Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪,

বিতর্কে সংসদীয় কমিটি

জুন ১৭, ২০২১, ০৬:৪৫ পিএম


বিতর্কে সংসদীয় কমিটি
  • দায়িত্বশীলরা সংবিধানবিরোধী প্রস্তাব দিতে পারেন না -ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ
  • নারীদের যোগ্যতাকে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে -অ্যাডভোকেট জামিউল হক ফয়সাল
  • নারী-পুরুষ আলাদাভাবে প্রশ্ন তোলাটাই অস্বাভাবিক -অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ
  • এমন সুপারিশ কোনোভাবেই বাস্তবায়ন হবে না -অ্যাডভোকেট ফওজিয়া ফিরোজ

প্রশাসনের সর্বস্তরে নারীর জয়জয়কার। দলীয়প্রধান এবং স্পিকার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন নারী। সরকারের সচিব, মেজর জেনারেল, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, সামরিক-বেসামরিক বিভাগের ঊর্ধ্বতন পদেও দায়িত্ব পালন করছেন নারীরা। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, সেই সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছেন নারীরাও। পরিবার, সমাজ ও দেশের উন্নয়নে নারীরা প্রায় সমানভাবে অবদান রাখছেন। মাঠ প্রশাসনে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), জেলা প্রশাসন, পুলিশের এসপি পদেও আছে উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি। স্থানীয় সরকারের ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ ও জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব করছেন নারীরা। অথচ সম্প্রতি মুক্তিযোদ্ধাদের ‘গার্ড অব অনার’ দেয়ার ক্ষেত্রে নারী ইউএনওদের বিকল্প খুঁজতে সরকারের কাছে সুপারিশ করেছে সংসদীয় কমিটির। আর এতেই সমালোচনার ঝড় বইছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে সর্ব ক্ষেত্রে। সংসদীয় কমিটির এই সুপারিশকে নারীবিদ্বেষী বলেও আখ্যা দিচ্ছেন কেউ কেউ। প্রতিবাদে বিক্ষোভ মানববন্ধনও হচ্ছে। ঘৃণা ও নিন্দার ঝড় বইছে দেশব্যাপী। প্রতিবাদ জানিয়েছে বিভিন্ন মানবাধিকার ও সামাজিক সংগঠনগুলোও।

এদিকে সংসদীয় কমিটি অহেতুক বিতর্কে জড়াচ্ছে বলে দাবি করেছেন বিশ্লেষকরা। সুপারিশে ধর্মীয় অনুভূতির যুক্তি দিয়ে, যেখানে নারী ইউএনও আছেন, সেখানে বিকল্প পুরুষ কর্মকর্তা নির্ধারণ করার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা নিন্দনীয় বলেও দাবি করছেন তারা। আবার এটাকে সংবিধানবিরোধী অবস্থান বলে অভিহিত করেছে সিপিবির নারী সেল। সংগঠনটি মনে করে, এটি নারীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। এই প্রস্তাবকারীদের আইনের আওতায় আনারও দাবি জানান তারা। আপত্তি ও তীব্র নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের ৫০ আইনজীবী। ইতোমধ্যে এই সুপারিশের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিটও করা হয়েছে।  এ অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একদিকে নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলা হচ্ছে, অন্যদিকে ধর্মের দোহাই দিয়ে নারীকে সরিয়ে রাখার অপচেষ্টা চলছে। স্বাধীনতার ৫০ বছরে উন্নয়নের মহাসড়কে দাঁড়িয়ে এ ধরনের লজ্জাজনক বক্তব্য কোনোভাবেই কাম্য নয়। করোনাকালে নারী ঘরে নির্যাতিত, কিন্তু আজ নারীরা রাষ্ট্রীয়ভাবেও নির্যাতিত হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছে। অনেক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নারী তার নিজ যোগ্যতায় প্রশাসনে জায়গা করে নিয়েছে। নারীর অর্জনকে নষ্ট করার অধিকার কেউ রাখে না। সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাজের প্রশ্ন তুলে বিশ্লেষকরা বলেছেন, তাদের কাজ হলো মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট কোনো কাজে অনিয়ম, দুর্নীতি, গাফিলতি দেখলে নোট দেয়া— সুপারিশ করা। প্রয়োজনে জড়িত বা সন্দেহভাজনকে ডেকে এনে জিজ্ঞাসাবাদ ও তদন্ত করা। এসব কিছুতে না গিয়ে করোনায় নাকাল সময়ে এ কোন কাজ খুঁজে বের করলো সংসদীয় স্থায়ী কমিটি? বাঘা বাঘা মুক্তিযোদ্ধা আছেন ওই কমিটিতে। কমিটির সভাপতি সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খান। মুক্তিযুদ্ধ-বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকও এর সদস্য। সদস্যদের মধ্যে আরও আছেন সেক্টর কমান্ডার রফিকুল ইসলাম বীরউত্তম, রাজিউদ্দীন রাজু, কাজী ফিরোজ রশীদ ও ওয়ারেসাত হোসেন বেলালের মতো তুখোড় মুক্তিযোদ্ধারা। রাজনীতিতেও তাদের একেকজনের বর্ণাঢ্য ইতিহাস। মুক্তিযুদ্ধে নারীরা ছিলেন, সংবিধান অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধাকে সম্মান জানানোর বিষয়ে নারী-পুরুষের মধ্যে ভেদাভেদ নেই। নারীর ক্ষমতায়নে বিশাল অবদান রাখা সরকারের আমলে সংসদীয় কমিটিতে এমন সুপারিশ অনেকের জন্যই কষ্টের।

পরিসংখ্যান বলছে, এখন দেশের পাঁচ কোটি ৪১ লাখ কর্মজীবীর মধ্যে এক কোটি ৬২ লাখই নারী। দেশে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা আছেন পাঁচ হাজার ৭৫৯ জন। এর মধ্যে প্রায় এক হাজার ১০০ জনই নারী। এছাড়া পুলিশ ক্যাডারেও নারীরা সফলতা দেখিয়েছেন। বর্তমানে দেশের ৪৮৫ উপজেলার মধ্যে ১০৬ উপজেলায় নারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) দায়িত্ব পালন করছেন। এ ছাড়া সরকারের জনপ্রশাসনে ছয়জন জেলা প্রশাসক (ডিসি), ১৬ জন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এডিসি), ১০ জন নারী সচিব আছেন। এমন পরিস্থিতিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নিয়েছে যেসব উপজেলায় নারী ইউএনও আছেন সেসব উপজেলায় পুরুষ এসিল্যান্ড নিয়োগ দিতে হবে। দেশের যে ১০৬ উপজেলায় নারী ইউএনও রয়েছে সেখানে প্রশাসনিক কাজ মন্থর হয়ে আছে এমন কোনো অভিযোগ তো নেই-ই, বরং জনপ্রশাসন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নারী কর্মকর্তাপ্রধান উপজেলাগুলোতে ভালো কাজ হচ্ছে।

এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে নারী অধিকারে সোচ্চার বিশিষ্ট আইনজ্ঞ ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ বলেন, ‘প্রথমে বৈঠকে রাতে গার্ড অব অনার না দিয়ে দিনে দেয়ার যে প্রস্তাব দিয়েছেন, তার সঙ্গে আমাদের দ্বিমত নেই। গ্রামাঞ্চলে রাতে গার্ড অব অনার দেয়া হলে অনেকের পক্ষে হাজির হওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। কিন্তু গার্ড অব অনারের ক্ষেত্রে নারী ইউএনওর বিকল্প ব্যবস্থার কথা বলা যেমন বৈষম্যমূলক, তেমনি সংবিধানবিরোধী। ‘সংবিধানের ২৮ অনুচ্ছেদের (১)-এ বলা আছে, কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ নারী-পুরুষে বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবে না। একই অনুচ্ছেদের (২)-এ আছে, রাষ্ট্র ও জনজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষ সমান অধিকার লাভ করিবে।’ সেখানে সংবিধানবিরোধী প্রস্তাব কোনো দায়িত্বশীলরা দিতে পারেন না। 

এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে সুপ্রিম কোর্টের আরেক আইনজীবী অ্যাডভোকেট জামিউল হক ফয়সাল বলেন, ‘যেখানে নারীকে সামনে এগিয়ে নেয়ার জন্য ডিসক্রিমিনেশন ল’ করার অনুমতি দিয়েছেন আদালত, সেখানে গার্ড অব অনার দেয়ার ক্ষেত্রে নারীকে না রাখার সুপারিশে সমাজে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এটাকে নারীদের যোগ্যতাকে অবমূল্যায়ন করা, যা নারীর প্রতি অবমাননাকর। যেখানে পবিত্র সংবিধানে নারী-পুরুষ সবারই সমান অধিকার দিয়েছে। এ ধরনের প্রস্তাব অবান্তর, মানহানিকর। সংসদীয় কমিটির এই সুপারিশ সংবিধানের ২৭ ও ২৮ অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন। সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।’

স্থানীয় সরকার ও শাসন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘এ যুগে এসে নারী-পুরুষ নিয়ে আলাদাভাবে প্রশ্ন তোলাটাই অস্বাভাবিক। নারী সচিব-ডেপুটি কমিশনার আছেন। এই সময়ে এসে নারী ইউএনও নিয়ে কথা বলাটা অত্যন্ত পশ্চাৎপদ চিন্তা। বিশেষ কোনো অনুকম্পা-আনুকূল্য দিয়ে নারীকে পদায়ন করা হয়নি। নারীর স্বীয় মূল্যায়ন আছে। একজন নারী নিজ যোগ্যতায় ইউএনও পদে আসেন। এ ক্ষেত্রটা নারী ও পুরুষের নয়।’

সুপারিশের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে গত সোমবার হাইকোর্টে রিট করেছে ফাউন্ডেশন ফর ল’ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এফএলএডি)। আবেদনকারীর আইনজীবী ফওজিয়া করিম ফিরোজ বলেন, ‘সংসদীয় কমিটির এই সুপারিশ সংবিধানের ২৭ ও ২৮ অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন। সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। কেন নারীদের গার্ড অব অনার দিতে দেয়া হবে না, এর কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা তারা দেননি, দিতেও পারবেন না। এমন সিদ্ধান্ত মেনে নেয়ার কোনো কারণ নেই।’ এমন সুপারিশ যেনো কোনোভাবেই বাস্তবায়ন হতে না পারে, সে জন্য সবাইকেই নিজ নিজ অবস্থান থেকে এগিয়ে আসার অনুরোধ জানান তিনি।

আমারসংবাদ/জেআই