Amar Sangbad
ঢাকা বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪,

হাসপাতালে শয্যা সংকট চরমে

মাহমুদুল হাসান

জুন ২১, ২০২১, ০৬:০৫ পিএম


হাসপাতালে শয্যা সংকট চরমে
  • রাজশাহী-খুলনায় চাপ সবচেয়ে বেশি
  • সীমান্তের জেলায় মেঝেতেও চিকিৎসা নিচ্ছেন রোগীরা
  • জনসংখ্যা অনুপাতে হাসপাতালে নেই পর্যাপ্ত শয্যা
  • লোকবল সংকটও সীমান্তের জেলাতে
  • গতকাল আরও ৭৮ জনের মৃত্যু
  • দেশে শনাক্ত-মৃত্যুর অধিকাংশ সীমান্তের
  • ঢাকার আশপাশের সাত জেলায় কঠোর লকডাউন

ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ভয়াবহভাবে জেঁকে বসেছে। সীমান্তবর্তী জেলা থেকে ডেল্টার গণসংক্রমণ ঘটেছে সারা দেশে। ফলে করোনার তৃতীয় ঢেউ আসন্ন। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে শনাক্ত-মৃত্যু। দেশের ৩০টি সীমান্তবর্তী জেলার অধিকাংশই ঝুঁকিতে রয়েছে। ডেল্টার সংক্রমণও সীমান্তের জেলা হয়ে দেশে ছড়িয়েছে। ভারতে করোনার উচ্চ সংক্রমণ ও মৃত্যুর জন্য ডেল্টাকে দায়ী করা হচ্ছে। গেলো ৮ মে বাংলাদেশেও ভারতফেরত দুই ব্যক্তির নমুনায় প্রথম ভাইরাসটি শনাক্ত হয়। এরপর শুধু বেড়েই চলছে সংক্রমণ। গতকাল ডেল্টার প্রকোপে আরও ৭৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ সময় শনাক্ত রোগীর সংখ্যাও বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। গতকাল সোমবার আরও চার হাজার ৬৩৬ জনের নমুনায় করোনার উপস্থিতি মিলেছে। শনাক্ত ও মৃতের অধিকাংশই দেশের পশ্চিমাঞ্চলের ভারত সীমান্তঘেঁষা রাজশাহী ও খুলনা বিভাগের। করোনা সংক্রমণের আঘাতে স্বাস্থ্য খাতের একের পর এক দুর্বলতা বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক জরিপে দেখা গেছে, দেশে এক হাজার মানুষের অনুপাতে একটিরও কম শয্যা রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুসারে দেশে এক হাজার মানুষের অনুপাতে সাড়ে তিনটি শয্যা থাকার কথা থাকলেও বাংলাদেশে শূন্য দশমিক ৯৬ শতাংশ বা একটিরও কম শয্যা রয়েছে। রাজশাহী ও খুলনা বিভাগের হাসপাতালগুলোতে সংকুলান হচ্ছে না করোনা রোগীর। পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন হাসপাতালের চিকিৎসকরা। অনেক করোনা রোগীকে মেঝেতে রেখে চিকিৎসা দিতে হচ্ছে। এদিকে করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ঠেকাতে রাজধানীর পার্শ্ববর্তী নারায়ণঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, গাজীপুর, মাদারীপুর, রাজবাড়ী, মানিকগঞ্জ ও গোপালগঞ্জ— এই সাত জেলায় কঠোর লকডাউন ঘোষণা করেছে সরকার। এসব জেলায় চলবে না কোনো গণপরিবহন। আজ থেকেই এসব জেলায় কঠোর বিধিনিষেধ কার্যকর করা হবে। চলবে আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত। গতকাল সচিবালয়ে সরকারের শীর্ষপর্যায়ের এক বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম এসব সিদ্ধান্ত জানান।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন্স অ্যান্ড কন্ট্রোল রুমের তথ্যমতে, রাজশাহী বিভাগের ১০ হাসপাতালে ৯৬৬টি সাধারণ বেড রয়েছে। তার মধ্যে মাত্র ১৬০টি শয্যা ফাঁকা রয়েছে। ৪৬টি আইসিইউ বেডের মধ্যে ১৭টি ফাঁকা রয়েছে। একই সময়ে খুলনা বিভাগেরও ১০ হাসপাতালে ৭৩৮টি সাধারণ শয্যার ২২৩টি শয্যা ফাঁকা রয়েছে বলে জানিয়েছে তারা। ৪০ আইসিইউর ১৪টি ফাঁকা থাকার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এই তথ্য একদিন পর আপডেট করা হলেও বর্তমান প্রেক্ষাপট ভিন্ন। গতকাল সোমবার রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী বলেন, গতকাল সকাল পর্যন্ত ৩০৯ বেডের বিপরীতে রোগী আছেন ৪০২ জন। তাদের মধ্যে রাজশাহীর ২৬৪ জন আর চাঁপাইনবাবগঞ্জের ৭০ জন রয়েছেন। হাসপাতালে আক্রান্ত বা উপসর্গ নিয়ে যেসব রোগী আসছেন তাদের সবাইকে ভর্তি করা হচ্ছে না। যাদের অক্সিজেন প্রয়োজন হচ্ছে শুধু তাদের ভর্তি করা হচ্ছে। অন্যদের চিকিৎসাপত্র দিয়ে বাড়ি পাঠানো হচ্ছে। তারা বাড়ি থেকেই চিকিৎসা নিচ্ছেন। এরপরও হাসপাতালে সব রোগীকে বেড দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। পরিস্থিতি সামাল দিতে হাসপাতালের আরও একটি সাধারণ ওয়ার্ডকে করোনা ভাইরাস ওয়ার্ডে রূপান্তর করার কাজ চলছে। একই চিত্র খুলনাতেও। খুলনা কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালের কর্মকর্তারা বলছেন, করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর চাপের ফলে এখন রোগীদের মেঝেতে রেখে চিকিৎসা দিতে হচ্ছে। সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় আজ থেকে খুলনায় লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালের মুখপাত্র ডা. সুহাস চন্দ্র হালদার জানিয়েছেন, চিকিৎসার সব সরঞ্জাম থাকলেও রোগীর চাপ বেশি থাকায় তাদের মেঝেতে রেখে চিকিৎসা দিতে হচ্ছে, প্রতিনিয়ত তাদের সতর্ক থাকতে হচ্ছে। পর্যাপ্ত সিট দিতে পারছি না। ৩০ জনকে ফ্লোরে রেখেছি। এটা একটা বিশেষায়িত চিকিৎসা, হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানেলা, ভেন্টিলেশন দরকার হতে পারে। কিন্তু রোগীর এত চাপ, যে কারণে আমরা ফিরিয়ে দিতে পারছি না।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান জরিপ ২০১৯ অনুসারে, সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল মিলিয়ে প্রতি এক হাজার মানুষের জন্য হাসপাতালে শয্যা সংখ্যা রয়েছে মাত্র শূন্য দশমিক ৯৬টি, বা একটিরও কম শয্য রয়েছে। তার মধ্যে সরকারি হাসপাতালে প্রতি এক হাজার মানুষের জন্য শয্যা সংখ্যা প্রায় শূন্য দশমিক ৩২টি। বেসরকারি হাসপাতালে প্রতি এক হাজার মানুষের জন্য শয্যা সংখ্যা প্রায় শূন্য দশমিক ৬৪টি। এদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সুপারিশ অনুযায়ী, প্রতি এক হাজার মানুষের বিপরীতে সাড়ে তিনটি শয্যা থাকতে হবে। আন্তর্জাতিক মানের চেয়ে দেশের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোর শয্যা সংখ্যা অনেক কম। জরিপ প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, প্রতি একজন চিকিৎসকের (ডেন্টাল সার্জন বাদে) বিপরীতে মাত্র শূন্য দশমিক ৮৫ জন নার্স রয়েছেন। ডেন্টাল সার্জনদের অন্তর্ভুক্ত করলে প্রতি একজন চিকিৎসকের বিপরীতে নার্সের সংখ্যা দাঁড়ায় শূন্য দশমিক ৮৩ জন। প্রতি ৩ দশমিক ৪৭টি শয্যার জন্য একজন নার্স দায়িত্ব পালন করছেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, সারা দেশে সরকারি-বেসরকারি ৫২৮টি আরটিপিসিআর, র্যাপিড অ্যান্টিজেন ও জিন এক্সপার্ট ল্যাবে গতকাল ২৪ হাজার ৫৭টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এতে গতকাল চার হাজার ৬৩৬ জনের নমুনায় করোনা শনাক্ত হয়েছে। এ সময় সুস্থ হয়ে উঠেছে দুই হাজার ৮২৭ জন। এছাড়াও মৃত্যু হয়েছে ৭৮ জনের। এ পর্যন্ত ৬৬ লাখ ৫১ হাজার ৭৯১ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এতে শনাক্ত হয়েছে আট লাখ ৫৬ হাজার ৩০৪ জন। তার মধ্যে সুস্থ হয়েছে সাত লাখ ৮৫ হাজার ৪৮২ জন এবং মৃত্যু হয়েছে ১৩ হাজার ৬২৬ জনের।

আমারসংবাদ/জেআই