনাপোল ও চুয়াডাঙ্গার দর্শনা হয়ে দেশে ফিরছেন। বাংলাদেশে ভারতের দ্রুত সংক্রামক ভ্যারিয়েন্টের প্রবেশ ঠেকাতে সরকার ২৬ এপ্রিল প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে সীমান্ত বন্ধ করে দেয়। তারপর থেকে যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে বিপুল সংখ্যক মানুষ বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও যশোরের ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে গুরুতর কোভিড-১৯ রোগীদের জন্য সেন্ট্রাল অক্সিজেন ব্যবস্থা নেই। হাসপাতালটিতে বর্তমানে ২৬৫টি ছোট ও বড় অক্সিজেন সিলিন্ডার রয়েছে। প্রতিটি সিলিন্ডার এক ঘণ্টা পর্যন্ত অক্সিজেন সরবরাহ করতে পারে বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা ডা. আরিফ আহমেদ।

ফুলবাড়ী দিয়ে ঢুকছে ভারতীয়রা : ফুলবাড়ী উপজেলার প্রায় ৩৬ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত এলাকায় ছোট-বড় প্রায় ১৫টি হাট-বাজার রয়েছে। বিজিবির চোখ ফাঁকি দিয়ে সীমান্তবর্তী হাটবাজারসহ বাংলাদেশের গ্রামগুলোতে অবাধে যাতায়াত করছে ভারতীয়রা। ফলে দু’রাষ্ট্রের নাগরিকরা অবাধে চলাফেরা করায় কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ীতে বাড়ছে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণের শঙ্কা। ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা নিয়ে কুড়িগ্রাম সিভিল সার্জন ডা. হাবিবুর রহমান বলেন, ‘সীমান্ত উপজেলা হওয়ায় এখানে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তবে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট কিংবা করোনা সংক্রমণ রোধে স্বাস্থ্য বিভাগ, জেলা প্রশাসন, বিজিবি, পুলিশ প্রশাসন সক্রিয়ভাবে কাজ করছে।’ সিলেটে আক্রান্ত ছাড়ালো সাড়ে ২৩ হাজার : সিলেটে করোনা আক্রান্ত হয়ে শেষ ২৪ ঘণ্টায় আরও দুইজনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে বিভাগে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ালো ৪৩০ জনে। একই সময়ে সিলেট বিভাগে করোনা ভাইরাস শনাক্ত করা হয়েছে আরও ৪৬ জনের শরীরে।  গতকাল সকালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সিলেট বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) ডা. সুলতানা রাজিয়া স্বাক্ষরিত কোভিড-১৯ কোয়ারেন্টাইন ও আইসোলেশনের দৈনিক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে। প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, শেষ ২৪ ঘণ্টায় সিলেট বিভাগের চার জেলা মিলে আরও ৪৬ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। এদের নিয়ে সিলেট বিভাগে মোট করোনা প্রমাণিত রোগীর সংখ্যা দাঁড়ালো ২৩ হাজার ৫৩৫ জন। যাদের মধ্যে সিলেট জেলায় ১৫ হাজার ৫১৬ জন, সুনামগঞ্জে দুই হাজার ৮৫৬ জন, হবিগঞ্জ জেলায় দুই হাজার ৫৪১ জন ও মৌলভীবাজারে দুই হাজার ৬২২ জন। আর নতুন করে শনাক্ত হওয়া ৪৬ জনের মধ্যে ৪৪ জনই সিলেট জেলার বাসিন্দা। এ ছাড়া বিভাগের সুনামগঞ্জে দুইজন রোগী শনাক্ত হয়েছেন। সিলেট বিভাগে শেষ ২৪ ঘণ্টায় করোনায় প্রাণ হারানো দুজনই সিলেট জেলার বাসিন্দা। এ নিয়ে বিভাগে মৃত্যুবরণ করা মোট রোগীর সংখ্যা ৪৩০ জন। এর মধ্যে সিলেট জেলার ৩৫১ জন, সুনামগঞ্জে ৩০ জন, হবিগঞ্জে ১৮ জন এবং মৌলভীবাজারের ৩১ জন। এদিকে সিলেটের চার জেলা মিলে ২২৯ জন করোনা আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। যাদের ২০৪ জনই সিলেট জেলার বিভিন্ন হাসপাতালে, সুনামগঞ্জে একজন, হবিগঞ্জে পাঁচজন ও মৌলভীবাজারে ১৯ জন চিকিৎসা নিচ্ছেন। এ ছাড়া গত ২৪ ঘণ্টায় সিলেট বিভাগে ৩৩ জনকে নতুন করে কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হয়েছে। যাদের সবাইকে সিলেট জেলায় রাখা হয়েছে।

যশোরে উদ্বেগজনক রোগী, ভর্তি শয্যার দ্বিগুণ : যশোরে করোনা শনাক্তের হার উদ্বেগজনক। গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে ৩৫ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে।  শনাক্তের হার ২৭ শতাংশ। মারা গেছেন তিনজন। এ ছাড়া যশোর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৬৪ রোগী ভর্তি রয়েছেন। এদিকে করোনা সংক্রমণ রোধে যশোর পৌরসভা ও নওয়াপাড়া পৌরসভায় ঘোষিত লকডাউন কার্যকর করতে অভিযান অব্যাহত রেখেছে প্রশাসন। গত ১৬ দিন ধরে যশোরের করোনা শনাক্তের হার উদ্বেগজনক। গত ২৪ ঘণ্টায় ১৩৩ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ৩৫ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে।  যশোর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন তিনজন। এর মধ্যে একজন করোনা ডেডিকেটেড ইউনিটে এবং অপর দুইজন আইসোলেশন ওয়ার্ডে ভর্তি ছিলেন। যশোর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মো. আখতারুজ্জামান জানান, রোগী ভর্তির চাপ বেড়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় করোনার উপসর্গ নিয়ে রেকর্ড সংখ্যক রোগী ভর্তি হয়েছেন। যা নির্ধারিত শয্যা সংখ্যার দ্বিগুণ। বর্তমানে করোনা ডেডিকেটেড ইউনিটে ভর্তি রয়েছেন ৬৪ জন ও আইসোলেশন ওয়ার্ডে রয়েছেন ৪২ জন।

সাতক্ষীরায় শনাক্তে হার ৫৩ শতাংশ, ২১১ জনের পরীক্ষায় আক্রান্ত ১১১ : সাতক্ষীরায় একদিনে ২১১টি নমুনা পরীক্ষায় ১১১ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। শতকরা হারে যা ৫৩ শতাংশ। এর আগের দিন শনাক্তর হার ছিলো ৫০ শতাংশ। আর গত ২৪ ঘণ্টায় দুইজন করোনা আক্রান্ত হয়ে এবং পাঁচজন উপসর্গে মারা গেছেন। গতকাল সাতক্ষীরা মেডিকেল হাসপাতাল জানিয়েছে, করোনায় এ পর্যন্ত জেলায় মারা গেছেন ৫০ জন। আর উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন ২৪৪ জন। এদিকে জেলায় মোট করোনা আক্রান্তের সংখ্যা দুই হাজার ২৫৬ জন। জেলায় বর্তমানে করোনা আক্রান্ত রয়েছেন ৬৪৭ জন। দুই সরকারি হাসপাতালে করোনায় আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ৫৯ জন। শয্যা সংকট না থাকলেও জনবল সংকট রয়েছে ব্যাপক। সীমিত জনবলে চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসক ও সেবিকারা। সামেক হাসপাতালের নার্সিং সুপারভাইজার অপর্ণা রানী পাল জানান, জেলায় করোনা রোগী বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু সীমিত জনবলে আমরা হিমশিম খাচ্ছি। ১৬৫ জন নার্স থাকার কথা থাকলেও আছে ১৫০ জন। বর্তমানে ডিউটি করছেন ৯৫ জন। তাদের মধ্যে ৯জন করোনা পজেটিভ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। অচিরেই নার্স নিয়োগ না দিলে স্বাস্থ্যসেবা দেয়া কঠিন হয়ে পড়বে বলে মনে করেন তিনি। সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. কুদরত-ই-খুদা বলেন, ৫৮ জন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও রয়েছেন ৩১ জন। তার মধ্যে অনেকেই অসুস্থ।

বাগেরহাটে কেউ মানছেন না লকডাউন : বাগেরহাটে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে নারীসহ চারজনের মৃত্যু হয়েছে। বাগেরহাটের সিভিল সার্জন ডা. কে এম হুমায়ুন কবির জানান, করোনা ভাইরাসের প্রথম ও দ্বিতীয় ঢেউ মিলে এ পর্যন্ত মোট ৫৫ জনের মৃত্যু হলো। মৃত চারজনের মধ্যে বাগেরহাট সদরের একজন, মোংলা উপজেলার দুইজন এবং মোরেলগঞ্জের একজন। এদিকে গত ২৪ ঘণ্টায় জেলায় নমুনা পরীক্ষায় নতুন করে আরও ছয়জনের শরীরে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়েছে। হুমায়ুন কবির বলেন, ‘খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আরটি পিসিআর ল্যাবে ২১টি নমুনা পরীক্ষায় তাদের করোনা ভাইরাস শনাক্ত হয়। জেলায় সংক্রমণের হার ৩০ শতাংশের কম। ‘তবে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা জেলার মোংলা উপজেলায় সরকারি ছুটির দিন শুক্রবার র্যাপিড অ্যান্টিজেন পরীক্ষা হয়নি।’ এদিকে মোংলা উপজেলায় প্রশাসনের আরোপ করা কঠোর বিধিনিষেধ ঢিলেঢালাভাবে চলছে। মোংলা পৌরসভা এলাকায় দোকানপাট বন্ধ থাকলেও সাধারণ মানুষ নানা অজুহাতে বাইরে ঘোরাফেরা করছে। ভ্যাকসিন বিশেষজ্ঞ এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া) সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক মনে করেন, টিকা জোগাড় করাই এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আমরা যদি ধরে নেই যে, ৭০ শতাংশ লোককে আমরা টিকা দেবো। তাহলে এখন বাংলাদেশকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ২৫ কোটি ডোজ টিকা জোগাড় করতে হবে। তিনি বলেন, ২৫ কোটি ডোজ পাওয়া সহজ কথা নয়। আবার যদি বুস্টার ডোজ লাগে তাহলে আরো সাড়ে ১২ কোটি ডোজ লাগবে। তার মানে আমাদের ৪০ কোটি ডোজ টিকার একটা মজুত রাখতে হবে বা সম্ভাবনা রাখতে হবে। এটা তখনই সম্ভব যখন আমরা নিজে টিকা তৈরি করতে পারবো। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, ‘সীমান্তবর্তী বেশ কিছু এলাকায় লকডাউন চলছে। প্রথমেই সেই লকডাউনটা কার্যকর করতে হবে। কারণ, যেভাবেই হোক আমাদের সংক্রমণ ঠেকাতে হবে। হাসপাতালে শয্যা-আইসিইউর সংখ্যা বাড়ালেও রোগী যদি কমানো না যায়, তাহলে তো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে না। এ জন্য প্রতিকার ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা সবচেয়ে জরুরি। এর জন্য স্থানীয় জনগণকে অবশ্যই স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। যেখানে যেখানে লকডাউন চলছে, সেটা কঠোরভাবে মানানোর ব্যবস্থা করতে হবে। এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের মাধ্যমে জনগণকে সচেতন ও সম্পৃক্ত করতে হবে। কেউই একা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। প্রশাসনসহ সবাইকে এর জন্য কাজ করতে হবে।’

করোনা ভাইরাসজনিত রোগ কোভিড-১৯ মোকাবিলায় জাতীয় কারিগরি উপদেষ্টা কমিটির সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজির অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোর দিকে আমাদের আরো নজর রাখা উচিত ছিলো। বিশেষ করে যখন পাশের দেশে ব্যাপকভাবে সংক্রমণ বেড়ে যায় তখনই আমাদের দেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় যদি ব্যাপকভাবে টিকা দেয়া যেত তবে হয়তো এখন ওই সব এলাকায় এমন সংক্রমণ না-ও হতে পারতো। তবে এখনো পরিস্থিতি অনুসারে উচ্চহারে সংক্রমিত সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে নন-কোভিড মানুষের মধ্যে গণটিকা দেয়া যায়। এ জন্য ব্যাপকভাবে পরীক্ষা করে যাদের রেজাল্ট নেগেটিভ আসবে, তাদের টিকাদানে অগ্রাধিকার দিলে সেখানে যেমন সংক্রমণ ও মৃত্যু কমবে, তেমনি ওই এলাকা থেকে অন্য এলাকায় সংক্রমণ ছড়ানোর ঝুঁকিও কমে আসবে।’

আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরীন বলেন, ‘সতর্কতা এখন আরও বাড়ানো দরকার। যেকোনো ভ্যারিয়েন্টের থেকে এটা ছড়ানোর ক্ষমতা বেশি। সে ক্ষেত্রে আমাদের আরও বেশি সাবধানতাটা অবলম্বন করতে হবে। আমরা কিন্তু সে ধরনের সচেতনতা কারো মধ্যে দেখছি না সেভাবে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল ফার্মেসি ও ফার্মাকোলজি বিভাগের  সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. আব্দুল মুহিত বলেন, সমপ্রতি নতুন ভারতীয় ধরন আক্রান্তের সংখ্যা ব্যাপক আকারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে করোনা রোগী শনাক্তকরণের সাথে সাথে মৃত্যুহারও দিন দিন বেড়ে চলেছে। এমতাবস্থায়, সরকার বিভিন্ন সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে আংশিক কঠোর লকডাউনের চিন্তাভাবনা করছে। সিকোয়েন্সিং করে দেখা গেছে, প্রায় ৯০ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টটির উপস্থিতি পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বসে করণীয় ও পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে কার্যকরভাবে।

আমারসংবাদ/জেআই