Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪,

ভূমিকম্পের ঝুঁকি এড়াতে পরিকল্পনা জরুরি

রায়হান আহমেদ তপাদার

জুন ১২, ২০২১, ০৫:৪৫ পিএম


ভূমিকম্পের ঝুঁকি এড়াতে পরিকল্পনা জরুরি
  • ঢাকা সিটি কর্পোরেশন অঞ্চলের তিন লাখ ২৬ হাজার ভবনের উপর পরিচালিত সমীক্ষা থেকে দেখা গেছে, এমন তীব্রতার ভূমিকম্পে প্রায় ৭২ হাজার ভবন সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাবে, আরও ৮৫ হাজার ভবন মাঝারি ধরনের ক্ষতিগ্রস্ত হবে। শুধু দালান ভাঙার কারণে ক্ষয়ক্ষতি হবে ৬-১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমতুল্য সম্পদ। এমনকি জাতিসংঘ পরিচালিত রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট টুলস ফর ডায়াগনসিস অব আরবান এরিয়াস এগেইনস্ট সিসমিক ডিজাস্টার জরিপে ভূ-তাত্ত্বিক ঝুঁকিপূর্ণ বিশ্বের ২০টি শহরের মধ্যে ঢাকাও অন্যতম। যদিও ভূমিকম্পের সময় সুরক্ষার কোনো গ্যারান্টি নেই, আগাম পরিকল্পনার সম্ভাব্য বিপদগুলো চিহ্নিতকরণে জীবন বাঁচাতে পারে এবং আঘাত ও সম্পত্তির ক্ষতি উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করতে পারে

ভূতাত্ত্বিক ও ভূমির গঠন অনুসারে বাংলাদেশ ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল। বিগত ২০০ বছরের ইতিহাসে দেখা যায়, বাংলাদেশ আটটি বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়েছিল। এর মধ্যে ১৮৮৫ সালের বেঙ্গল ভূমিকম্প ও ১৯১৮ সালের শ্রীমঙ্গল ভূমিকম্পের উৎসস্থল ছিলো বাংলাদেশের অভ্যন্তরে। বাংলাদেশের অভ্যন্তর ও চারপাশে বেশ কিছু সিসমিক গ্যাপ আছে। একে ভূমিকম্পের উৎসস্থল বলা হয়। ভূতত্ত্ববিদ ও সিসমোলজিস্টদের হিসাব মোতাবেক, বাংলাদেশে যেকোনো সময় মাঝারি কিংবা বড় মাত্রার ভূমিকম্প সংঘটিত হতে পারে। এ জন্য আমাদের কাঠামোগত এবং অকাঠামোগত প্রস্তুতি এখনই বাড়ানো দরকার। এ ধরনের প্রস্তুতির মধ্য দিয়ে ভূমিকম্প দুর্যোগের ঝুঁকি বহুলাংশে কমিয়ে আনতে পারবো। প্রাচীনকাল থেকে ভূমিকম্প নিয়ে মানুষের মধ্যে অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের সীমাহীন চর্চা অব্যাহত রয়েছে। বহু লোকের আজও এ অন্ধবিশ্বাস মনের মধ্যে সদা জাগ্রত রয়েছে যে, পৃথিবীটা চারটা বিশালাকৃতি হস্তীর ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে এবং ওই হস্তীরা যখন গা নাড়াচাড়া করে ওঠে তখনই পৃথিবীটা কেঁপে ওঠে এবং সাথে সাথে ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়। অবশ্য এরকম ধারণার আদৌ কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। অনেকে বলেন, এসব কুসংস্কার। ভূমিকম্প সৃষ্টির প্রধান কারণ হলো— পৃথিবীর বিভিন্ন স্তরের শিলাখণ্ডের স্থিতিস্থাপকীয় বিকৃতি। তদুপরি বিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞানীরা ভূমিকম্প সৃষ্টির অন্য এক কারণও উদ্ভাবন করেছেন, সেটা হলো— জলাশয় বেষ্টিত কম্পন। অগ্ন্যুৎপাতের সাথে ভূমিকম্পের সম্পর্ক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জসহ ফিলিপাইন্স অর্থাৎ প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে বেশি দেখা যায়। ১৮৮৩ সালে জাভার ক্রকাটোয়ায় অগ্ন্যুৎপাতের সাথে ঘন ঘন ভূকম্পন হয়েছিল তবে বেশির ভাগ ভূমিকম্পের মুখ্য কারণ যে ভূ-অভ্যন্তরের সংঘটিত ক্রিয়াকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সে কথা আজ প্রায় সুনিশ্চিত।

১৯০৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রান্সিকোতে সংঘটিত প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্পের পর বিজ্ঞানী এইচএফ রিড শিলাস্তরের স্থিতিস্থাপকতা নিয়ে বিস্তর গবেষণা করে এ বিষয়ে স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছান, যখন শিলাস্তরের নিজস্ব প্রতিরোধী ক্ষমতার ওপর অধিক চাপ সৃষ্টি হয় তখনই সে শিলাস্তর সঞ্চিত চাপ মুক্ত করতে শিলাচ্যুতির মাধ্যমে ভূ-আন্দোলনের সৃষ্টি হয় এবং তখনই ভূমিকম্পের উৎপত্তি ঘটে। এভাবে ভূস্তরে ঘটা বিচ্যুতির জন্যই ক’বছর আগে ভারতের গুজরাটে প্রবল ভূমিকম্প সংঘটিত হয় বলে বিজ্ঞানীরা অনুমান করেন। ভূমিকম্প উৎপত্তির কারণ অনুসন্ধানে বিজ্ঞানীরা সক্ষমতা লাভ করেছেন এবং সেই সাথে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে প্রতিষ্ঠিত ভূমিকম্প মাপক যন্ত্রের সাহায্যে ভূমিকম্পের উপকেন্দ্র নির্ণয় সম্ভবপর হয়ে উঠেছে এবং এর দ্বারা সম্ভাব্য ভূমিকম্পের স্থল বা বলয় চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে। ভূকম্পের এ বলয় পৃথিবীতে দুটো অঞ্চলে বিভক্ত হয়ে আছে যেমন— প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের পূর্ব উপকূলের রকি, অ্যান্দিজ ইত্যাদি পর্বত শ্রেণি অঞ্চল এবং পশ্চিম উপকূলের জাপান, ফিলিপাইন ইন্দোনেশিয়া দ্বীপপুঞ্জ, কেরিবিয়ান উপকূল, নিউগিনি, নিউজিল্যান্ডের দক্ষিণ কুমেরু পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে আছে, ভূমধ্যসাগরের চারদিকে আল্পস ককেসাস ইত্যাদি পর্বতের আশপাশে, হিমালয় পর্বতমালার চারপাশ, মিয়ানমার, নেপাল, আসামসহ কাশ্মীর ও পশ্চিম ভারত এবং পাকিস্তানের বিস্তীর্ণ অঞ্চল এ বলয়ের অন্তর্ভুক্ত। ভূ-তাত্ত্বিকরা ভূমিকম্পের আন্তর্জাতিক বলয়ের ও ভূমিকম্পের প্রাবল্যের ওপর ভিত্তি করে সম্ভাব্য ভূমিকম্পের পাঁচটি মণ্ডলে বিভক্ত করেছেন। যেমন— জম্মু কাশ্মীরের এক বৃহৎ অংশ, হিমাচল প্রদেশসহ মহারাষ্ট্র ও গুজরাটের একাংশ, উত্তর প্রদেশের পশ্চিম পাহাড়ি অঞ্চল, বিহার, সিকিম ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যসমূহ এবং আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ এবং বাংলাদেশ। এমনকি ভূমিকম্পের সম্ভাব্য স্থান নির্ণয়ে বিজ্ঞানীরা সক্ষম হলেও ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেয়া ও প্রতিরোধের ব্যবস্থা গ্রহণে এখনো তেমন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালনে সক্ষম হননি।

১৯৬০ সালে গামবেল নামের জনৈক বিজ্ঞানী একটা নতুন পরিসংখ্যান তত্ত্ব উদ্ভাবন করেন এবং তাতে দেখা যায়— বৃহৎ ভূমিকম্পের সংখ্যা ক্ষুদ্র ভূমিকম্পের চেয়ে অনেক কম। গুটেনবার্গ নামের একজন বিজ্ঞানী ভূমিকম্পের সংখ্যা এবং রিখটার স্কেলে দেখা ভূমিকম্পের মাত্রার মধ্যে একটা সমীকরণ উদ্ভাবন করেন যার দ্বারা ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেয়া কিছুটা সম্ভবপর হয়। ভূমিকম্প শব্দটি দ্বারা যেকোনো প্রকার ভূকম্পনজনিত ঘটনাকে বোঝায় সেটা প্রাকৃতিক অথবা মনুষ্য সৃষ্ট যাই হোক না কেন। বেশির ভাগ ভূমিকম্পের কারণ হলো ভূগর্ভে ফাটল ও স্তরচ্যুতি হওয়া; কিন্তু সেটা অন্যান্য কারণ যেমন অগ্ন্যুৎপাত, ভূমিধস, খনিতে বিস্ফোরণ বা ভূগর্ভস্থ নিউক্লিয়ার গবেষণায় ঘটানো আণবিক পরীক্ষা থেকেও হতে পারে। ভূমিকম্পের প্রাথমিক ফাটলকে বলে ফোকাস বা হাইপো সেন্টার। ভূ-অভ্যন্তরে শিলায় পীড়নের জন্য যে শক্তির সঞ্চয় ঘটে, সেই শক্তির হঠাৎ মুক্তি ঘটলে ভূপৃষ্ঠ ক্ষণিকের জন্য কেঁপে ওঠে এবং ভূ-ত্বকের কিছু অংশ আন্দোলিত হয়। এরূপ আকস্মিক ও ক্ষণস্থায়ী কম্পনই ভূমিকম্প। ভূমিকম্প সাধারণত কয়েক সেকেন্ড থেকে এক-দুই মিনিট স্থায়ী হয়। মাঝে মধ্যে কম্পন এত দুর্বল হয় যে, তা অনুভব করা যায় না। 

৭০০ কিলোমিটার গভীরে গুরুমণ্ডল থেকেও ভূকম্পন উত্থিত হতে পারে। বিভিন্ন কারণে ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়ে থাকে। আমাদের ভূ-পৃষ্ঠ অনেকগুলো প্লেটের সমন্বয়ে গঠিত। এই প্লেটগুলো একটি আরেকটির থেকে আলাদা থাকে ফল্ট বা ফাটল দ্বারা। প্লেটগুলোর নিচেই থাকে ভূ-অভ্যন্তরের সব গলিত পদার্থ। কোনো প্রাকৃতিক কারণে এ গলিত পদার্থগুলোর স্থানচ্যুতি ঘটলে প্লেটগুলোরও কিছুটা স্থানচ্যুতি ঘটে। এ কারণে একটি প্লেটের কোনো অংশ অপর প্লেটের তলায় ঢুকে যায়, যার ফলে ভূমিতে কম্পন সৃষ্টি হয়। আর এই কম্পনই ভূমিকম্প রূপে আমাদের কাছে আবির্ভূত হয়। কখনো কখনো আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ ও গলিত লাভা উৎক্ষিপ্ত হওয়ার কারণে ভূমিকম্পের সৃষ্টি হতে পারে। কখনো পাহাড় কিংবা উঁচু স্থান থেকে বৃহৎ পরিসরে শিলাচ্যুতি-জনিত কারণে ভূমিকম্প হতে পারে। ভূ-ত্বক তাপ বিকিরণ করে সংকুচিত হয়ে পড়লে ফাটল ও ভাঁজের সৃষ্টি হয়ে ভূমিকম্প হয়। ভূ-গর্ভে বাষ্প ক্রমাগত বৃদ্ধি পেলে তা ভূ-ত্বকের নিম্নভাগ ধাক্কা দেয় ফলে প্রচণ্ড ভূকম্পন অনুভূত হয়। কখনো প্রকাণ্ড হিমবাহ পর্বতগাত্র হতে হঠাৎ নিচে পতিত হয়েও ভূমিকম্প হয়। বাংলাদেশ ভারত ও মিয়ানমারের ভূ-অভ্যন্তরের দুটি ভূচ্যুতির প্রভাবে আন্দোলিত হয়। বাংলাদেশ, ভারতীয়, ইউরেশীয় এবং মিয়ানমারের টেকটনিক প্লেটের মধ্যে অবস্থান করছে। ভারতীয় এবং ইউরেশীয় প্লেট দুটি দীর্ঘদিন যাবৎ হিমালয়ের পাদদেশে আটকে পড়ে আছে এবং অপেক্ষা করছে বড় ধরনের ভূকম্পনের। বাংলাদেশে আটটি ভূতাত্ত্বিক চ্যুতি এলাকা বা ফল্ট জোন সচল অবস্থায় রয়েছে, যথা— বগুড়া চ্যুতি এলাকা, রাজশাহীর তানোর চ্যুতি এলাকা, ত্রিপুরা চ্যুতি এলাকা, সীতাকুণ্ড টেকনাফ চ্যুতি এলাকা, হালুয়াঘাট চ্যুতির ডাওকি চ্যুতি এলাকা, ডুবরি চ্যুতি এলাকা, চট্টগ্রাম চ্যুতি এলাকা, সিলেটের শাহজীবাজার চ্যুতি এলাকা এবং রাঙামাটির বরকলে রাঙামাটি চ্যুতি এলাকা। যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের লেমন্ট-ডোহের্টি আর্থ অবজারভেটরির ভূ-তাত্ত্বিকরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশের নিচে জমে ওঠা টেকটনিক প্লেটে চাপ জমে উঠছে কম করে বিগত ৪০০ বছর ধরে। এই চাপ যখন মুক্ত হবে, তখন সৃষ্ট ভূমিকম্পের মাত্রা দাঁড়াবে প্রায় ৮.২ রিখটার, এমনকি তা ৯ রিখটারেও পৌঁছতে পারে। প্রায় ১৪ কোটি মানুষ এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। ১৯১৮ সালে শ্রীমঙ্গলে ৭.৬ মাত্রার ভূমিকম্প হয় এবং ২০০৭ সালের নভেম্বর মাসে হয় ৬.০ মাত্রার ভূমিকম্প। এমনকি বুয়েটের মানমন্দিরে ২০০৬ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত চার বছরে রিখটার স্কেলে চার মাত্রার ৮৬টি ভূ-কম্পন নথিভুক্ত করা হয়। এই সময়ের মধ্যে পাঁচ মাত্রার চারটি ভূ-কম্পনও ধরা পড়ে। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের মানমন্দিরে ২০০৭ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত কমপক্ষে ৯০টি ভূকম্পন নথিভুক্ত করা হয়, তন্মধ্যে ৯টিরই রিখটার স্কেলে মাত্রা ছিলো পাঁচের উপরে এবং সেগুলোর ৯৫ শতাংশেরই উৎপত্তিস্থল ছিলো ঢাকা শহরের ৬০০ কিলোমিটারের মধ্যে।

অতীতের এসব রেকর্ড থেকে দেখা যায়, ভূমিকম্পের মাত্রা না বাড়লেও ১৯৬০ সালের পর থেকে ভূমিকম্প সংঘটনের হার বেড়েছে, অর্থাৎ ঘন ঘন স্বল্প মাত্রার ভূমিকম্প হচ্ছে। মতবিরোধ থাকলেও অনেক ভূ-তাত্ত্বিক ছোট ছোট ভূমিকম্প সংঘটন বড় ধরনের ভূমিকম্পের পূর্বাভাস বলে উল্লেখ করেন। অতীতের এসব রেকর্ডকে প্রাধান্য দিয়ে গবেষকরা জানিয়েছেন যেকোনো সময় বাংলাদেশে রিখটার স্কেলে আট মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানতে পারে। সরকারি তথ্যসূত্র মতে, ঢাকায় রাতের বেলায় সাত থেকে ৭.৫ মাত্রার ভূমিকম্প হলে লক্ষাধিক লোক হতাহত হবে। দিনের বেলায় হলে হতাহতের সংখ্যা হবে কিছুটা কম। ঢাকা সিটি কর্পোরেশন অঞ্চলের তিন লাখ ২৬ হাজার ভবনের উপর পরিচালিত সমীক্ষা থেকে দেখা গেছে, এমন তীব্রতার ভূমিকম্পে প্রায় ৭২ হাজার ভবন সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাবে, আরও ৮৫ হাজার ভবন মাঝারি ধরনের ক্ষতিগ্রস্ত হবে। শুধু দালান ভাঙার কারণে ক্ষয়ক্ষতি হবে ৬-১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমতুল্য সম্পদ। এমনকি জাতিসংঘ পরিচালিত রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট টুলস ফর ডায়াগনসিস অব আরবান এরিয়াস এগেইনস্ট সিসমিক ডিজাস্টার জরিপে ভূ-তাত্ত্বিক ঝুঁকিপূর্ণ বিশ্বের ২০টি শহরের মধ্যে ঢাকাও অন্যতম। যদিও ভূমিকম্পের সময় সুরক্ষার কোনো গ্যারান্টি নেই, আগাম পরিকল্পনার সম্ভাব্য বিপদগুলো চিহ্নিতকরণে জীবন বাঁচাতে পারে এবং আঘাত ও সম্পত্তির ক্ষতি উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করতে পারে। ১৮৯৭ সালে ডাউকি ফল্ট লাইনে ৮ মাত্রারও বেশি মাত্রায় ভূমিকম্প হয়, যার তীব্রতা কলকাতা ছাড়িয়ে আরও পশ্চিমে এবং মিয়ানমার পর্যন্ত অনুভূত হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিজ্ঞানীরা জানতে পেরেছেন, পললভূমির নিচে অবস্থিত টেকটোনিক প্লেটগুলোর মধ্যে সংঘর্ষ হয়ে থাকে। ভূত্বকের নিচের অবস্থা জানতে যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-পদার্থবিদ মাইকেল স্টেকলারের নেতৃত্বে গবেষক দল বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় অতি সংবেদনশীল বেশ কিছু জিপিএস যন্ত্র স্থাপন করে। ২০০৩ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ওই গবেষণায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষকও অংশ নেন। স্টেকলার বলেন, বাংলাদেশে অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে ইতোমধ্যে নানা সমস্যা ধরা পড়েছে। সেখানে বালু ভরাট করে ২০ তলা ভবন নির্মাণ করতেও দেখা যায়। ভূমিকম্প হলে এ রকম ভবন সহজেই ধসে পড়বে। এ ছাড়া অতিরিক্ত জনবহুল হওয়ায় সেখানে ভূমিকম্প হলে প্রাথমিক উদ্ধার তৎপরতায় বিঘ্ন হতে পারে। এখন স্বাভাবিক অবস্থায়ই ঢাকা শহরে যানবাহন চলাচল কঠিন হয়ে পড়ে। সেখানকার রাস্তায় যদি ভূমিকম্পের ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে পড়ে, ত্রাণসামগ্রী পৌঁছানো এবং উদ্ধার তৎপরতা চালানো সত্যিই অসম্ভব কাজ হবে। তবে এই ভূমিকম্প ঠিক কখন হতে পারে, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। এটা আগামীকালই হতে পারে, আবার ৫০০ বছর পরেও হতে পারে। গবেষণাপত্রটি আরও বলছে, অনিয়ন্ত্রিত ভবন ছাড়াও ভূমিকম্পে ভারী শিল্প-কারখানা, বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং প্রাকৃতিক গ্যাসক্ষেত্রগুলো ধ্বংস হতে পারে। ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কায় অযথা আতঙ্কিত না হয়ে যাতে ভূমিকম্পের পরবর্তী দুর্যোগের মোকাবিলায় যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় সে বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করা প্রয়োজন। বিভিন্ন কর্মশালা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করা অত্যন্ত জরুরি। জেলা প্রশাসন, পৌরসভা, সিটি কর্পোরেশন ও নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের বিধি বহির্ভূতভাবে নির্মাণ করা এবং ভূমিকম্প ডিজাইন না থাকা ঘরবাড়িগুলো শনাক্ত করে বিহিত ব্যবস্থা গ্রহণ করাও উচিত।

লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট

raihan567@ahoo.com

আমারসংবাদ/জেআই