Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪,

সাধারণ মানুষ চায় সুনিশ্চিত জীবন

মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন

জুন ১৯, ২০২১, ০৬:৩০ পিএম


সাধারণ মানুষ চায় সুনিশ্চিত জীবন
  • সাধারণ মানুষ অর্থনীতির এত মারপ্যাচ বোঝে না। অতি সাধারণ মানুষ তো আরো বোঝে না। তাদের দৃষ্টিতে জিনিসপত্রের দাম কমলে বাজেট ভালো। জিনিসপত্রের দাম বাড়লে বাজেট ভালো না। বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশের অতি সাধারণ মানুষের এমন ধারণা হওয়া স্বাভাবিক। কারণ তারা সারাক্ষণভাবে জীবন-জীবিকা নিয়ে। কীভাবে জীবন চালাবে, সংসার-পরিবার চালাবে— সে চিন্তায় অস্থির থাকে একজন অতি সাধারণ মানুষ। তাই তাদের বাজেট ভাবনাও সাদাসিধা। জিনিসপত্রের দাম বাড়লে জীবন-জীবিকার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। দাম কমলে ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। তাদের দৃষ্টিতে, যে সরকার কমদামে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য দিতে পারে সে সরকার ভালো সরকার

করোনা মহামারিতে নতুন এক কোটি ৬৪ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। নতুন দরিদ্রদের বেশির ভাগই করোনার কারণে চাকরিহারা। তাদের কর্মসংস্থানের একটা গাইডলাইন থাকলে সমাজ উপকৃত হবে। বাজেট একটি দেশের সারা বছরের আয়-ব্যয়ের হিসাব। তবে অন্যভাবে বলা যায় বাজেট শুধু আয়-ব্যয়ের অঙ্ক নয়। বাজেট হচ্ছে যেকোনো রাজনৈতিক সরকারের একটি উন্নয়নের ফিরিস্তি বা দলিলও। সরকারের সার্বিক পরিকল্পনার প্রতিফলন ঘটে বাজেটে। সাধারণ মানুষ অর্থনীতির এত মারপ্যাচ বোঝে না। অতি সাধারণ মানুষ তো আরো বোঝে না। তাদের দৃষ্টিতে জিনিসপত্রের দাম কমলে বাজেট ভালো। জিনিসপত্রের দাম বাড়লে বাজেট ভালো না। বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশের অতি সাধারণ মানুষের এমন ধারণা হওয়া স্বাভাবিক। কারণ তারা সারাক্ষণভাবে জীবন-জীবিকা নিয়ে। কীভাবে জীবন চালাবে, সংসার-পরিবার চালাবে— সে চিন্তায় অস্থির থাকে একজন অতি সাধারণ মানুষ। তাই তাদের বাজেট ভাবনাও সাদাসিধা।

জিনিসপত্রের দাম বাড়লে জীবন-জীবিকার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। দাম কমলে ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। তাদের দৃষ্টিতে, যে সরকার কমদামে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য দিতে পারে সে সরকার ভালো সরকার। অতি সাধারণ মানুষের ভাবনাগুলোও অতি সাধারণ। সরকার যদি তাদের পালসটা ধরতে পারে তাহলেই দেশের জন্য, সমাজের জন্য, দেশের মানুষের জন্য কল্যাণকর। বর্তমান সরকার হয়তো সাধারণ বা অতি সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করেই করোনাকালীন বাজেট পেশ করেছে। এবারের বাজেটকে বলা যায় ‘জীবন-জীবিকার বাজেট’। আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য ছয় লাখ তিন হাজার ৬৮১ কোটি টাকার সবচেয়ে বড় বাজেট ঘোষণা করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বিশাল আকারের এই বাজেটে সর্বাধিক গুরুত্ব পেয়েছে মানুষের জীবন ও জীবিকা। জোর দেয়া হয়েছে স্বাস্থ্য খাতে। দীর্ঘদিন পর এই প্রথমবারের মতো বাজেট ঘাটতি ৬ শতাংশের বেশি ধরা হয়েছে। এর অন্যতম কারণ সরকারের আয় কমে যাওয়া।

এবারের প্রস্তাবিত বাজেট ঘাটতি ধরা হয়েছে দুই লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের পাঁচ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছিল এক লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। প্রস্তাবিত নতুন বাজেটে মোট আয়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে তিন লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ তিন লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। ঘাটতি অর্থ জোগাতে বৈদেশিক রিন নেয়া হবে ৯৭ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ খাত থেকে রিন নেয়া হবে এক লাখ ১৩ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা। বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, ‘জীবন-জীবিকায় প্রাধান্য দিয়ে সুদৃঢ় আগামীর পথে বাংলাদেশ’ শিরোনামের এবারের বাজেট প্রস্তুত করা হয়েছে সরকারের অতীতের অর্জন এবং উদ্ভূত বর্তমান পরিস্থিতির সমম্বয়ে। এবারের বাজেটে সঙ্গত কারণেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে স্বাস্থ্য খাতে। পাশাপাশি কোভিড-১৯ মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজগুলোর বাস্তবায়ন, কৃষি খাত, খাদ্য উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনাকে অধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। অর্থবছরের পুরো সময়জুড়েই থাকবে সরকারের নানা ধরনের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি। বাড়ানো হবে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা।

করোনা মহামারির কারণে অর্থবছরের প্রথম আট মাসে রাজস্ব ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৫১ হাজার কোটি টাকা। ব্যবসায়ী, পেশাজীবী, বেসরকারি খাতের চাকরিজীবী, উদ্যোক্তাসহ সব শ্রেণির মানুষের আয় কমেছে। শুধু সরকারি চাকরিজীবীদের আয় আগের মতোই আছে। করোনার প্রভাব তাদের ওপর তেমন একটা পড়েনি। সে বিবেচনায় নতুন অর্থবছরের বাজেটে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য আগের মতোই রাখা হয়েছে। তারপরও করোনা পরিস্থিতি ও ব্যবসায়ীদের দীর্ঘদিনের দাবি আমলে নিয়ে কর্পোরেট কর কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে নতুন বাজেটে। এ ছাড়া কৃষি খাত ও দেশি শিল্পের ক্ষেত্রে কর অবকাশ, কর অব্যাহতিসহ নানা সুবিধা দেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। চেষ্টা করা হয়েছে সাধ ও সাধ্যের সমন্বয়ের। করোনা মোকাবিলায় বিশেষ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। সুযোগ দেয়া হয়েছে কালো টাকা সাদা করার। বাড়ানো হয়েছে সামাজিক নিরাপত্তার আওতা। টানা ১৫ মাস ধরে চলা করোনা ভাইরাস মহামারির ফলে দেশের বেশির ভাগ মানুষের আয় কমেছে। নতুন করে দরিদ্র হয়েছে আড়াই কোটি মানুষ। কর্মহীন হয়ে পড়েছে লাখ লাখ মানুষ। যার কারণে প্রস্তাবিত বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা গুরুত্ব পেয়েছে। করোনা মহামারিতে ক্ষতিগ্রস্ত সবাইকে কিছু না কিছু দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।

মহামারির কারণে মানুষের আয় যেমন কমেছে তেমনি সরকারের আয়ও কমেছে। ফলে রাজস্ব ঘাটতি বেড়েছে। বাজেট ঘাটতিতে সৃষ্টি হয়েছে নতুন রেকর্ড। বলা হচ্ছে এবারের বাজেট জীবন-জীবিকার বাজেট। আসলে যাদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তার আওতা বাড়ানো হয়েছে তারা কতটা উপকৃত হচ্ছে এই প্রশ্নটা সামনে চলে আসে। সরকার গরিব মানুষের উন্নয়নে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে প্রতি বছর বরাদ্দ বৃদ্ধি করে চলেছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে মোট এক লাখ সাত হাজার ৬১৪ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে— যা মোট বাজেটের ১৭ দশমিক ৮৩ শতাংশ এবং জিডিপির ৩ দশমিক ১১ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে সর্বাধিক দারিদ্র্যপ্রবণ ১১২ উপজেলায় বিদ্যমান নীতিমালা অনুযায়ী দারিদ্র্যপ্রবণ ব্যক্তিকে শতভাগ ‘বয়স্কভাতা’র আওতায় আনা হয়েছে। এবার তা বাড়িয়ে ১৫০ উপজেলা করা হয়েছে। কিন্তু দারিদ্র্যপ্রবণ ব্যক্তির সংজ্ঞাটা এখনো ঠিক পরিষ্কার না। কোনো কোনো এলাকায় এমন সব মানুষ দারিদ্র্যপ্রবণ ব্যক্তির আওতায় এসেছে যার কর্মক্ষম ছেলে-মেয়ে আছে, যাদের প্রতিজনের মাসিক আয় ২৫ হাজার টাকার উপরে। আবার এমন অনেক দরিদ্র মানুষ আছে— যার কোনো ছেলে-মেয়ে নেই। এক টাকা আয় রোজগার নেই। অথচ তাদের নাম দরিদ্র ব্যক্তির তালিকায় আসে না। বিষয়টা খতিয়ে দেখা জরুরি বলে সাধারণ মানুষ মনে করে। এবারের বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রাখা হয়েছে। মাঝে মধ্যেই এ সুযোগ দেয়া হয়। যার ফলে দরিদ্ররা আরো দরিদ্র হয়। ধনী আরো ধনবান হয়।

কালো টাকা দিয়ে একজন অসৎ মানুষ শত শত বিঘা জমি কিনে ফেলে। সাধারণ মানুষ এক কাঠা জমি কিনতেই হিমশিম খায়। কালো টাকা সাদা করার সুযোগটা দেশকে দুর্নীতির দিকে ধাবিত করতে অনুপ্রাণিত করে। একজন অসৎ মানুষ যদি তার অবৈধ পথে আয় করা টাকা কর দিয়ে বৈধ করতে পারে তাহলে সততা আর অসততার মাঝে কোনো পার্থক্য থাকে না। সমাজে বৈধ পথে দুর্নীতিবাজ হওয়ার প্রবণতা বাড়ে। ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য ৭১ হাজার ৯৫১ কোটির টাকার বাজেট প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। গত বছরের চেয়ে এবার পাঁচ হাজার ৫৫১ কোটি টাকা বেশি। খুবই সময়োপযোগী প্রস্তাব। তবে এই বরাদ্দের একটা অংশ যদি ডিজিটাল শিক্ষা খাতে ব্যয় করা যায় তাহলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীরা বেশ উপকৃত হবে। তাদের যদি বিনামূল্যে ল্যাপটপ বা ডেক্সটপ দেয়া যায় তাহলে তারা নির্বিঘ্নে অনলাইন ক্লাস করতে পারবে।

সরকারি গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)-এর তথ্যমতে করোনা মহামারিতে নতুন এক কোটি ৬৪ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। নতুন দরিদ্র্যদের বেশির ভাগই করোনার কারণে চাকরিহারা। তাদের কর্মসংস্থানের একটা গাইডলাইন থাকলে সমাজ উপকৃত হবে। দেড় বছরে ক্ষতিগ্রস্ত কর্মসংস্থান, ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও কৃষি খাতে আছে বিশেষ ছাড়ের ঘোষণা। খুবই ইতিবাচক দিক। বাজেটের সব কটি প্রস্তাবই সময়োপযোগী। তবে সততার বিষয়টাকে অগ্রাধিকার দিলে করোনাকালীন এই বিপদ কাটিয়ে উঠতে পারবে বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত শক্তিশালী করতে সততার বিকল্প নেই। এবারের বিশালাকৃতির এই বাজেট অবশ্যই সরকারের সৎসাহসের পরিচয় বহন করে। কালো টাকা সাদাকরণের বাজেট সাধারণ মানুষ চায় না। তারা চায় সাদা টাকায় দেশ চলুক। তাহলে মনের জোর থাকবে শতভাগ চাঙ্গা। তবেই সাধারণ মানুষ অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে সুনিশ্চিত সুন্দর জীবনের স্বাদ ভোগ করবে।

লেখক : কলামিস্ট

আমারসংবাদ/জেআই